শামা আরজু, ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:

মেয়েটি স্কুলে আসে না কেন জানতে চাইলে যে গল্প বেরিয়ে এলো তাতে আমি অবাক হইনি। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। আমি ওকে স্কুলে আনবোই। তারপর ওদের বাড়ি যেতে শুরু করলাম। ওকে বোঝাতে শুরু করলাম, দেখো দোষটা তোমার নয়। তুমি কেন লজ্জা পাচ্ছ? যে দোষ করেছে সে তো দিব্যি হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। তার কোনো দুঃখ নেই। তুমি কান্না করছো কেন, সে তো কান্না করছে না! সে হাসছে অথচ হাসবে তুমি।  লজ্জায় তার কান্না করার কথা।  একদিনের কথায় সে কি আর স্কুলে আসে! ঠিক কদিন গিয়েছিলাম গুনে রাখিনি তবে এটুকু বলতে পারি যে ওকে আমি স্কুলে আনতে সফল হয়েছিলাম। ব্যর্থ হইনি। খুব খারাপ ছিল না পড়ালেখায়। চলে যেত। দু-একটা সনদ পরীক্ষা দিয়ে সনদ পেলে স্বাবলম্বী হবে এমন চিন্তা ভাবনা ছিল আমার। পঞ্চম শ্রেণীতে  সনদ পরীক্ষায়  পাস করে  ও চলে গেল হাইস্কুলে। কিন্তু  ওখানে সপ্তম শ্রেণীর পর  আর পড়তে পারেনি।  ঠিক যে কারনে প্রাইমারি স্কুলে আসেনি একই কারণে।  
হয়তো আমার মতো কেউ এগিয়ে আসেনি  মেয়েটিকে স্কুলে আনার জন্য। কেউ চ্যালেঞ্জ নেয়নি। চরম ব্যক্তিস্বার্থমগ্ন একটা  সমাজে কার দায়  পড়লো। তাই  শেষ পর্যন্ত ওর পড়া হলো না।  আমার এই সৎ চিন্তার কাছে পরাজিত হলো  না অসৎ চিন্তার মানুষগুলি। শেষপর্যন্ত ওরাই জিতে গেল। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় সুমির (ছদ্মনাম) পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে বছর ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিল প্রতিবেশী এক হায়নার দ্বারা ।  মামলাও হয়েছিল। তারপর নারী ও শিশু নির্যাতন কোর্টের উকিল পিপি মেয়ের অভিভাবককে বলেছিল ছেলে মেয়েটিকে বিয়ে করবে। এই মর্মে ছেলেটি জামিন পেল। জামিনের পর বিয়েও হলো। কিন্তু এক রাত কিংবা দিনের জন্য মেয়েটিকে শান্তি দেয়নি ধর্ষক এবং ধর্ষকের পরিবার। সুমির অভিভাবকের ধারণা পিপি টাকা খেয়ে এমন করেছে। কিন্তু দোষ কি ওদের কম? ওরা ধর্ষকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে গেল কেন? কি বর্বর চিন্তা! ধর্ষককে বিয়ে করার চাইতে অবিবাহিত থাকাই উত্তম, এটা এই সমাজের মানুষ কখনো বুঝতে পারবে এ দুরাশা আজকাল আমি আর করিনা। কারণ এখনো দেখি ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়ে দিতে পারলে এক পক্ষ খুশিতে গদগদ হয়। সবাই তো আমার মত চিন্তা নিয়ে বসে থাকে না। সবাই চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না। চ্যালেঞ্জ নেয়ার কথা ভাবতেই শিখেনি ওরা। কিন্তু আমার এত রাগ হয় কেন? আমি জানি ওই যে আমার বাবা আমার ভেতর অন্যরকম এক আলো জ্বেলে ছিলেন, যে আলোয় আলোকিত মেয়েরা এ সমাজে বড় বেশি অচল। বড় বেশি খারাপ। অবশ্য সে  খারাপে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। আমি ভালো মেয়ে নই, পুতুপুতু মেয়ে নই। একটা খারাপ মেয়ে, নষ্ট মেয়ে আমি। এটা আমার গর্ব। ভালো মেয়েটির তবুও শেষ রক্ষা হলো না।  অত্যাচারের মুখে একসময় ডিভোর্স হয়ে গেল। কাবিনের টাকা আর পায়না। সমাজ সমাজ করে মেয়েটির জীবন শেষ করে দিল তার অভিভাবক। গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বার ওরা কাজ করে তাদের হয়ে যাদের টাকা আছে। যারা টাকা দিতে পারে। অবশ্য ওরা দুই পক্ষ থেকেও টাকা খায়। কিন্তু কাজ করে নির্যাতকের পক্ষে। এরমধ্যে ব্যতিক্রম দুই একটা ঘটনা ঘটে। মিডিয়া পত্রিকার কাটতির জন্য সেগুলো নিয়ে হইচই করে।
আমরাতো হুজুগে বাঙালি এমনি এমনি না।
 

 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours