মুজতবা আল মামুন, সিনিয়র জার্নালিস্ট,  কলকাতা:

কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া কি বিপন্নতার মুখে ?
বইপাড়ার কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে তেমনই মনে হল। এমনিতেই 'ই-বুক'এর কারণে বইপাড়ার বিক্রিতে কিছুটা বিক্রি কমেছে। তারপর এসেছে কিছু অনলাইন সংস্থা,  যারা উচ্চহারে কমিশন দিয়ে বাড়িতে কাঙ্খিত বইটি পৌঁছে দিচ্ছে। সেই কমিশন বইপাড়ার কমিশনের চেয়ে অনেক বেশি,  ৪০ শতাংশ। কলেজ স্ট্রিট দেয় ২০ শতাংশ। ফলে ক্রেতাদের একটা অংশ অনলাইনে বই আনিয়ে নিচ্ছে। 
প্রায় ৪০ বছর বইপাড়ার ফুটপাথের স্টলে ব্যবসা করছেন নিতাই রায়।  তিনি বিক্রি করেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বই। তাঁর গলায় আক্ষেপের সুর। বললেন,  এখন হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। পড়ুয়ারা অনেক অ্যাডভান্স। তারা নেট সার্চ করে নতুন নতুন বইয়ের সন্ধান পাচ্ছে। কমিশনও বেশি পাচ্ছে।  বইপাড়ার কাছাকাছি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এলাকায় আসছে, আমাদের ডিঙিয়ে যাতায়াত করছে। কিন্তু বই কিনছে অনলাইনে।
 
ষাটোর্ধ হাফিজ আলিরও পাঠ্যবইয়ের দু পুরুষের ব্যবসা। এক সময় রমরমিয়ে চলেছে। ফুটপাথে বই বেচে জমি কিনেছেন। মাথা গোঁজার ঠাই করেছেন। সম্প্রতি শেড দেওয়া স্টল পেয়েছেন। কিন্তু সেই বিক্রি আর নেই। দুই ছেলে উপায়-রোজগার করে বলে চলে যাচ্ছে। তবে ছেলেরা কেউ বই ব্যবসায় আসতে চাইছে না। বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা হাফিজ আলির। কোন বিষয়ের ওপর কোন লেখকের বই ভালো,  তা তাঁর নখদর্পণে। জানালেন,  ছেলেমেয়েরা সে সব বই নেড়েচেড়ে দেখে। ৪০ শতাংশ কমিশন দিতে পারবো কিনা জানতে চায়। অক্ষমতার কথা জানালে,  তারা মুখের ওপর বলে,  তাহলে অনলাইনে আনিয়ে নেব। 

পাঠ্যবইয়ের বাইরে আছে মূলত সাহিত্যের বই। বাড়ির মহিলারা তো বটেই,  পুরুষরাও একদা সাহিত্য পাঠের সময় বার করে নিতেন। এখন তাঁদের সময় নেই। দুপুর এবং সন্ধেবেলা টিভি সিরিয়ালে ঢুকে পড়েন। একটা বইয়ের দামে এক মাসের টিভি  সিরিয়াল দেখার খরচ।কোন দুঃখে তাঁরা বই কিনে পড়বেন ?  কলেজ স্ট্রিটের এক নামি প্রকাশক,  যিনি মূলত সাহিত্যনির্ভর বইয়ের ব্যবসা করে আসছেন,  জানালেন, তাঁদেরও বিক্রি কমেছে। কারণ হিসেবে বয়স্কদের টিভি আশক্তি এবং নতুন প্রজন্মের মারাত্মক রকমের কেরিয়ার-প্রত্যাশাকেই শণাক্ত করলেন। তিনি এও জানালেন,  এখন বইয়ের নাম দিয়ে সার্চ করলে পুরো বই স্কিনে আলে আসছে। যাঁদের সাহিত্যপ্রীতি আছে,  তাঁদের অনেকে অনস্ক্রিন পড়ে নিচ্ছেন। 

জানতে চাই, হাতে বই নিয়ে ফড়ার একটা সুখ আছে। পড়ার পাশাপাশি,  নতুন বইয়ের পাতার গন্ধ নেওয়ার একটা আমেজ আছে। স্ক্রিনের দৃশ্যমান পাতায় কি তা মিলবে ?  প্রকাশক জানালেন,  সেটা মেলে না বলেই এখনও ছাপা বইয়ের ব্যবসাটা টিকে আছে। তিনি জানালেন, পিডিএফ ওয়েবসাইটগুলো আমাদের  জনপ্রিয় বইয়ের পিডিএফ রাইট কেনে বটে। তারা হয়তো পাঁচটা বইয়ের দামে পিডিএফ-স্বত্ব কিনলো, সেই বই দেড়শো পাঠক স্ক্রিনে পড়ে নিলেন। তাতে  ১৪৫ টা সেই বইয়ের বিক্রি কমলো। এটা তো লোকসান। তবু পিডিএফস্বত্ব দিই দুটো কারণে। ওয়েবজগতে নাম উঠিয়ে রাখা, আর কিছু পয়সা তো এলো।
  
আরও এক নামি প্রকাশক বললেন,  কী করা যাবে !  অনলাইন বই ব্যবসা পিডিএফ ওয়েবসাইট তো বন্ধ করা যাবে না। যুগের দাবির কাছে আমরা প্রকাশকরাাসজায়। তাঁরও অভিমত, এসের কারণে ৪০ শতাংশের মত বিক্রি কমেছে। আগামীতে আরও কমবে। হয়তো ছাপা বইয়ের ব্যবসা তলানিতে ঠেকবে,   ই-প্রকাশকরা আত্মপ্রকাশ করবেন। তবে তিনি আশাবাদি,  এক-একটা সময়ে সব ব্যবসা মোড় নেয়। আবার সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ফিরেও আসে। ওই যে নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়া পাঠক, তাঁরা থাকবেনই। এঁদের সংখ্যা আবার বাড়বে। সেই আশায় বুক বাঁধছেন তিনি। 

তবে এই মুহূর্তে কিছুটা হলেও খাবি খাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। বিক্রেতাদের মধ্যে থেকে এমন দাবিও উঠছে, তাঁদের দেওয়া কমিশন অনলাইন বিক্রেতাদের কমিশনের সমান করা যায় কিনা !  সেটা যদিও পথ নয়। কারণ,  অনলাইন সংস্থাগুলোও তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হয়তো কমিশন আরও বাড়িয়ে দেবে। ফলে সব মিলিয়ে স্বস্তিতে নেই বইপাড়া।
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours