শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার:
আমার
দুই মাঝবয়সী সহকর্মী কাল গভীর আলোচনা করছিলেন যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম
কিছুই জানে না, এদের কোন ইতিহাসবোধ নেই, ভূগোল সম্পর্কে ধারণা নেই,
ক্ষুদিরামের নাম শোনেনি ইত্যাদি। তাদের আলোচনা শেষ হ'ল এরা ফেসবুক আর
হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া কিছু জানে না।
বেশ মজা লাগছিল তাদের কথা শুনে।
যারা
আলোচনা করছিলেন তাদের প্রত্যেকের স্মার্টফোন আছে। প্রত্যেকের হোয়াটসঅ্যাপ ও
ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। কমবেশী তারা ব্যবহার করেন, সেটাও জানি।
যাহ'ক
বিষয় সেটা না। বিষয়টা হ'ল পরবর্তী প্রজন্মের না জানা। অনেক ভেবেচিন্তে
দেখলাম ওরা যদি না জানে তবে তার দায়টা কি ওদের? নাঃ, সেটা কিভাবে হয়?
জানাতে তো হবে! না জানালে, জানবে কিভাবে? আমরা, মানে যাদের জানানো উচিত, কি
জানিয়েছি ওদের? জানালেও কেন ওরা মনে রাখছে না?
ভেবে
দেখলাম দু'টি কারণ হতে পারে। এক, আমরা জানাই নি; দুই, আমাদের জানানোতে সেই
প্রাণ ছিল না যা ওদেরকে স্পর্শ করতে পারে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই
যে, স্বাধীনতার আবেগ আজ অনেকটাই ফিঁকে। আমাদের বাপ-ঠাকুরদারা দেশ স্বাধীন
হতে দেখেছিলেন, তাদের আবেগ আমাদের মধ্যে এসেছিল। তারা দেশভাগ দেখেছিলেন,
উদ্বাস্তু হয়েছিলেন। নতুন দেশে এসে বসতি ক'রে পাড়ার নাম দিয়েছিলেন
সুভাষকলোনি, দেশবন্ধু পাড়া, রাস্তার নাম হয়েছিল গান্ধী রোড। তাদের আবেগ,
মূল্যবোধ তারা প্রোথিত করতে পেরেছিলেন আমাদের মধ্যে। কিন্তু সঞ্চারিত সেই
আবেগকে আমরা কতটা নিয়ে যেতে পেরেছি? কতটা পরবর্তী প্রজন্মর মাঝে ছড়িয়ে
দিয়েছি?
ব্যক্তিগতভাবে
আমার মনে হয়, সব যুগেই সব ধরণের মানুষ থাকে। জানা-না জানাটা আপেক্ষিক
ব্যাপার। সামাজিক অবক্ষয়টাও, আমার কাছে, আপেক্ষিক। কোন এক সংখ্যার "দেশ"
পত্রিকায় সেকালের বাঙালীর নেশা সম্পর্কে পড়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল।
বঙ্কিমচন্দ্রের "বাবু" পড়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে সম্ভ্রম কি খুব
একটা জাগে? ইতিহাস ঘাটলে এরকম বহু নিদর্শন পাওয়া যাবে যা কখনই কাম্য ছিল
না। এরকম অনেককিছুই আজও কাম্য না। কিন্তু তাই বলে একটা প্রজন্মকে দাগিয়ে
দেওয়াতে কোনোরকম শ্লাঘা বোধ করি না।
আমাদের
পরবর্তী প্রজন্মের বহু ছেলেমেয়েকে জানি যারা অত্যন্ত মেধাবী, অনেক কিছু
সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তারা। ইতিহাস নিয়ে কিছু জানতে হ'লে আমি সবচেয়ে ভরসা করি
যার ওপর তার বয়স তিরিশও পেরোয় নি। বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত আমার এক ভাই
গবেষণার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায় মেতে রয়েছে। নিজের স্কুলে বহু ছেলেকে জানি
যারা অদ্ভুত সুন্দর আঁকে। এই কোচবিহার শহরের নাম করা কয়েকটি স্কুলের
ছাত্রছাত্রীদের দেখেছি যারা ইতিহাস ভূগোল গুলে খেয়েছে পনেরো বছর বয়স না
হতেই। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে একের পর এক আন্দোলন সম্পর্কে জানতে, তাঁদের গান
গেয়ে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে দেখছি সদ্য যুবককে। টেকনোলজিতে
এক্সপার্ট আমাদের বাড়ির কচিকাঁচারাই আমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা
শেখাচ্ছে, শেখাচ্ছে কিভাবে এল ই ডি টিভিতে চ্যানেল খুঁজতে হয় যদি ডিশ টিভি
কানেকশন থাকে। এরা রবীন্দ্রসঙ্গীতেও তদগত হয়, বিটলসেও হয়। ভরতনাট্যমের
পাশাপাশি জ্যাকসনের মুন ওয়াকে মোহিত হয়। জীনস টপও পড়ে, ঢিপঢিপ করে প্রণামও
করে। বাবার শরীর খারাপ হলে মা'কে বকুনি দিয়ে বিশ্রামে পাঠিয়ে নিজে রাত
জাগে, বন্ধুকে নিয়ে ডক্টরের কাছে খুঁটিনাটি সব জেনে নেয়।
যারা
এসব করে না, তারা কোন যুগেই করে নি। সেদিনও করেনি, আজও করে না। কিন্তু তার
জন্য একটা সামগ্রিক প্রজন্মকে এভাবে দোষ দেওয়াটা ঠিক না।
কথায়
কথায় আমরা বলি, আমাদের সময় এই ছিল ওই ছিল। প্রশ্ন জাগে সেটা থাকলে কি চলতো
আজও? পরিবর্তন শব্দটাই পৃথিবীতে একমাত্র শব্দ যা স্থির। তাই কি ছিল সেটা
কি খুব জরুরী? আর যা ছিল তা তো আমরাই নষ্ট করেছি স্বহস্তে। আমাদের বাপ
ঠাকুর্দার কয়েকটি করে সন্তান ছিল। আমাদের সবেধন নীলমণি একটি। আমাদের বাপ
ঠাকুর্দা আমাদের বিকেলে খেলতে পাঠাতেন, এখন আমরা নিজের সন্তানকে পড়তে
পাঠাই। আমাদের পাড়াতুতো দাদা দিদিরা আমাদের ভুল দেখলে বকতেন, আমরা আমাদের
সন্তানের ভুল দেখে কেউ বকলে তার ওপর চড়াও হই। স্কুলে স্যারের কাছে মার খেলে
ভয়ে থাকতাম বাড়িতে আবার বকুনি খেতে হবে, আমার সন্তানকে স্যার মারলে আমি
এখন থানাতেও যাই। যৌথ পরিবার ভেঙে তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান গাইতে
গাইতে আমি এই আমাদের পৃথিবী গড়ে ফেলেছি। আমি আরও আরামের জন্য
যেনতেনপ্রকারেণ টাকার পেছনে দৌড়চ্ছি। আমার সন্তান আমাকে কি দেখছে? মানুষ
নাকি মেশিন? ঠাকুরমার ঝুলির সেই বুড়ি ঠাকুমার সত্যিই বয়স হয়ে গেছে বলে তাকে
বিসর্জন দিয়ে আমাকে ড্যাড আর আমার স্ত্রীকে মম বলতে শেখাচ্ছি।
ওদের এসব না শেখালে ওরা কি শিখতো নিজেরা?
আমার মনে হয় পরবর্তী প্রজন্ম যা শিখছে, যা করছে সেটা আমাদেরই দেখানো, আমাদেরই শেখানো। অযথা ওদেরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই কোনও.....
(মতামত একান্তই ব্যক্তিগত)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours