ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুরঃ 
   রূপেন্দ্রনাথ  পঞ্চদশী  তুলসীকে  যতই  দেখে  ততই  অবাক  হয়! তুলসী  রূপেন্দ্রকে  বোঝাতে  চেষ্টা  করে, তাঁর  মেয়েকে  যেন  জোর  করে  নিজের  গ্রামে  নিয়ে  যাওয়ার  চেষ্টা  না  করে! তাহলে  হিতে  বিপরীত  হবে, তার  বাবা  ভবতারন  গাঙ্গুলী  যেরকম  জেদী একগুঁয়ে  আর  নিষ্ঠুর  প্রকৃতির  মানুষ  , কাজীর  বিচারে  রূপেন্দ্র  মেয়ের  অধিকার  পেলেও  তাকে  জীবিত  পাবে না! তার  থেকে  অনিবার্য  নিয়তিকে  মেনে  নেওয়ায়  যুক্তিযুক্ত! তাই  তাঁর কন্যা  তাকেই  মা  বলে  জেনে  এসেছে  তার  মা  বলেই  মেনে  নাও! বলে  একটা  পুটলী  রূপেন্দ্রকে  দিল  তুলসী!তাতে  তার  দিদি  কুসুমমঞ্জরীর  গহনা  ছিল!
        রূপেন্দ্র  সেই  গহনা  নিতে  অস্বীকার  করে  বললেল, তার  দিদি  তাকে  দিয়েছেন! সেখানে  ফেরৎ  নেওয়ার  কোন  প্রশ্ন  নেই!
    
    তুলসী  পাল্টা  যুক্তি  দিল, রূপেন্দ্র  তাকে  স্ত্রীর  মর্য্যাদা  দিতে  অস্বীকার  করেছেন ! তাই  শালী  হয়ে  এই  করুনার  দান  নেবে  না!
রূপেন্দ্র  তুলসীর  দুটি হাত  নিজের  হাতে  তুলে  নিলেন! মিনতি করে  বললেন, " আমি  মনে  মনে  সন্ন্যাস  নিয়েছি! কিন্তু  তুমি  এগুলো  নিতে  অস্বীকার  করতে  পারবে  না তাহলে  তোমার  দিদি  কুসুমমঞ্জরী স্বর্গে  গিয়েও  শান্তি  পাবে না "
         এই  প্রথম  তুলসীকে  রূপমঞ্জরীর  'মা ' বলে  স্বীকার  করে নিল  রূপেন্দ্র! তুলসীর  কাছে  মিনতি  করে  বললেন, " তুলসী  কুসুমমঞ্জরী  শুধু  মেয়ের  জন্ম  দিয়েছে, মাতৃহীন  একরত্তি  মেয়েটাকে  তুমি  কোলে  তুলে  নিয়েছো,তার  বাবার  কথা  ভাবনি! তোমার  কাছে  আমি  চিরঋনী,  রূপমঞ্জরীর  মাতৃত্ব  স্বেচ্ছায়  স্বীকার  করে নিয়েছো তার  বিয়েতে  তুমিই  তাকে  এই  গহনা  দিয়ে  সাজিয়ে  শ্বশুর বাড়ী  পাঠাবে...মা  কর্তব্য  পালন  করবে!"
          তুলসীর  চোখে  জল ! নিচৃ  হয়ে  রূপেন্দ্রকে  প্রনাম  করল! রূপেন্দ্র  তার  দুই বাহুমূলে  ধরে  তুলে  তার  কপালে  এঁকে  দিলেন  প্রেম  চুম্বন! তুলসী  দু নয়ন  বন্ধ  করে  , আস্বাদ নিল এক অনির্বচনীয়  প্রেমানুভুতির!
          রূপেন্দ্র  ফরাসীডাঙার  ঘাট  থেকে  গঙ্গায়  নৌকায়  চলেছেন  নবদ্বীপের  পথে! নৌকা  থেকে নেমে  রাজপথ  বেয়ে  চলেছেন  পদব্রজে! হঠাৎ  একটি  গোড়ার  গাড়ী  এসে  থামল  তাঁর  পাশে! গাড়ীর পিছনে বসে  আছেন  একজন  সৌখিন  ব্যাক্তি!  তিনি  রূপেন্দ্র  উদ্দেশ্য  করে  বললেন," কোথায়  যাচ্ছেন  কোবরেজ  মশাই?"
রূপেন্দ্র  চিনতে  পারলেন! উলার  জমিদার  রসিকলাল! রূপেন্দ্র  ইতঃস্তত  করছিলেন  কারন  রসিকলালকে  তাঁর  খুব  পছন্দ  নয়  লোকটার  চরিত্রে  সব  বদগুন  আছে! তার  কাছেই  জানতে  পারলেন! বন্ধু  রায়  গুনাকর  ভারতচন্দ্র  আর  কৃষ্নচন্দ্রের  সভাকবি নন!
তাই  অনিচ্ছা সত্বেও  রসিকলালের  গাড়ী  করেই  রাজবাড়ী  পর্য্যন্ত  গেলেন!
         রাজ বাড়ীতে  এসেও  সমস্যায়  পড়লেন  রূপেন্দ্র! রাজা  কৃষ্নচন্দ্র  মুর্শিদাবাদ  গেছেন নবাবের  তলব  পেয়ে, কবে  ফিরবেন  ঠিক  নেই! অতিথি  শালায়  আশ্রয়  নিলেন! তাঁর  তত্বাবধানের দায়িত্ব  নিয়েছেন, কৃষ্নচন্দ্রের  বড়  ছেলে   শিবচন্দ্র  স্বয়ং! তিনি   রূপেন্দ্রকে  আশ্বস্হ  করলেন, যতদিন  মহারাজ  না  ফিরছেন  তিনি  বহাল তবিয়তে   অতিথিশালায় থাকতে  পারবেন!
         শিবচন্দ্র  রূপেন্দ্রকে  জানালেন, বড়  রানীমা   একবার  তাঁর  সাথে  দেখা করতে  চান! রূপেন্দ্র  সন্মত  হলে  তাঁকে  অন্দর মহলের  'প্রতীক্ষা - কক্ষে ' ! রাজা  কৃষ্নচন্দ্রের  দুই  স্ত্রী  বড়  রানী  না সন্তান  ছোট রানীর  সন্তান  শিবচন্দ্র!
           বড়  রানীমা  এসে  নমস্কার  করলেন  রূপেন্দ্রকে, প্রতি  নমস্কার  করলেন  তিনিও! বড়  রানী  রূপেন্দ্রর  সমবয়সী!  তাই  রূপেন্দ্র  তাঁর  প্রনাম  নেননা! রূপেন্দ্র তিন  বছর  পূর্বে  তাঁর চিকিৎসা  করেছিলেন! সেজন্য  শারিরীক  কুশল  জিঞ্জাসা  করলে  বড় রানী  জানালেন, এখন  অনেকটা  ভাল  আছেন! রূপেন্দ্র  পূর্বের  ওষুধ  বন্ধ  করার  পরামর্শ  দিলেন!পথ্য  অপরিবর্তিত  থাকবে!
           এরপর  রূপেন্দ্র  বন্ধু  ভারতচন্দ্রের  বিষয়টি  উত্থাপন  করলে! রানীমা  তাঁর  ভুল  ভাঙালেন  এবং  জানালেন, ভারতচন্দ্র  নিজেই  মানসিক  শান্তির  জন্য  দুরে  কোথাও  থাকতে  চাইছিলেন, মহারাজা  নিজেই  তাঁকে  মুলাজোড়  গ্রামখানি বার্ষিক  ছ'শো  টাকা রাজস্বের  বিনিময়ে  দান  করেন  সাথে  গৃহ নির্মানের  জন্য আরও  এক'শ  টাকা!
          বর্ধমানের  রাজা  তিলকচাঁদ  মূলাজোড়ের  পাশে  কাউগাছি  গ্রামে  কিছুদিন  ছিলেন! গ্রামখানি রাজমাতার  খুব  পছন্দ  হওয়ায়, তিনি  সেটি  ইজারা  নেওয়ার  জন্য  মনস্হির  করেন  এবং  নেন!
           বর্ধমান- রাজ  কবি  ভারতচন্দ্রের  উপর  প্রচন্ড  ক্ষুব্ধ  ছিলেন  ' বিদ্যাসুন্দর ' কাব্যের  জন্য! তাই  কবি  ভারতচন্দ্রের  মূলাজোড়ে  বাস  করা  কঠিন  হয়ে  পড়ে! তাই  নদিয়া  রাজের  পরামর্শে  কবি  এখন  নতুন গ্রামে  বাস  করছেন!
(চলবে)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours