প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
কুলটিকরির হাট, সোলপার - নুয়াসাহী - বড়ডাঙার জ্যোৎস্না, সুবর্ণরেখার বালিতে ধনা বধুক, তালখুড়রুর জঙ্গলে শাল পিয়াশালের কানাকানি -
"ডাইনী " অপবাদদুষ্ট কানী হেমব্রম, তপোবনের মতো
খেঁড়রোরুচি অরণ্যের সে জ্যোৎস্না ও লবটুলিয়া - ফুলকিয়া বইহার - মোহনপুরা জুড়েই ছায়াটুকু মিশে আছে তপস্যার, "আরণ্যক"।
"যদ দুরাপংব যদ দুর্লভং দুস্তরং দুর্গমেব চ।
তৎ সর্বং তপসা প্রাপ্য তপোহি দুরতিক্রমঃ।"
টুরি ব্যাঙের রাতবিরাত আহ্বান, নীরবতার বিচ্ছিন্নতা আর নির্বাক চেহারা নিয়েই রাত্রির মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। তবু কল্পনার আধারে তপস্যায় যাপন৷ আর তখনই বিভূতিভূষণের "আরণ্যক " ছুঁয়ে থাকে সত্যচরণের কথা। কৌমুদীস্নাত শোভায় সরস্বতীর বুকে পূর্ণিমার আড়াল নামক খিদে। নিস্তরঙ্গ বিস্তীর্ণ বন পাহাড় বেষ্টিত হৈমন্তী পূর্ণিমার থৈ থৈ জ্যোৎস্না, যেন উন্মাদ চাঁদ।
সত্যচরণ তো পরী দেখে নি। কিন্তু আমীন রঘুবর বলেছিল, ও তো মায়ার কুণ্ডী৷ চাঁদের নীচে চাঁদোয়া।
জ্যোৎস্নারাত্রে পাথরের ওপরে উন্মুক্ত সৌন্দর্য মেলে পরীরা দ্রষ্টাকে ডুবিয়ে মারে। ও পদ্মফুলের জাগরণ হ্রদের ধারে যেন ভাসমান কুণ্ডীর জল।
ভাগলপুরের আজমাবাদ লবটুলিয়া ইসমাইলপুর
, মোহনপুরা রিজার্ভ ফিরেস্ট নাঢ়া বইহার মহালিখারূপ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। এই যে রাজমহল সাঁওতালভূম, ধলভূম, মানভূম , সিংহভূম - সবই নাকি পুরাভূম। এই পুরাভূমি ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। আসলে বাস্তবিক পৃথিবীর জীবগুলো ভারি অদ্ভূত। এ যেন, বন্ধ পালকি চড়ে পৃথিবী পরিভ্রমণ। বাসনা এবং সাধনা যেন অনুরূপ পরকাল।
মহাঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রে তখন জোয়ার। অনতি দূরেই আছে মহিষাসুর দঁকে, এ তো স্বতঃসিদ্ধ আবেগ। কর্দমাক্ত জলাভূমি ছুঁয়েই তো আদ্যিকাল থেকে আখের রস, জ্বাল দেওয়া " ডেগ " নিয়ে মাটির পূজা৷ আছে তো!! ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্র, ইন্দ্রিয় সমকক্ষ জ্যোৎস্না, সাথে আছড়ে ভাঙা জাহাজ কানা। লবটুলিয়া হিমবর্ষী আকাশ, জনহীন প্রান্তর, জলজ লিলির সুবাস, অর্কিডের রাঙাপলাশ, শালমঞ্জরি বন্য শেফালি যেন ইচ্ছাপুরণের গল্প।
সীমাহীন বর্ণনাই তো তেউড়ির ফুল, ছাতিম হংসলতার নীলফুল।। কিন্তু, সমালোচনারা আসে, কেবলমাত্র অরণই তো অধিক৷ জীবন যৌবনের জাগ্রত মায়া জুড়ে থাকে জ্যোৎস্না, গোলগোলি ফুল, মহালিখারূপের পাহাড় অবয়বী সজাগ।
আরণ্যক ছুঁয়ে সত্যচরণের সম্যক উপলব্ধি আর্যদের ইতিহাস বলে। অস্থি কঙ্কালের আদিম স্নিগ্ধ সমর্পণ যেন জরার প্রান্তসীমা। বৃদ্ধ দোবরু পান্না, তরুণ যুবক জগরু, তরুণ কুমারী ভানুমতী তো সেই বিজিত পদদলিতের প্রতিনিধি। তাই কি অন্ধকারে আলোবাতাসহীন গুহাবাস!! এও কি ইতিহাসের ট্রাজেডি!! আর প্রান্তিকের দলে প্রতিনিধি হয়েই তো রইল মুনেশ্বর সিং গনোরী গনু মাহাতো, ধাতুরিয়া যুগলপ্রসাদ সুরতিয়া, ছানিয়া।
সংযোজনের ভাষায় কোথাও কি এড়িয়ে গেছে "ল্যাটো'র কথা!! তৃষিত আঁখি জুড়ে স্বপ্নের
আকুল পথ৷ বালির খলায় ভাজা ছাল ছড়ানো তেঁতুলের বিচি আর নুন দিয়েই " মহুলসিজা "।শুকনো মহুয়া ফুল সেদ্ধ - সম্মিলনেই নাকি খাদ্য। তবু কি ভোলা যায়!! " ঐতরেয় আরণ্যক", এতো
বিভূতিভূষণীয়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours