সময়ের
সাথে সাথে যৌথ পরিবারের ধারণা বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত গতিতে। বিশেষ করে
বাঙালি যৌথ পরিবার গুলি একে একে ভেঙে যাচ্ছে। দ্রুত বেড়ে চলেছে ছোট ছোট
পরিবার। পঞ্চাশ ষাট এমনকি সত্তরের দশকের গোড়াতেও যেরকম যৌথ পরিবারের চেহারা
দেখা যেত, এই একবিংশ শতকের প্রথম দুই দশকের মধ্যেই সেই চেহারা আজ লুপ্ত
প্রায়। আধুনিক সময়ের দাবি মেনেই হয়তো এখন এই ছোট পরিবারের সংখ্যা বেড়ে
চলেছে। অনেকটা বাজার অর্থনীতির চাহিদা মেনেই। আধুনিক যুগে সংসারের আর্থিক
সচ্ছলতার কথা মাথায় রেখেই মা-বাবার চাকরির প্রয়োজন বেড়ে চলেছে। আর সেই
তাগিদেই তাদের সন্তান দের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক অনিচ্ছাকৃত নিঃসঙ্গতা।
এক
নিদারুন একাকিত্বের মধ্যে বেড়ে উঠছে আজকের শৈশব। ছোট ছোট শিশুদের এ এক
অত্যন্ত কষ্টদায়ক অনুভূতি। এই অনুভূতি শুধু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এরফলে
স্বরূপ একাকিত্বের মানসিক যন্ত্রনা শিশু মনে প্রকট হয়ে উঠছে দিন কে দিন।
আগে যৌথ পরিবার গুলিতে যেভাবে বড় দের কেউ না কেউ এই সব ছোট ছোট শিশুদের
নিজেদের কোলে পিঠে করে মানুষ করতেন। এখন অনু পরিবার বা ছোট পরিবারে সেই
দায়িত্ব অনেকটাই আয়া দের হাতে বা কাজের লোকেদের হাতে চলে গেছে। ফলে এই সব
শিশুদের শৈশব কেটে যায় ফ্ল্যাট বাড়ির ভিতরের চার দেয়ালের মধ্যে। সারাদিন মা
বাবা কে বিশেষ করে মা কে না দেখার কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে এই সব
শিশুরা বড় হতে থাকে নীরবে। ফলে আজকের আধুনিক প্রজন্মের মধ্যে অনেকের ভিতরেই
বয়স্ক দের মতো একটা নিঃসঙ্গতা মনের গভীরে এক ব্যাধির মতো চেপে বসেছে। যা
কুরে কুরে শেষ করছে তাদের অতৃপ্ত মানসিক চাহিদা কে এবং আশঙ্কা জনক ভাবে
প্রতি নিয়ত বেড়ে চলেছে।
যৌথ
পরিবারে বড় দের কাছে কোলে পিঠে মানুষ হওয়ার কারণে মা বাবার অভাব অনেক টাই
পুষিয়ে যেত। আগেকার দিনের চাকর বাকর রাও বাড়ির নিজেদের লোকের মতোই বংশ
পরম্পরায় থাকতেন বলে, যৌথ পরিবারের সন্তান তথা শিশু দেরকেও তাদের নিজেদের
সন্তান বলে মনে করতেন সেই সব চাকর বা চাকরানীরা। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা
বইয়ে এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কার দিনের কাজের লোক বা আয়া
রা অনেকটাই পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বাড়িতে কাজ করে বা বাচ্চা দের দেখা শোনা
করে। ফলে দুঃখের সঙ্গে এ কথা বলাই যায়, আজকের ছোট পরিবারের সন্তানেরা,
বিশেষ করে যাদের মা বাবা চাকরি করছেন। তাদের সন্তানরা অনেকেই সেই কারণে
একাকিত্বের জালে আটকে পড়েছে। আগেকার দিনে প্রতিটি পরিবারেই অন্তত পাঁচ থেকে
ছয়জন ভাই বোন থাকতো। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ পরিবারেই এক থেকে দুই জন
সন্তান। ফ্ল্যাট বাড়িতেই বেশির ভাগের বসবাস। শহর বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে
সবুজায়ন যেভাবে কমে যাচ্ছে। তাতে করে এখন বড় বড় বহুতলের মাঝে আকাশের স্থান
বড়ই স্বল্প। আর খেলা ধুলা করার মাঠ তো প্রায় নেই বললেই চলে। এর ফলে বেশির
ভাগ ছোট পরিবারের সন্তান দের সময় কাটে ফ্ল্যাটের চার দেয়ালের ভিতর। এই
কারণে এক তীব্র মানসিক অভিমান এবং জেদ তৈরি হয়েছে বেশিরভাগ এই নিঃসঙ্গ
শিশুদের মনে। এর ক্ষতিকর প্রভাব এদের সারাজীবন বইতে হয়। বহু ক্ষেত্রে মা
বাবা সব বুঝেও কিছু করতে পারেন না, অসহায় হয়ে পড়েন। অনেকে বাধ্য হন
হোস্টেলে ভর্তি করে দিতে। নিজেরা সন্তান দের কে সময় দিতে না পারার কারণে
হোস্টেলে পাঠিয়ে নিজেদের কিছুটা দায়মুক্ত করেন। শৈশবের এই মানসিক চাপ শিশু
মন কে করে তোলে ভীষণ রকম ভাবে উতলা। একদিকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায়
পড়াশোনার চাপ অন্যদিকে মাঠে খেলা ধুলার অভাব এছাড়া মা বাবার নিজেদের সমস্যা
সহ পারিবারিক অশান্তি শিশু মনকে করে তোলে অশান্ত।
এ
প্রসঙ্গে বলা যায়, ইন্দিরা গান্ধীর কথা। তাঁর ছোটবেলার থেকেই তাঁর মা কমলা
নেহেরু ছিলেন অসুস্থ। আর বাবা জওহরলাল নেহেরু ছিলেন এক জন অত্যন্ত ব্যস্ত
রাজনীতিবীদ। সেই কারণে ইন্দিরা ছিলেন প্রচন্ড নিঃসঙ্গ, কিন্তু নেহরু সেই
বিষয় টা অনুধাবন করেই ১৯২৮ সাল থেকে বেশ কিছুদিন নিয়মিত চিঠি লিখে মেয়েকে
কিছুটা সাহচর্য দেওয়ার চেষ্টা করতেন। জীবজগৎ তথা মানুষ সম্মন্ধে নিজের
ধারণা গুলো ছোট্ট ইন্দিরা কে তুলে ধরতেন। যাতে ইন্দিরার কল্পনা শক্তি
অনেকটা বৃদ্ধি পায়। একজন দায়িত্ববান রাজনীতিবীদ হওয়া সত্ত্বেও, একই সাথে
একজন দায়িত্ববান পিতার ভূমিকাও তিনি নিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র মেয়ের
ক্ষেত্রে। তাঁর মেয়েকে লেখা ৩১ টি চিঠি নিয়ে পরবর্তী কালে বিখ্যাত বই
"লেটার্স ফ্রম এ ফাদার টু হিজ ডটার " প্রকাশ পায়। নিঃসঙ্গ শিশুর মনে তার
বাবার প্রভাব কতটা তা এই বইটার থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।
বিশেষজ্ঞরা
মনে করেন এই নিঃসঙ্গ শিশুরা যদি এই ভাবে একাকিত্বের সাথে যদি বেড়ে উঠতে
থাকে তাহলে এই শিশুরা শারীরিক এবং মানসিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে থাকবে
নিয়মিত ভাবে। তাদের আচরণ গত সমস্যা দেখা দেবে তীব্র ভাবে। এছাড়া একাকীত্ব
বিষণ্ণতা এবং অস্বাভাবিক উদ্বেগজনিত মানসিক রোগ এর কারণে এদের মধ্যে
অস্বাভাবিক আচরণ এবং স্নায়বিক উত্তেজনা ও বিভিন্ন উদ্বেগ জনিত সমস্যা সহ
অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। আজ বিশ্ব জুড়েই এই
নিঃসঙ্গতা শিশু মন কে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করছে, যা কখনোই কাম্য ছিল না।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours