দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:


কবি বলেছেন, মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে! সেটা কোথায়? সেটা অবশ্যই গ্রামে। আমাদের মতো ছোট ছোট গাঁ ঘর!
এক্ষেত্রে গাঁয়ের নামটি বড়শাল! সে তো আজ তারাপীঠের দৌলতে সবাই জানে! কিন্তু এক সময় প্রত্যন্ত ছিল এই গ্রাম। তবে খ্যাতি ছিল।  গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন মন্দির। একটি ক্লাব বড়শাল বান্ধব সমিতি। গ্রামের ষষ্ঠী তলায় আছে পারিজাত পুষ্পের গাছ। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন! স্বর্গের পারিজাত। সাদা পারিজাত পুষ্পে ছেয়ে থাকে ষষ্ঠীর থানের উপরে। কথিত, মলুটি থেকে তারাপীঠ  যাওয়ার পথে এই থানেই বসতেন তারামা সাধক বামাখ্যাপা!  গ্রামের ক্লাব ছাড়াও আছে দক্ষিণা সংঘ। যারা কালী পূজা করে। আর আছে আমরা যুবক বৃন্দের দল যারা বারোয়ারি দুর্গা পূজা করে। প্রাচীন গ্রাম রাণী ভবানী প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণা কালী মন্দির আছে। বেশ কয়েকটি পারিবারিক দুর্গা পুজো আছে। বাড়ুজ্জ্য, ভটচায, চাটুজ্জে, মুখুজ্জে বাড়ির দুর্গা পুজো! দেবীর কোনটিতে ডাকের সাজ। আবার কোনটায় মাটির সাজ!  এই সময়টা  পুনর্মিলনের ! গ্রামের বাইরে যারা থাকেন এবং গ্রামের মেয়ে জামাই আত্মীয় স্বজনে চাঁদের হাট বসে।  পুজো চারদিন বারোয়ারি পুজোয় চলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আবার অন্যদিকে বাড়ির কালিপুজোয় দক্ষিণা সংঘে হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাজি পোড়ানো। বাড়ির পুজোয় পারিবারিক অনুষ্ঠান! সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা বলতে গেলে, প্রিয়াঙ্কা মুখোপাধ্যায়ের "যাদৃশী ভাবনা"র কথা বলতেই হয়।

এতো এখন কার ইতিহাস। আগে গ্রামের পরিচিতি ছিল  ঐতিহাসিক সামাজিক যাত্রা পালা, থিয়েটারে।  গ্রামের অভয় মুখোপাধ্যায় এঁকে ছিলেন সিন।  আগে জানবো গ্রামের নাম বড়শাল কেন? গ্রামের প্রয়াত ব্যক্তি সুধাকর মুখোপাধ্যায় লিখে গেছেন গ্রামের জন্মের ইতিবৃত্তান্ত! আগে এলাকায় আখের চাষ হতো। বসতো বড় বড় শাল বসতো। আর ইয়াব্বড়ো কড়াইয়ে তৈরি হতো এখোগুড়!
এর পর আসি গ্রামের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে। যেখানে লুকিয়ে আছে গ্রামের হৃদস্পন্দন! আজ হয়তো সেই সব অমর কুশীলবদের অনেকেই নেই। আবার আছেন গ্রামের ইতিহাসে। লোকমুখে!

বড়শালের মানুষের কাছে যাত্রা ছিল প্রাণ। একটা বাড়ি খুঁজে পাওয়া ছিল ভার যে বাড়ি থেকে কেউ অভিনয় করেনি। পুকুরে মাছ ধরা হত। থাকা খাওয়া, রান্না বান্না। দুর্গাপুজোয় এতটা হত না। পুরুষ অভিনেতারা থাকত ক্লাবে। মহিলারা দুলু চাটুজ্যের বাড়িতে। তাদের বাইরের ঘরটা ছেড়ে দেওয়া হত। কনসার্ট, ড্রেসার এবং পেন্টাররা তিনদিন ধরে বড়শালে থাকত, খেত। বাড়ি বাড়ি ঘুরে চৌকি জোগাড় করে তৈরী হত স্টেজ। রেল থেকে পেট্রোল এক্স পেঁচানো লাইট। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওরফে লালু মুখুজ্যে ছাড়া ওই ডে লাইট জ্বালাবার কোন লোক ছিল না গ্রামে। সে গফুর ডাকাতের অভিনয় হোক বা ‘একটি পয়সা’ যাত্রাপালার বদ্রী প্রসাদ হোক, যখনই তাঁর নজরে পড়ত আলোর ঘাটতি, অভিনয় করতে করতে দুবার পাম্প দিয়ে দিতেন। মুখে সংলাপ চলছে—মঞ্চের মেঝেতে হ্যাজাক নামিয়ে ‘কক কক’ করে দুহাতে সমানে পাম্প চলছে। হিন্দী ভাষী বদ্রী প্রসাদ সংলাপের ফাঁকে ঝুলন্ত পেট্রোম্যাক্সের হ্যাজাকে পাম্প দিলে দর্শকের কোন আপত্তি ছিল না। যা হত যাত্রার স্বার্থে। যাত্রার স্বার্থেই অমৃত শেখর মুখোপাধ্যায় ওরফে লারু মুখুজ্যে এবং দুলু চাটুজ্যে জিয়াগঞ্জ যেতেন বনমালী পেন্টারকে বায়না করতে। অমৃত শেখর মুখোপাধ্যায়কে রাজার অভিনয়ে মানাত বেশ। আর অভিনয়ও করতেন খুব সুন্দর।

তখন প্রথম দিকে গ্রামের পুরুষরা দাড়ি কামিয়ে মহিলার অভিনয় করতেন। অভয়াপদ ভট্টাচার্য, নেপাল মণ্ডল অন্যতম। 

কেউ পিছিয়ে নেই। দুলু চাটুজ্যের ছেলে অশোক ওরফে মদন চট্টোপাধ্যায় আর শ্যাম মুখুজ্জ্যের ছেলে শান্তনু মুখোপাধ্যায় ওরফে খোকন নায়ক থেকে খলনায়ক, ভাঁড় সমস্ত ধরণের অভিনয়ে তাদের পারদর্শিতা দেখে মুগ্ধ হয় নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। এমন এক দৃশ্যে ‘মদন’ মরা সেজেছে। বাঁশের চাঙে বাঁধা তাঁর মরদেহ। কেঁদে গড়াগড়ি দিচ্ছে খোকন এবং অন্যান্যরা। আবার সৎকার্যের জন্য চাঁদাও তোলা হচ্ছে। এভাবে বাঁড়ুজ্যে বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে অর্থ জোগাড় করা হত যাত্রার জন্য। মঞ্চের বাইরেও এরা অভিনয় করে মানুষকে মুগ্ধ করেছে জাত অভিনেতাদের মত। তখন নতুন জামাইদের কাছে চাঁদা নেওয়ার একটা চল ছিল। গোটা রাত মেয়ের বাড়িতে খাটা খাটুনি, বরযাত্রীর সেবা ফরমাইশ খাটার পর নতুন বরের কাছে চাঁদা। সেখানেও অস্ত্র ছিল বাক চাতুর্যতা আর তুখোড় অভিনয়। মঞ্চে লিপিবদ্ধ সংলাপ ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আওড়ে যেতে হয়। এখানে তাৎক্ষণিক সংলাপে অপরিচিত লোকের কাছে টাকা আদায়।

একবার তরণী সেন বধ নাটকে তরণীর ভূমিকায় গ্রামের বংশীধর মুখোপাধ্যায়। মঞ্চে তরণী সেন বধের দৃশ্যে বংশীধর মুখোপাধ্যায়ের মা স্টেজে উঠে হাত পা ছুড়ে কান্না জুড়ে দেন --  ওগো আমার ছেলেকে মেরে ফেললে গো!  পঞ্চানন মুখোপাধ্যায় যখন শ্রী রাম চন্দ্রের ভূমিকায়, তখন গ্রামের সমস্ত মহিলারা মাথায় হাত ঠেকান। আবার কমেডির সিনে সূর্যকান্ত ভট্টাচার্য্য বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে হাসিয়ে পেটের খিল ধরিয়ে দিতেন।  তাঁর সেই ‘গান্দার মাকে, গান্দার মাও’ ডাক বেশ সাড়া  ফেলেছিল গোটা গ্রামে। বাঙাল মেয়ে মানুষের গলায় বিকাশ চাটুজ্যে বলে উঠলেনঃ  “মানুসডা যে সেই হাত সক্কালে, পান্তা মুহে দিয়া চইলা গেল,  এহেন ফিরে আওনার নামটা নাই।  থাকত আজ আমার গান্দার বাপটা, মজাডা টের পাইয়া দিতাম। দেহি মুরগিগুলা খুপরায় ঢুকল কিনা, দেহি”।  বাগদত্তার এই দৃশ্যে দর্শক তখন মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। সেটা প্রায় পাঁচ মিনিটেরও বেশী। 

দুলু চাটুজ্যে গ্রীন রুমে পরের অভিনেতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, এখন কাউকে পাঠিও না। কারন দর্শকের হাসির রোলে কেউ কোন  অভিনেতার কথা শুনতে পাবে না। অতএব মিউজিক হোক। 

সাজঘরের গল্প কম আকর্ষনীয় ছিল না। যাত্রার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করতেন দুলু চাটুজ্যে। কনসার্ট বসে গেছে। তিন বারের বেলায় ফাইনাল কনসার্ট পড়ার পর যাত্রা শুরু হবে। মদন আর খোকন সাজ ঘরে ঢুকে দেখে, তাদের রাজকীয় পোশাক বেদখল। প্রশান্ত  (প্রয়াত)চট্টোপাধ্যায় আর টোটোন মুখোপাধ্যায় দুজনেই সৈন্য। সৈন্যের ভূমিকায় --শুধু হুজুর। তারা রয়্যাল ড্রেস পরে বসে আছে। সাজ কৈ?  খোকন,  মদনকে বলছে, আমাদের সৈন্য মারতে হবে। প্রশান্ত দাঁত মুখ খিচিয়ে বলে উঠল,  একেবারে বিরাট অভিনেতা!! তারা পোশাক কিছুতেই খুলবে না। 

শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের ফটকে মিত্তির চরিত্র ছাড়াও সাজানো বাগানে ক্ল্যাসিক টাচ পাওয়ায় যায় বাঞ্ছারামের চরিত্রে। এই চরিত্রে কি অনবদ্য অভিনয় করেন শান্তনু ওরফে খোকন মুখুজ্জ্যে। বৃদ্ধ জবু থবু গোটামুখে পাকা দাড়ি, চোখের কোনে পিচুটি সব মিলে বাঞ্ছারামের কি সুন্দর সংলাপঃ বড় কত্তা একডা কাতমিরি শাল পেলে বড় ভাল হতো। এই অভিনয়ের পর স্বয়ং অভিনেতার চোখে জল এসে গেছিল।   ‘অচল পয়সা’ দুবার হয়েছিল। তার মধ্যে একবার করেছিলেন প্রদীপ চাটুজ্যে। ক্ষণজন্মা শিল্পী ছিলেন এই প্রদীপ চাটুজ্যে। ট্রাজিক নায়কের চরিত্রে তাঁর বিকল্প কোন দিন পাওয়া যায় নি। একইভাবে ট্র্যাজেডির নায়িকা হিসেবে শবাসনা মুখোপাধ্যায়ের নাম আজও গ্রামের লোকের মুখে মুখে ফেরে।

' বাগদত্তা’ আর ‘উপেক্ষিতা’য় দুটোতেই অভিনয় করেন বেলা চট্টোপাধ্যায়। যাত্রাতে দুটো রাস্তা থাকত। এক দিকে প্রবেশ। আরেকদিকে নিষ্ক্রমণ।  গ্রীন রুম থেকে ছুটে আসা সে দৃশ্য রোমকূপে শিহরণ জাগানো।  সামাজিক যাত্রা পালা ‘কয়েদী’তে উল্কার অভিনয় করেছিলেন বেলা চাটুজ্যে।  এই নাটকে অভিনয়ের পর বাড়িতে ফিরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন বেলারানি চাটুজ্যে।  

গোটা গ্রাম ছিল নাটুকে। ছোট্ট কলেবরে সবার কথা বল সম্ভব নয়। তবে অজিত চট্টোপাধ্যায় ও বেলা চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলতেই হয়। দ্বিতীয় জন আজও গ্রামের এই ধারাকে বুকে আগলে রেখেছে।  গ্রামের মেয়ে ও বৌদের নিয়ে নাটক করিয়ে আজও অতীতকে আড়াল করে রাখা পর্দাকে প্রাণপণে দুহাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে চলেছেন!!! আর একেই বলে চরৈবতি! এগিয়ে যাও!!

(ছবি: বিধবার অভিনয়ে শ্রাবণী মজুমদার সঙ্গে পুতুল ভট্টাচার্য)
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours