মুসবা তিন্নি, ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:
নারী
অধিকারের সর্বপ্রথম প্রবক্তা ছিলেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। কতিপয়
ঐতিহাসিক তাঁকে ‘বিশ্বের প্রথম নারীবাদীদের অন্যতম’ আখ্যা দিয়েছেন। সপ্তম
শতাব্দীতে তিনি আরবদেশের নারীকে বিবাহ, তালাক এবং উত্তরাধিকারের যে অধিকার
প্রদান করেছিলেন, তাঁর সময়কালে বিশ্বের কোথাও নারীর এসব অধিকার ছিল না।
পরবর্তীতে
১৮৮০ সালে বৈশ্বিক আন্দোলন হিসেবে ফ্রান্সে, ১৮৯০ সালে যুক্তরাজ্যে এবং
১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদ শব্দটির প্রচলন হয়। নারীবাদ হলো নারী ও
পুরুষের মধ্যকার সমতার একটি মতবাদ, যাতে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তার
রোধে নারীদের সংগঠিত হওয়ার উপর এবং সামাজিক জীব হিসেবে সমঅধিকার ও
দায়িত্বের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের জন্য সমাজকে নিরাপদ আবাসস্থলে রূপান্তরিত
করার উপর গুরুত্ব দেয়। নারীবাদ মতাদর্শ হলো নারীরা রাজনৈতিক, সামাজিক,
লৈঙ্গিক, বৌদ্ধিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে।
নারীবাদের কর্মকান্ড বৃহৎ পরিসরে নারীদের অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে
পরিচালিত।
নারী যেখানে বৈষম্যের শিকার, পুরুষের
অধিনস্ত, সেখানে নারীবাদ এ অবস্থার পরিবর্তন সাধনে পরিচালিত। নারী
আন্দোলনকারীরা নারীর আইনগত অধিকার (চুক্তির অধিকার, সম্পত্তির অধিকার,
বৈবাহিক অধিকার, ভোটাধিকার), দৈহিক স্বাধীনতা ও অখন্ডতা রক্ষার অধিকার,
চলাফেরার স্বাধীনতা, প্রজনন অধিকার (যথেচ্ছা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার
করার অধিকার, সন্তানের সংখ্যা নির্ধারণের অধিকার, উন্নতমানের প্রসূতি
চিকিৎসা লাভের অধিকার) অর্জনের জন্য, পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক ও মানসিক
হয়রানি ও নিগ্রহ থেকে নারী ও কিশোরীর নিরাপত্তার জন্য; সরকার ও সরকারি
প্রতিষ্ঠানে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য, বেসরকারি খাতে
চাকরিক্ষেত্রে, ব্যবসা বানিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য; কর্মস্থলে
নারীর অধিকার, যার মধ্যে মাতৃত্ব ছুটি, সমান মজুরি ও বেতন প্রভৃতি
অন্তর্ভূক্ত; সকল মানবাধিকার লাভ করার সুযোগ নিশ্চিত করা, এবং শিক্ষার সকল
স্তরে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেয়। বস্তুত যেখানে নারীর
প্রতি বৈষম্য বিদ্যমান, নারী আন্দোলনকারীরা সেসব জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যের
প্রতি গুরুত্ব দেয়।
বাংলাদেশে নারীবাদ : বাংলাদেশ
তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য প্রথা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির
পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নারীরা পাশ্চাত্য নারীদের চেয়ে পরস্পর ভিন্ন এবং
পাশ্চাত্য নারীর অবয়ব বাংলাদেশী নারীদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং
বাংলাদেশী নারীদের জন্য প্রযোজ্যও নয়। পাশ্চাত্যকে যদি নারীবাদের
উৎপত্তিস্থল হিসেবে দাবি করা হয়; তবে বাংলাদেশে সহজাত নারীবাদের সৃষ্টি
হয়েছে, যা পাশ্চাত্যের নারীবাদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেগম রোকেয়া
সাখাওয়াত হোসেন মনে করতেন নারী সামাজিক জীব; নারীকে নিজের কথা নিজেকে
সমস্বরে বলতে হবে, অন্য কেউ নারীর হয়ে বলবে না।
রোকেয়া
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না এবং পশ্চিমা নারীবাদ সম্পর্কে সচেতন
ছিলেন না; শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিলো না। রোকেয়া
সাখাওয়াত হোসেন তার সুলতানার স্বপ্ন (১৯২৪) বইয়ে নারী পরিচালিত
বৈচিত্র্যপূর্ণ, সমতাভিত্তিক কাল্পনিক নারীবিশ্বের চিত্র তুলে ধরেছেন, যা
হবে শোষণ থেকে মুক্ত। অস্তিত্বের জন্য সুলতানার সংগ্রাম এবং নারীমুক্তির
জন্য তার কাজ প্রভৃতি ছিলো নারীবাদের উদাহরণ। রোকেয়া তার লেখনীর মধ্য
দিয়ে সমাজের কুসংস্কার, অবরোধ প্রথার অতিরিক্ত প্রভাব, ধর্মীয়
রক্ষণশীলতা, নারী শিক্ষা, নারীর প্রতি সামাজিক অবমাননা, নারীর অধিকার এবং
নারী জাগরণের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বাল্যবিবাহ ও
বহুবিবাহ প্রথার বিরোধিতা করেছেন।
কিন্তু বর্তমানে
বাংলাদেশের নারীবাদের ভিন্ন চিত্র দেখা যায়, কেবল একজন প্রভশালী নারীকে
কোনো পুরুষ কটুক্তি করেছে কিনা তখন বাকি নারীবাদীরা সোচ্চার হয়ে যায় এর
প্রতিবাদ করতে। কিন্তু সমাজে অনান্য শ্রেণীর অবহেলিত নারীদের যখন পুরুষেরা
কুকুরের মতো কামড়ে ছিড়ে খায়,ধর্ষণ করা হয়,এসিড ছোঁড়া হয়,গণপিটুণি দিয়ে
হত্যা করা হয় আরো নানা প্রকার নির্মম নির্যাতন করা হয় তখন এই সমস্ত
নারীবাদীরা নির্বিকার চেয়ে থাকে, তাদের কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না । এরা
নাকি নারীবাদী, যারা সমাজের প্রভাবশালী পুরুষদের কাছে অর্থের জন্য
,নাম,পরিচয়ের জন্য চুপিসারে বিছানা শেয়ার করতে দ্বিধা করেনা । এবং তারাই
পরবর্তিতে দালালে পরিণত হয়ে অন্য নারীদের অবাধ যৌণাচার পাপ নয় একধরণের আর্ট
বলে প্রভাবিত করতে থাকে । বাংলাদেশে কিছু নারীবাদ মহিলা রয়েছে যারা
নারীদের বদনাম হওয়া সয়ে যেতে পারে কিন্তু ফায়দা দাতা কোনো প্রভাবশালী পুরুষ
যদি একজন নারীর দ্বারা কলঙ্কিত হয় তাহলেই হয়েছে ,নানা প্রকার কথা ইনিয়ে
,বিনিয়ে বলে অন্যায়কারী পুরুষটির পক্ষপাতিত্ত করে। এরা কি আসলেই নারীবাদী?
নাকি নারী হয়ে নারীর শত্রু?
যদিও পাশ্চাত্যের
দ্বিতীয় ধারার নারীবাদ নারীমুক্তি এবং নারী আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের
নারীবাদী সক্রিয় কর্মীরা নিজেদের নারী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা
করেছিলো। তবে বাংলাদেশে নারী মুক্তির পরিবর্তে নারী আন্দোলনের প্রতি
প্রাধান্যে বেশি, তার কারণ হচ্ছে এ দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং তৃতীয়
ধারার নারীবাদ এ অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ তৃতীয় ধারা বিভিন্ন
অঞ্চল, শ্রেণি, দেশ জাতি ও সংস্কৃতির নারীদের উদ্বেগ ও স্বার্থের বিভিন্নতা
স্বীকার করে। সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন পাশ্চাত্যের নারীবাদ
দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে; কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের নারীবাদীরা
বাংলাদেশের পরিস্থিতির নিরিখে সর্বোত্তম উপায় অবলম্বন করে নারী পুরুষের
অবাধ মেলামেশা ও স্বাধীন চলাফেরার দিকে বেশি ধাবমান। এখানে নারীর মূল
অধিকার,পারিবারিক,সামাজিক অধিকার ,নারীর সম্মান,নারী শিক্ষা, নারীর প্রতি
অত্যাচার ,অন্যায় রোধে কাজ করেনা এখনকার নারীবাদীরা। পাশ্চাত্য থেকে কেবল
সেখানের অপকালচার , অপকৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাই শেখাচ্ছে ও ছড়াচ্ছে
বর্তমান নারীবাদ। এরা বেগম রোকেয়ার দেখিয়ে যাওয়া পথে চলে না । এরা বেগম
রোকেয়াকে নিয়ে একটি দিন দিবস হিসেবে পালন করে , একটি দিন তার জীবন নিয়ে
আলোচনা করে , আর বাকি দিনগুলো তারা ভুলে যায় তার সব শিক্ষা, তার আদর্শের
কথা।
বর্তমানে নারীবাদীর নাম করে অসভ্যতা করে
বেড়াচ্ছে ! এরা মনে করে নারীবাদ বলতে কেবল নিজের ইচ্ছা মত সব করা ! হোক তা
অসভ্যতা, অভদ্রতা কিংবা অশালীনতা!!! ধর্ম বা সমাজের কথা এখানে নাই বা
বললাম। আসলেই কি নারীবাদ এগুলোকে বলে? আপনারা কি আদৌ জানেন নারীবাদী কাকে
বলে? নাকি শুধু নিজের মন মতো সবকিছু করার ধান্দা এটা? যে নারীরা ঘরের
মানুষের প্রিয় হয়ে উঠতে পারেনা, বর্তমানে সেই নারীরাই সমাজের নারীবাদী।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী জাগরণের পথিকৃৎ একজন স্বামীপ্রিয়া নারী
ছিলেন। কিন্তু বর্তমানের নারীবাদী নারীরা প্রচন্ড স্বার্থপর, ব্যক্তি
আক্রোশে বিশ্বাসী এবং ক্ষুদ্রতর স্বার্থে যেকোনো পক্ষালম্বন করতে পারেন ।
বাংলার নারীদের আলোতে এনেছেন যারা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুলতানা
রাজিয়া, সুফিয়া কামালেরদের মতো লেখিকারা এখন আর এদেশে জন্ম নেয়না । বরং
স্বাধীনতার নামে স্বৈরাচারিতা করে বর্তমান নারীবাদীতা নারীদের মুক্তি না
দিয়ে, বিভ্রান্ত সমালোচিত এবং গৃহবন্ধি করতেই সাহায্য করে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours