জয়ন্ত কুমার সাহা, ফিচার রাইটার, কলকাতা:
রবীন্দ্রসদন থেকে মেট্রোর দিকে হাঁটছি ... সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ়তর ... বাতাসে ঝিরঝিরে বৃষ্টির শৈত্য ... রাস্তায় ছন্নছাড়া কাদা ..
সেই ত্রহস্পর্শ থেকে নিজেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে এগিয়ে চলেছি ... গতি দ্রুত...প্রতিদিনের মতই...
সহসাই চোখে পড়ল ...
অপরিচ্ছন্ন
পদদলিত ফুটপাত আঁকড়ে ধরে অকাতর নিদ্রায় আত্মমগ্ন এক অভাগিনী জননী ও তার
কোলের শিশুটি ... জঠরের শূন্যতা নিরুপায় আত্মসমর্পণ করেছে দিনান্তের
অন্ধকারে... শ্রান্তির আশ্রয়ে...
মাথার
নিচে বালিশ নেই... তোষক,কাঁথা,গদি ... মশারি টাঙানোর ঝক্কি ... কিচ্ছুটি
নেই ... আরো কিছু নেই ... নেই স্পন্ডেলাইটিস, আরথারাইটিস, ম্যালেরিয়া,
ডেঙ্গু ... কিচ্ছু নেই ...
ভোটার
কার্ড নেই ... আধার কার্ড নেই ...প্যান কার্ড নেই ... রেশন কার্ড নেই ...
এল পি জি নেই, ভরতুকি নেই... বাজার নেই, রান্না নেই ... কান্নাও নেই
...অনিদ্রাও নেই...
সন্তানের
বেবিফুড নেই ... টিকাকরণ নেই ... অ আ ক খ এর পাঠ নেই ... পিতৃপরিচয় নেই
... ঠিকানা নেই ... শৈশব নেই ... নামকরণ ? বোধহয়, সেটিও নেই ...
ভোট নেই ... তাই ভেট নেই ... পঞ্চবার্ষিকী নেতাদের সহাস্য মুখের দেখাও নেই ...
এমনই
এক জননীকে দেখা যায় জি পিও র সামনে ... হাটু গেড়ে বসা ... কোলে ছোট্ট শিশু
... নিদ্রিত মায়ের মাথা নুয়ে পড়েছে দুই হাঁটুর কোলে ... প্রসারিত রয়েছে
শুধুমাত্র অনুকম্পা প্রত্যাসী একটি অস্থিচর্মমাত্র সার শীর্ণ বাহু ...
একটু পাশেই নির্মীয়মান আকাশচুম্বি অট্টালিকা ... কয়েকশো কোটির Home-যজ্ঞ ... নূন্যতম ক্রয়মূল্য পনের কোটি টাকা ...
সারা
কলকাতায় ... সারা রাজ্যে ... সারা দেশে ... সারা পৃথিবীতে এমন অসংখ্য
ছবির কোলাজ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমাদের সভ্যতার প্রসাধনকে বিদ্রুপ করে
যাচ্ছে ... পলেস্তারা খসে পড়ছে ...
আমি
একজন রাজ্য সরকারি আধিকারিক ... কেন্দ্র সরকারের সম মর্যাদার আধিকারিকের
থেকে প্রতি মাসে অন্তত কুড়ি হাজার টাকা কম বেতন পাই ... বাড়ি ভাড়া ভাতা,
মহার্ঘ ভাতায় প্রচুর ঘাটতি ...
আমার অন্তহীন অভিযোগ ... ন্যায্য দাবির সনদ আমার বুক পকেটে সর্বক্ষণের সঙ্গী ...
আমি
জানি না - এমন কিছু নেই ... আমি বুঝি না - এমন কিছুই হয় না ... রাজ্যের
মুখ্যমন্ত্রীর কি করা উচিত ... দেশের প্রধানমন্ত্রির কি করা উচিত না ... সব
ব্যাপারেই আমার জ্ঞান টনটনে...
মনে
আছে , একদিন মাসে পঞ্চাশ টাকা উপার্জন করতাম ... দেবব্রত বিশ্বাসের গানের
দুটি ক্যাসেট কিনতাম ... তারপরেও ছয় টাকা পড়ে থাকতো ... না,খরচ করতেই
পারতাম না... অজান্তেই সঞ্চয় হয়ে যেত ...
কনফুসিয়াস
বলেছিলেন, 'মানুষ এমন এক জীব যাকে পৃথিবীর সর্বোত্তম সুখের মধ্যে রাখলেও
কিছুদিনের মধ্যেই সে অতৃপ্ত হয়ে উঠবে ও আরো সুখের প্রত্যাশী হয়ে উঠবে। তাই
যথাসম্ভব সরল ও সাধারণ জীবনযাপনই শ্রেয়...'
ঈর্ষা
আমার চরিত্রে নেই ... কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হয় ... ঐ লোকটিকে বোধহয় আমি
ঈর্ষাই করে এসেছি ... সেই লোকটি ... সেই ফকিরটি ... যিনি তাঁর 'অলৌকিক'
ঔষধে রাজার অসুখ সারিয়ে তুলেছিলেন ...
প্রদীপের নিচেই এত অমাবস্যার ঢল ...
মা...মা গো ...
'চেরাপুঞ্জীর থেকে একখানা মেঘ ধার দিতে পারো গোবি সাহারার বুকে'...
Post A Comment:
0 comments so far,add yours