কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

বাবার ওই একটা ডাকের জন্য অপেক্ষা।
"আয় খুকু আয়!"
বাবা তখন অন্য দুনিয়ায়। তবু মন মানে না। গ্রীষ্মের স্তব্ধ দুপুর। জানলা দিয়ে দৃষ্টি ছুটে চলেছে দূর, আরও বহু দূর। ধু ধু রাস্তা। কালো অজগরের মতো শুয়ে। জনমানবহীন। কী জানি, রাস্তার শেষে যদি বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!
'আয় খুকু আয়!' বাবার সেই ডাক আজও কানে বাজে। সময় অসময়ে তাড়া করে বেড়ায়।

বাবা মেয়ের এই টান বড় তীব্র। নিখাদ ভালবাসা। জন্মসূত্রে পাওয়া এই প্রেম। মেয়ের বয়স যখন মাত্র বছর তিনেক, তখন থেকেই বাবা মেয়ের দখলে। তবে সবচেয়ে মজার কথা, ওই পুঁচকের প্রেম কিন্তু মোটেই নিষ্কাম নয়। চমকে গেলেন? ওইটুকু শিশু, নাক টিপলেই দুধ গলে। তার আবার কাম? ও বোঝেটা কী?
সত্যিই ও কিছুই বোঝে না। তবু এরকমটাই হওয়ার কথা, বলেছিলেন ফ্রয়েড সাহেব। অস্ট্রিয়ার স্নায়ুবিদ আর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড।
শিশুমনের এ যৌনতা শরীরের না, মনের, অন্তরের। যা প্রকৃতির দান। মানবজাতির জন্মজাত। বাচ্চা মেয়ের এই মানসিক যৌনতার প্রবণতাকে বলা হয় 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্স'। ফ্রয়েডই প্রথম শিশুমনের এই সুপ্ত যৌনতার সন্ধান দেন। তাঁর এক সুইস বন্ধু কার্ল গুস্তভ ইয়াংও এব্যাপারে গবেষণা করছিলেন। অবশেষে 1913 সাল নাগাদ তাঁর তত্ত্ব পেশ করেন ইয়াং।

ইলেকট্রা আসলে গ্রিস দেশের এক রাজকুমারি। তাঁর মা প্রেমিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খুন করেছিল ইলেকট্রার বাবা, রাজা মাইসিনকে। মেয়ে ঠিক করে ফেলে বাবার খুনের প্রতিশোধ নেবে। ভাই অরিস্টাসের সঙ্গে ফুলপ্রুফ ছক কষে ফেলে সে। বাবার ওপর মেয়ের এই কমিটমেন্টই আকর্ষণ করেছিল সুইজারল্যান্ডের মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তভ য়াংকে। 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্স' নামের জনক ফ্রয়েড না। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইয়াং। 'ইলেকট্রা' শব্দের অর্থ 'স্ফুলিঙ্গ' অথবা 'বাদামি রং'।

বাবার ওপর মেয়ের টান কিন্তু জন্মজাত নয়। বরং বলা যায় অর্জিত। কিভাবে? তারই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ফ্রয়েড, ইয়াং দুজনেই। দুজনের তত্ত্বেই মিল আছে। সামান্য কিছু জায়গা ছাড়া।

ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কিন্তু মেয়ে মায়ের ন্যাওটাই হয়, মত ইয়াংয়ের। ভীষণ তীব্র আবেগে জড়ানো মা মেয়ের সেই সম্পর্ক। কিন্তু বছর তিনেক পেরোলেই ছবিটা বদলাতে থাকে। তখন সবে পাল্টাতে শুরু করেছে মেয়ের মনের জগতটা। হোক না ছোট, মন তো তারও আছে। সেই মন তার নিজের মতন। আধো চেতন আধো অবচেতন। আলোছায়ার লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে অবুঝ, নিষ্পাপ শিশুমনের গহীনে। সবকিছু বুঝে নিতে চায় সে, তার নিজের মতো করে। যা দেখে তাতেই কৌতুহল। এটা কী, ওটা কী?

এমন সময় ছোট্ট মেয়ের মনে অজান্তেই ছায়া ফেলে 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্স'। আচমকাই একদিন সে আবিষ্কার করে, বাবার পুরুষাঙ্গ আছে। তার নেই। কেন? অসীম কৌতুহল। সোজাসুজি মাকে জিজ্ঞেস করে বসে। বেচারি মা, কিই বা জবাব দেবে! শিশুর সরলতা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় মাকে।
এভাবেই মাকে চাপে ফেলে দিয়েছিলো সেই খুদে খোকা।
"কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমাকে?" একেবারে গূঢ় জন্মরহস্য জানতে চেয়ে খোকার প্রশ্ন। মায়ের হয়ে জবাবটা দিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং কবিগুরু। ছোট্ট ছানাকে বকাঝকা করেননি। এঁচড়ে পাকা, ডেঁপোও বলেননি। শুধু একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেন, এই যা।
"ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে
ছিলি আমার পুতুল খেলায়
প্রভাতে শিবপূজার বেলায়.."
এই না হলে বিশ্বকবি! ঠিক কোন বয়সে মেয়ের মা হওয়ার স্বপ্ন শুরু, তাও বলে রাখলেন। পুতুল খেলার বয়স থেকেই মেয়ের মনে ঘাপটি মেরে থাকে মা হওয়ার সুপ্ত বাসনা, কামনা। এরপরেও নিশ্চয়ই ইয়াংয়ের মতো নাক কুঁচকে বলবেন না, "বড্ড দুষ্টু ওই ফ্রয়েড। সবকিছুতেই আঁশটানি গন্ধ। যৌনতা খুঁজে পায়।"

ব্যাস, খেলা খতম। সব দোষ পড়ে মায়ের ঘাড়ে। খুকু তো রেগে আগুন। মা কেন তাকেও বাবার মতো একটা পুরুষাঙ্গ দেয়নি। রেগেমেগে মাকে বয়কট করে বসে সে। পুরোপুরি জেহাদ ঘোষণা খুকুর। মায়ের এত বড় অপরাধ! কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
অগত্যা কন্যার দলবদল। এবার মেয়ের সঙ্গী হলো বাবা। মাকে আর সে পাত্তাই দিতে চায় না।

"মনে পড়ে, মাকে ঘেঁষতেই দিতি না বাবার কাছে? গোটা বাবাটাই তোর। সবসময় চোখে-চোখে রাখতি বাবাকে। দুজনে পাশাপাশি বসে কথা বললেও তোর হিংসা হতো। তোকে রাগাতে, মা-বাবা তোকে দেখিয়েই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতো। ব্যাস, মাকে একধাক্কায় সরিয়ে বাবার কোলে চড়ে বসতি। বাবার ভাগিদার মানছি না মানবো না। মাঝেমধ্যেই বাবাকে শাসন করতি, 'মাম মামের সঙ্গে বেশি কথা বলবে নাতো।' মেয়ের এই শাসনের চোটে বাবা অস্থির। আর মা হেসে গড়াগড়ি।
মা তোকে একটু আদর করতে গেলেই কী আপত্তি। সবাই বলতো, এই নাহলে বাপের বেটি!"

এমনটাই হওয়ার কথা, বলছেন ফ্রয়েড সাহেব। পিতার গোটা স্নেহটাই কেড়ে নিতে চায় অবোধ শিশুমন।  তখন ছোট্ট মেয়ের অবচেতন মনে সবে ঘর বাঁধতে শুরু করেছে, যৌনপ্রবণতা। বয়স একটু একটু করে বাড়ে। গাঢ় হয় বাবা মেয়ের সম্পর্ক। তার যত আবদার বাবার কাছে।
বছর ছয়েকে পা দিলেই ফের বদলের পালা। মেয়ে ততদিনে বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝে ফেলেছে, মায়ের সঙ্গেই তার শরীরের মিল।
সেদিন থেকেই মায়ের গায়ের গন্ধ ফের টানতে শুরু করে খুকুকে। মায়ের কাছ ঘেঁষতে শুরু করে মেয়ে। শুরু করে মায়ের অনুকরণ। পাছে মায়ের ভালবাসা হারায়! মনের জগতে তখন শুরু অন্য এক খেলা। এভাবেই ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকে 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্স'- এর ছায়া। মায়ের মধ্যেই মেয়ে খুঁজে পায়  নিজেকে। সূচনা হয় মা মেয়ের দোস্তির। পাশাপাশি, মেয়ের মনে বিজ পোঁতা হয়ে যায় মেয়েলিপনার। পরবর্তী সময়ে যার থেকে বিকাশ নেয় মেয়ের নারীসত্তা।

তবে 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্স'- এর গোটা প্রক্রিয়াটা চলে কিন্তু ধাপে- ধাপে। তৈরি হয় যৌনমানসিকতা। সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো। কিন্তু তা ডিঙোতে গেলেই বিপদ। পা ফেলতে হবে প্রকৃতির শাসন মেনেই। ছোট্ট বয়সের সেই যৌন আকর্ষণ প্রকৃতিজাত। অবচেতন মনেই তার বাস। শিশুমনের ওই অবস্থাকে বলা হয় 'ফ্যালিক স্টেজ (phallic stage)'। যার মেয়াদ তিন থেকে ছয়, সাত বছর অবধি।
মা বাবার পাশাপাশি শোয়াতেও মেয়ের আপত্তি। ঝুপ করে সে নিজের জায়গা করে নেয় দুজনের মাঝখানে। বাবার একপাশে শুলেও চলবে না। ফ্রয়েডের কথায়, বাবার যৌনসঙ্গী হবে মা, মানতে নারাজ মেয়ে। ছোট্ট খুকু। শরীরে যৌনচেতনার ডাক আসতে তখনও খানিকটা দেরি। কিন্তু তাকে খেলিয়ে চলেছে এক অলক্ষ্য শক্তি। আর এই আকর্ষণ বিকর্ষণের গোটা খেলার নেপথ্য কারিগর কিন্তু মদনদেবই। মনের সেই আকর্ষণের প্রকাশও বিচিত্র। একে একে সেই ধাপগুলি পেরিয়ে চলা। এই ধাপগুলো পেরিয়ে চলার সময় গড়গড় হলেই, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

এদিকে ততদিনে মনের অতলে 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্সের' মোকাবিলায় কাজ শুরু করে দিয়েছে শরীরের ভেতরের ডিফেন্স মেকানিজম। আসলে গোটাটাই এক কেমিস্ট্রি। 'প্রাইমাল আইডি' এমনই এক উপাদান যা নিয়েই মানুষ জন্মায়। এই উপাদান ব্যক্তিত্ব তৈরির কাজ করে। আবার এই 'প্রাইমাল আইডি'র কারসাজিতেই মেয়ের হিংসুটেপনা। মায়ের থেকে বাবাকে ছিনতাই করার প্রবণতা।  এই প্রবণতা রুখতে প্রথমেই এগিয়ে আসে 'কনসাস মেমোরি'।
'ফ্যালিক স্টেজ'- এ পুরুষাঙ্গ না থাকার অতৃপ্তি থেকেই, মেয়ে ফের আশ্রয় খোঁজে তার মায়ের কাছেই। মনস্তত্ত্ববিদের মতে, এর মধ্যে এক বিশেষ ভূমিকা থাকে জন্মের পরেই মা- মেয়ের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার। সে নিজেকে চিনতে শেখে এক নারী হিসেবে। পরবতীর্তে সামিল হয় বৃহত্তর নারীসমাজের মূলস্রোতে। পা বাড়ায় অভিভাবক,  সমাজের দেখানো রাস্তায়। এমনকি তৈরি হয় এক নারীসুলভ সততা, আবেগ, স্বাভিমান। এরপর হরমোনের খেলা শুরু হলেই মনের যৌনতার খোলাখুলি প্রকাশ শরীরে। মা- বাবার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে বাবুঘাট।
"মনে আছে, একদিন তুই পুতুল খেলছিলি। পুতুলগুলির নামও দিয়েছিলি। কোনটা তোর ছেলে, আবার কোনটা মেয়ে। ভরা সংসার তোর। তোর গুছিয়ে সংসার করা দেখে তাজ্জব পিসিমা। জিজ্ঞেস করেছিলো, 'হ্যাঁরে খুকু, অনেক তো বড় হলি। বিয়েটা করবি কাকে?' তুই সোজা আঙুল তুলে বাবাকে দেখিয়ে দিয়েছিলি।"
তবে শিশুবয়সে জন্মানো এই প্রবণতা কি সত্যিই অবচেতন মনে, আজীবন বয়ে বেড়ায় মেয়েরা? মনস্তত্ত্ববিদরাও কিন্তু স্বীকার করেন, স্বামীর মধ্যে বাবার ছায়া খোঁজেন মেয়েরা। পুরুষ হিসেবে, বাবাই মেয়ের কাছে প্রথম 'রোল মডেল'।

কিন্তু 'ফ্যালিক কমপ্লেক্স'- এর ধাপগুলো পেরিয়ে আসার সময়, কোনও গড়গড় হলেই বিপদ। ফ্রয়েডের মতে, ভবিষ্যতে তার ফল ভুগতে পারে তরুণী। হতে পারে অস্থিরচিত্ত। মন বসাতে পারবে না পড়াশোনা বা অন্য কোনও কাজে। সবসময় কেমন যেন উদ্বেগে ভোগা। বাতিকগ্রস্ত। নতুন কোনও কিছুকে মেনে নিতে ঘোর আপত্তি। বয়স পূর্ণতার দিকে এগোলেও, খুঁত থেকে যায় মনের বিকাশে। কোথাও যেন থেমে যায়  মনের পূর্ণতা পাবার গতি।
পুরুষের থেকে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস কম। এরকমটাই বিশ্বাস করতেন ফ্রয়েড। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, 'ফ্যালিক কমপ্লেক্স'- এর প্রভাব তীব্র। তা কাটিয়ে উঠতে মেয়েদের বেগ পেতে হয়। আর এই কাজ করতে গিয়েই, মেয়েরা খানিকটা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে চিরকালের জন্য।

বড্ড ব্যালান্সড প্রকৃতির খেলা। মন, শরীর, যৌনতার ত্রিবেণী সঙ্গম। বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে তার ছন্দবিন্যাস। ধারাবাহিক পথচলা। মেয়ে থেকে মা হওয়ার পূর্ণতাপ্রাপ্তি।

তবে ফ্রয়েড বা ইয়াংয়ের  তত্ত্ব আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদদের খুশি করতে পারেনি। কারও মত, ওই তত্ত্ব শতাব্দী পুরনো যৌনতা লিঙ্গ বৈষম্যের পক্ষে। আবার অনেকে মনে করেন, নারীত্বকে খর্ব করার অপরাধ করেছেন ইয়াং, ফ্রয়েড দুজনেই। এই মনস্তত্ত্ববিদদের দাবি, সমীক্ষা বলে বাচ্চারা লিঙ্গ সচেতনতা শেখে অভিভাবকের দেখে। তারজন্য অতকিছু লাগে না।

( সৌজন্য সোহিনী মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী )
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours