ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুরঃ সময়টা ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দ পলাশীর যুদ্ধের ন'বছর আগে তৎকালীন বর্ধমানভুক্তির একটি অখ্যাত গন্ডগ্রাম সোঁয়ায়-এ নিজের পিতৃ-ভুমিতে প্রথম পদার্পন ভারতভুখন্ডে 'বিদ্যালঙ্কার ' উপাধিতে ভূষিতা প্রথম মহিলা হটী ওরফে রূপমঞ্জরী বন্দোপাধ্যায়, অষ্টাদশ শতকের ' নারী আন্দোলনের ' পথিকৃত !
অক্ষয় তৃতীয়ার পূন্যলগ্নে দামোদরের ঘাটে নৌকা এসে থামলে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে তিন বছর বয়সী ছোট্ট হটী তার বাবার হাত ধরে নৌকা থেকে নামল তাদের পিছনে সাদা থান পরিহিতা সদ্যবিধবা যুবতী মালতী! ঘনশ্যাম সার্বভৌমের বিধবা পত্নী! দামোদরের ঘাটে তাঁদের প্রথম দেখেন গ্রামের জমিদার তারাপ্রসন্ন ভাদুড়ী! তিনি তাঁর নাতি শুভা প্রসন্নকে নিয়ে দামোদরের ঘাটে পূন্যস্নান করছিলেন!
রূপেন্দ্রকে দেখে প্রথমে অবাক হলেন তারাপ্রসন্ন! দীর্ঘ ছ'বছর পর গ্রামে ফিরল সে! সাথে বালিকা আর সাদা থান পরিহিতা নিরাভরনা বিধবা যুবতীটি কে?
রূপেন্দ্র নৌকা থেকে নেমেই তারাপ্রসন্নকে দেখে কুশল বিনিময় করে! তাঁর পরিবারের কুশল জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, ভাদুড়ী মশাই লোকান্তরিত হয়েছেন ! শুনে রূপেন্দ্র হতাশ হলেন! তিনি নিশ্চিত ছিলেন, 'নারী প্রসারে' নদীয়ারাজ, বর্ধমান রাজ, পুরীর গোবর্ধনমঠের শঙ্করাচার্যে বা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সমর্থন না পেলেও সোঁয়াই গ্রামের উদার মনষ্ক জমিদার ভাদুড়ী মশায়ের পূর্ন সহযোগীতা পেতেন! কিন্তু সে আশাটাও নিরাশার অন্ধকারে ঢেকে গেল!
রূপেন্দ্র ভাবতে লাগলেন, কুসংস্কারের বিরূদ্ধে বিদ্রোহে কে হবে তাঁর সহায়! বর্তমান জমিদার তারাপ্রসন্ন নির্বিরোধী এবং প্রাচীন পন্হী!
তারা প্রসন্নর ডাকে রূপেন্দ্রর ভাবনায় ছেদ পড়ল! " চলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলাপ না করাই যুক্তি সঙ্গত! নানা লোকে নানা কথা বলতে পারে! "তা রূপেন্দ্র, এখন উঠবে কোথায়? তোমার ঘরখানিতো এখন বাসের উপযুক্ত নেই?" বললেল, তারাপ্রসন্ন!
রূপেন্দ্রকে নিরব থাকতে দেখে পুনরায় তিনি বললেন, " তোমার ঘরখানি যতদিন না বাসের উপযুক্ত হচ্ছে ততদিন আমার বাড়ীতেই আশ্রয় নাও "
রূপেন্দ্র বললেন ," তারা আগে আমি পিতৃপুরুষের ভিটেতে মাথা ঠেকিয়ে তারপর তোমার বাড়ী যাবো "
তারাপ্রসন্নের পালকিতে মালতি ,হটী আর তারাপ্রসন্নের পুত্র শুভা প্রসন্ন জমিদার বাড়ীতে গেল! তারাপ্রসন্ন আর রূপেদ্র পদব্রজে রূপেন্দ্রর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন, গ্রামের নবা নামে এক যুবক রূপেন্দ্রর বাক্স প্যাটরা নিয়ে সাথে যেতে লাগল!
পালকী একটু এগিয়ে যেতে ই রূপেন্দ্রকে তারাপ্রসন্ন জিজ্ঞাসা করলেন," অগ্রপশ্চাৎ ভেবে সিদ্ধান্তটা নিয়েছো তো ? সমাজ তোমার সাথে বৌঠানের একসাথে থাকাটা মেনে নেবে না "
রূপেন্দ্র বিস্মিত হ'ল " আমরা তো১ অন্যায় কিছু করছি না আমার নিজের বৌদি যদি বিধবা হতেন, আমি তাড়িয়ে দিতাম! আর তাছাড়া, উনি অসামান্য পন্ডিত ঘনশ্যাম সার্বভৌমের স্ত্রী , তিনি মৃত্যুকালে বৌঠানকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছেন, ওনার সাতকূলে কেউ নেই ! জগন্নাথ তর্কপঞ্চানের আশ্রয়ে উনি থাকবেন না, কারন উনি মনে করেন, তাঁর স্বামীর মৃত্যুর জন্য উনিও দায়ী!তাই বৌঠানের প্রচন্ড অভিমান জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের উপর! আমি বিপত্নীক, একটি মাতৃহারা শিশুকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছি! এথানে পিসিমা নেই, কাত্যায়নী নেই! দুজনেই আমরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল ! আমি মালতীকে যোগাবো আশ্রয় , আহার্য , লজ্জানিবারনের বস্ত্র আর নিরাপত্তা! বিনিময়ে সে আমার সংসার সামলাবে, আমার সন্তানের পরিচর্চা করবে! সন্ধ্যাবেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালাবে!এতে আপত্তির কি আছে? আর আপত্তি করলেও আমি শুনবো না!তার জন্য সমাজ যদি আমাকে আমাকে সমাজচ্যুত করে একঘরে করে শাস্তি দেয়! তাও আমি আমার সিদ্ধান্ত বদল করবো না!"
(চলবে)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours