ব্রহ্মচারী শুভ্র, রামকৃষ্ণ আশ্রম, কলকাতাঃ

শ্রীশ্রীমাও একবার গোপালদার এই আন্তরিকতার প্রশংসা করেছিলেন। সেদিন উদবোধনে কথা
প্রসঙ্গে গোপালদা শ্রীশ্রীমাকে বলেছিলেন যে মঠের প্রয়োজনে তাঁকে বাগানে খুব পরিশ্রম করতে হয়।
তরকারি খুব একটা কিনতে হয় না । কিন্তু নবাগত ব্রহ্মচারীরা এ বিষয়ে নিশ্চেষ্ট থাকেন। সব শুনে মা
বললেন – “ হ্যাঁ বাবা, তুমি সেকেলে লোক, তুমি তো আর ছেলেদের মতো থাকতে পারবে না । মঠও তো একটা
সংসার, খাওয়া দাওয়া তো আছে। তুমি থাকতে পারবে কেন, তাই দেখে থাক।“
মঠের দৈনন্দিন কার্য পরিচালনায় স্বামী প্রেমানন্দজীকে গোপালদা সর্বতোভাবে সাহায্য করতেন
আর বাবুরাম মহারাক অনুপস্থিত থাকলে স্বহস্তে টাকুর পূজা করতেন। পূজো তিনি খুব নিষ্ঠা সহকারে
করতেন। তাঁহার যত্নে তখন মঠের বাগান পূজার ফুল ও ভোগের ফল ও তরকারিতে পরিপূর্ণ থাকতো।
এছাড়াও তাঁর অন্যতম কার্য ছিল গোসেবা।
মঠে নবাগত ব্রহ্মচারীদের গোপালদার সাথে এসব কাজ করতে হতো। কিন্তু নবাগত অল্পবয়স্ক
ব্রহ্মচারীদের পক্ষে গোপালদার মতো জমিতে কাজ করবার অনভিজ্ঞতার দরূন অসুবিধা হতো। তারজন্য
গোপালদা তাদের মাঝে মাঝে ভৎর্সনা করতেন। কিন্তু একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে দেখিয়ে দিলেন যে
সর্বভুতে তিনিই বিদ্যমান। এই অনুভূতির পর গোপাল দার এই স্বভাবের আমূল পরিবর্তন হয়। তিনি বললেন
সর্বভূতে যখন তিনিই বিদ্যমান, তখন কাকে নিন্দা বা সমালোচনা করি। এই সংসার ঠাকুরের আর সবাই
তাঁরই সন্তান। এই মনোভাব নিয়েই তিনি পরবর্ত্তী জীবন কাটিয়ে গেছেন।
প্রাচীনপন্থী গোপালদার চা পানের ব্যাপারে বিরূদ্ধ মনোভাব ছিল। তিনি নিজেও চা পান করতেন না
আর অপরকেও নিষেধ করতেন। একদিন গোপালদা একজনকে বললেন “ ওরে চা খাসনি খাসনি, রক্ত হেগে
মরবি।“ প্রত্যুত্তরে ওই ব্যক্তি বলেন –“গোপালদা, যত ফোঁটা চা, তত ফোঁটা রক্ত।“ ব্যঙ্গ করে
গোপালদাও বললেন “খুব খা, খুব খা।“ সবাই হেঁসে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
তিনি রোজ গীতা পড়তেন ও সুন্দর হস্তাক্ষরে পঞ্চগীতা লিখে রেখেছিলেন। সত্যের প্রতিও তাঁর
গভীর অনুরাগ ছিল। অবশ্য তাঁর আরাধ্য শ্রীশ্রীঠাকুরের নিস্কলঙ্ক চরিত্রের মাঝেও কথা ও কার্যের
বিন্দুমাত্র অসামঞ্জস্য ছিলনা। নিত্যদিন শ্রীশ্রীঠাকুরের ঘনিষ্ট সেবা ও সাহচর্যের ফলে এই
সত্যনিষ্ঠা গোপালদার মনে গভীর ভাবে অঙ্কিত হয়েছিল। তিনি নিজে যেমন সত্যনিষ্ঠ ছিলেন মঠের
ব্রহ্মচারিদেরকেও তেমনি সত্যপরায়ণ হতে উৎসাহ দিতেন।
শরীর বৃদ্ধ হলেও মনে ছিল তাঁর অদম্য উৎসাহ। সেই মনবলেই তিনি কেদারনাথ থেকে কন্যাকুমারী
এবং দ্বারকা থেকে কামাখ্যা পর্যন্ত প্রধা প্রধান তীর্থস্থান গুলি দর্শন করেন। ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে তিনি
শ্রীশ্রীমাকে নিয়ে গয়াধামে যান। ১৮৯০-৯১ এর শীতকালে তিনি হরিদ্বার কুম্ভে যান। কোন্নগরের
নবাইচৈতন্য বাবুর সাথে ১৮৯৭ এর নভেম্বর মাসে রায়পুর যান ও পরে দক্ষিণ ভারতের প্রমুখ
তীর্থস্থানগুলি দর্শন করে ১৮৯৮ এর ২৩শে মার্চ স্বামী সুবোধানন্দ ও নির্মলানন্দের সাথে মঠে ফেরেন।
১৮৯৯ এর শেষে তিনি দার্জিলিং যান। ১৯০০ খৃষ্টাব্দে স্বামীজীর ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর কয়েকজন
গুজরাটী ভদ্রলোকের সাথে তিনি দ্বারকা যান ও পরের বছর ৭ই ফেব্রুয়ারী মঠে ফেরেন।
শেষ বয়সেও তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করতেন ও স্বাস্থ মোটামুটি ভালই ছিল। পরের মুখাপাক্ষী হওয়া
তাঁর পছন্দ ছিলনা ও শ্রীভগবান ও সেরূপ অনস্থায় তাঁকে খুব কম ফেলেছিলেন। কেউ নিকে থেকে তাঁর
সেবাদি করতে চাইলেও স্বাবলম্বী গোপালদা তাকে নিবৃত্ত করতেন। নিজের কাজ নিজে করাতেই ছিল তাঁর
তৃপ্তি। সঙ্গীতে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল ও বায়া তবলা বাজাতে তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন।
দেহত্যাগের কিছুকাল পূর্ব থেকে তিনি পেটের অসুখে ভুগছিলেন। এর প্রতিকারের অনেক চেষ্টা
করলেও রোগের বৃদ্ধি হওয়াতে তিনি একদিন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে কাতর ভাবে মুক্তির জন্য প্রার্থনা
করেন। ঠাকুরও তাঁর এই বৃদ্ধ সেবকের নিবেদন শুনেছিলেন। শোনা যায় শেষ অসুখের সময় তিনি
শ্রীশ্রীঠাকুরের অলৌকিক দর্শন লাভ করেন। সেদিন তিনি ঠাকুরকে গদা হাতে দেখেন। তিনি এর কারণ
জিজ্ঞাসা করলে ঠাকুর বলেন যে এবার তিনি গদাধররূপে আবির্ভুত। শ্রীশ্রীঠাকুর এবার সর্বপ্রকার

বিবাদ-বিচ্ছেদ দূর করতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন , সে ইঙ্গিতই হয়তো সেদিন গদাধর মূর্তিতে করেছিলেন।
এছাড়া ঠাকুরের পিতৃদত্ত নামও ছিল গদাধর।
অবশেষে শেষদিন আগত। স্বামী প্রেমানন্দজীর একখানি চিঠিতে এর ছোট ও প্রাণস্পর্শী বিবরণ
আছে।-- “২৪শে ডিসেম্বর ১৯০৯, মঙ্গলবার বেলা ৪:৩০ ঘটিকার সময় গোপালদা স্বধামে গমন করেছেন।
সামান্য জ্বর হয়েছিল মাত্র। কেহ ঠাওরাইতে পারে নাই যে, এত শীঘ্র তিনি দেহ রক্ষা করিবেন।
শেষসময়ের মুখকান্তি অতি সুন্দর।শ্রীশ্রীপ্রভুর ভক্তের লীলাই এক আশ্চর্য। সে সময়ে মতি ডাক্তার
উপস্থিত ছিল। লেবু দুধ খেলেন। মতিবাবুকে নমস্কার করে হাসিতে হাসিতে দেহত্যাগ।“
একাশি বছর বয়সে স্বামী অদ্বৈতানন্দ বাঞ্ছিতধামে চলে গেলেন , কিন্তু রেখে গেলেন পরবর্ত্তী
সন্ন্যাসী সঙ্ঘের জন্য একটি অনুকরণীয় আদর্শ জীবন।


                                                                          সমাপ্ত


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours