কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
কলকাতা, ২১ সেপ্টেম্বর: একেবারেই টানটান জেমস বন্ডের বাংলা সংস্করণ। আর তা বাস্তবেই।
বাংলা থেকে সটান উত্তরপ্রদেশে।
এই লেক টাউনে, তো তারপরেই রায়চকে।
রিসোর্ট থেকে নিয়ে সরকারি গেস্ট হাউসে।
যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই। তল্লাসি চললো ফাইভ স্টার হোটেলের হেঁসেলেও। দিনরাত এক করে ফেলেছে সিবিআইয়ের স্পেশাল টিম। চষে ফেলছে গোটা শহর। তবু, 'তোমার দেখা নাই রে'। অধরা রাজীব কুমার।
কোনও 'মোস্ট ওয়ান্টেড' ক্রিমিনাল নয়। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন খোদ রাজ্যের গোয়েন্দা প্রধান। প্রাক্তন নগরপাল। আর তাঁকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছেন সিবিআই গোয়েন্দারা। কোথায় লুকিয়ে পড়লেন তিনি? গত শুক্রবার বিকেল থেকে রাজীব কুমারের খোঁজে নাকানিচোবানি খাচ্ছে সিবিআই।
তবে এত কিছুর পরেও রাজীব কুমারের আইনজীবীর দাবি, তাঁর মক্কেল মোটেই পলাতক নয়। আগামী পঁচিশ তারিখ পর্যন্ত তিনি 'অ্যাভেলেবল' হবেন না। একথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল সিবিআইকে।
রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তার করতে কোনও বাধা নেই সিবিআইয়ের। শুক্রবারেই তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তারপরেই আলিপুর আদালত রায় দেয়, গ্রেপ্তারের জন্য দরকার নেই কোনও সরকারি অনুমতির। তারপরেই অল আউট রাজীব অভিযানে নেমে পড়ে সিবিআই।
কিন্তু কোথায় গেলেন রাজীব কুমার?
এই অবস্থার মধ্যেই এক বিস্কোরক মন্তব্য করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। "খুন হয়ে যেতে পারেন রাজীব কুমার।" বলেছেন সোমেন মিত্র। এই মন্তব্যের পরেই, স্বাভাবিক ভাবে কপালের ভাঁজ গাঢ় হবে তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের।
কিন্তু রাজীব কুমারকে পাকড়াও করতে কেন এই ব্যর্থতা? তাহলে কি ইনটেলিজেন্স ফেইলিয়োর? সিজিও কমপ্লেক্সের বক্তব্য, আদালতের নথিপত্র তৈরি করতেই হিমসিম খাচ্ছিলেন আধিকারিকরা। অসুবিধা কাটাতে সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লি থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয় বারোজনের এক স্পেশাল টিম। যাঁদের একমাত্র কাজ হবে রাজীব কুমারকে খুঁজে বার করা। শুরু হয় শহর জুড়ে চব্বিশ ঘণ্টার চিরুনি তল্লাসি। কিন্তু তবুও আজ পর্যন্ত সিবিআই নাগাল পায়নি প্রাক্তন নগরপালের।
শনিবার সকালে যখন আলিপুর জাজেস কোর্টে, রাজীব কুমারের আগাম জামিনের মামলার শুনানি নিয়ে চরম উত্তেজনা, ঠিক তখনই ভবানী ভবনে হাজির হলেন ছ'জন সিবিআই আধিকারিক। সেখানে তাঁরা পৌঁছে গেলেন সিআইডি'র সদর দপ্তরে। প্রায় আধঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে ফিরে যান সিবিআই আধিকারিকরা। তবে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাঁরা একটি কথাও উচ্চারণ করেননি।
এদিকে ইতিমধ্যেই রাজীব কুমারের দেশের বাড়ি, উত্তরপ্রদেশের চান্দৌলিতেও হানা দিয়েছে সিবিআই। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কর্তাদের এখনও ধারনা, কলকাতা শহর বা তার কাছেপিঠেই আত্মগোপন করে আছেন সিআইডি এডিজি। শুক্রবার লেক টাউন, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বেশ কয়েকটি জায়গায় খোঁজখবর করে সিবিআই। তল্লাসি চালানো হয় রিসর্ট, সরকারি গেস্ট হাউসেও। এর আগে বৃহস্পতিবার আলিপুরের আইপিএস মেসেও রাজীব কুমারের সন্ধান যান কেন্দ্রীয় সংস্থার গোয়েন্দারা।
শুক্রবার তাঁর পার্ক স্ট্রিটের আবাসনেও পৌঁছে যায় সিবিআইয়ের একটি দল। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়ে, রাজীব কুমারের স্ত্রী সঞ্চিতা কুমারের সঙ্গেও কথাবার্তা বলে ফিরে আসেন। সূত্রের খবর, সঞ্চিতা কুমার সিবিআইকে যে মোবাইল নাম্বারটি দিয়েছেন, তা কাজ করছে না। শনিবার ফের কিছুক্ষণের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রাজীব কুমারের স্ত্রীকে। সূত্রের খবর, গোয়েন্দা প্রধানের আবাসনের পাঁচ পরিচারককেও নোটিশ ধরিয়েছে সিবিআই। সন্দেহ করা হচ্ছে, প্রাক্তন পুলিস কমিশনার ফোনের মাধ্যমেই যোগাযোগ রেখে চলেছেন বাড়ির সঙ্গে। একাধিক মোবাইল ব্যবহার করছেন তিনি। কথাবার্তা বলতে সিম ব্যবহার করা হচ্ছে না। সবকিছু চলছে ইন্টারনেট মারফত অত্যাধুনিক 'কল বাউন্স' প্রযুক্তিতে। লোকেশন বদলাচ্ছেন প্রতি ন'সেকেন্ডে।
সিজিও কমপ্লেক্সে ডাক পড়েছে রাজীব কুমারের আপ্ত সহায়ক শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গত বুধবার এই আপ্ত সহায়ককেই চৌত্রিশ পার্ক স্ট্রিট থেকে কিছু ফাইল নিয়ে যেতে দেখা গেছিল। গোয়েন্দা প্রধানের দুই দেহরক্ষী, ট্র্যাভেল এজেন্টকেও হাজির হতে বলেছে সিবিআই। রাজীব কুমারের ঘনিষ্ঠদের জেরা করেই এবার তাঁর নাগাল পেতে চাইছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গোয়েন্দারা।
রাজীব মুখ খুললে বিপদে পড়বেন রথী মহারথীরা, আশঙ্কা সোমেন মিত্রের। তাই ষড়যন্ত্র করা হতে পারে তাঁর মুখ বন্ধ করার। কলকাতার এক বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমকে আজ তিনি একথা জানান। এছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা নেই বলে আশঙ্কা জাহির করেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ সোমেন মিত্র।
এদিকে রাজীব কুমারের আশায় ফের জল ঢেলে দিল আলিপুর জেলা আদালত। খারিজ হয়ে গেল তাঁর আগাম জামিনের আবেদন। শনিবার আদালতের রায়ে শেষ হাসি হাসল সিবিআই। তবে ওই হাসি চওড়া করার জন্য দরকার রাজীব কুমারের নাগাল পাওয়া।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours