দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:


এই বীরভূমের মাটিতে বছর খানেক আগে একবার প্রশ্ন উঠেছিল "দিলদার তুমি কার?"  সিউড়ির পর নানুরের মাটিতে সেই একই প্রশ্ন স্বরূপ গড়াইয়ের মৃত্যুকে ঘিরে সেই একই ঘটনার সমাপতন!
 
মঙ্গলবার মৃতের পরিবার পুলিশী মর্গ থেকে মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করায়, লাশ রাজনীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদ বলেন, মানুষ মরলে লাশ হয়। সংস্কৃতি মরলে প্রথা। সেই লাশ প্রথা চলছে রাজ্য জুড়ে। সে তাপসী মালিক হোক, কিম্বা দিলদার খান ও স্বরূপ গড়াই! 

বিজেপির তরফে বলা হয়েছে, মৃতর পরিবার কোলকাতা থেকে ফিরলেই মৃতদেহ নিয়ে এক সপ্তাহ জুড়ে আন্দোলন চালাবে। 
তুলে ধরবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশী ব্যর্থতা। 

শুধু রাজনীতির রং নয়। মৃতদেহ এখন পুলিশ ও মৃতর পরিবারের মধ্যে বিতর্কের মূল বিষয়। মৃতের বিধবা স্ত্রী চায়না গড়াই চেয়েছিলেন মৃতদেহ নিয়ে বিজেপির রাজ্য দপ্তরে নিয়ে যেতে।  কিন্তু লালবাজার থেকে নির্দেশ পেয়ে বীরভূম পুলিশ মৃতদেহ নিয়ে সটান গ্রামে চলে আসে। কিন্তু পরিবার পুলিশের কাছ থেকে মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করে। শোকার্ত পরিবারের এই আচরণের মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। কারণ, একে শোকার্ত পরিবার। তারপর,  মূল অভিযুক্ত কেরিম খান তথা জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। যদিও কেরিম খানের দাবি, ঘটনার দিন তিনি জেলায় ছিলেন না। 

মৃতের পরিবারের তরফে মৃতদেহ নিতে অস্বীকার করার পর মৃতদেহ বোলপুর মহকুমা হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। পুলিশ তার আইন মোতাবেক নানুর সার্কেল ইন্সপেক্টর সহি করা চিঠি নিয়ে নানুর পৌঁছায় এবং অনুরোধ করে বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ নিয়ে সৎকার করার জন্য। কিন্তু পরিবার কাগজে সই করতে অস্বীকার করে এবং নোটিশ ও নিতে চায় নি। তারপর মৃতর পিতা ভুবন গড়াইয়ের নামে চিঠি বাড়ি সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। যদিও সেই নোটিশ কেউ বা কারা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। পুলিশ গোটা গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় এই নোটিশ সাঁটানোর মাধ্যমে আইনী পদক্ষেপ নেয়। এব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার শ্যাম সিং বলেন, পুলিশ যা করেছে, আইন অনুযায়ী করেছে।

সূত্রের খবর, আইন শৃঙ্খলার কারণে পুলিশ মৃতদেহ পরিবারের হাতে সেই মুহূর্তে তুলে দেয় নি। কারণ পরিবার মৃত দেহ নিয়ে কোলকাতায় বিজেপির রাজ্য দফতরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।  আর সেই কারণেই এন আর এস হাসাপাতালে পরিবারের সাথে পুলিশের কথাবার্তায় কোন সমাধান সূত্র বের হয় নি। সেখানে পরিবারের সাথে উপস্থিত ছিলেন বিজেপি নেতা দেবজিত সরকার, প্রাক্তন সাংসদ অনুপম হাজরা, অগ্নি মিত্র পাল প্রমূখ। 

এব্যাপারে কলকাতা এন্টালি থানায় অভিযোগ করেধ মৃতের স্ত্রী চায়না গড়াই। সেই অভিযোগ পত্রে তিনি পরিষ্কার বলেন, ময়না তদন্তের পর ৯ তারিখ অধিক রাত্রি হয়ে যাওয়ায় পুলিশ ১০ তারিখ সকালে মৃতদেহ নিয়ে চলে যায়। মৃতদেহ নিতে আমরা অস্বীকার করি নি। পুলিশ মৃতদেহ চুরি করেছে। 

যদিও একটা সূত্রের খবর মৃতের স্ত্রী চায়না গড়াইকে  পুলিশই  স্বামীর মৃতদেহ বিজেপি রাজ্য কার্যালয়ে নিয়ে যেতে দেয় নি। কিন্তু সোজা বাড়ি না নিয়ে গিয়ে কোলকাতা বিজেপি কার্যালয়ে কেন? এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এক্ষেত্রে মৃতের স্ত্রী চায়না গড়াইয়ের জবাব, স্বামীর শেষ ইচ্ছে সেটাই ছিল। আর যেহেতু পুলিশ মৃতদেহ বিজেপির কোলকাতা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় নি, পরিবার মৃত দেহ নিতে অস্বীকার করে। তারপর  বোলপুর মহকুমা পুলিশ আধিকারিক ও পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী  রাতারাতি নানুর নিয়ে চলে আসে মৃতদেহ। 

এরপর বিজেপি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে, পুলিশ মৃতদেহ চুরি করে গ্রামে নিয়ে আসে। পরিবারের অনুমতি ছাড়া পুলিশ এটা করে কিভাবে? বিজেপির রাজ্য সভাপতি এই ঘটনাকে রাজ্য সরকারের তামাশা বলে মন্তব্য করেছেন।  বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন, আমরা বুধবারেই পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা রুজু করবো। 

রাধা অষ্টমী উপলক্ষে শুক্রবার  নানুরের রামকৃষ্ণপুরে উৎসব চলছিল। সেই সময় পতাকা টাঙানোকে কেন্দ্র করে এক সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন স্বরূপ গড়াই। রবিবার রাতে এন আর এসে তিনি মারা যান। 

মৃতের ভাই অরূপ গড়াই বলেন, কেরিম খান সহ এগারো জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ এপর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে। তৃণমূলের নানুর ব্লক সভাপতি  সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, মৃতদেহ নিয়ে বিজেপি নোংরা রাজনীতি করছে, তৃণমূলের বদনাম করার জন্য।  তৃণমূলের জেলার সহসভাপতি অভিজিৎ সিনহা বলেন, পুলিশ আইন অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিজেপি ঠিক করছে না। সব কিছুতেই তৃণমূলকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।  অন্যদিকে, জেলা পুলিশ সুপারের অফিসের সামনে সপ্তাহ ব্যাপী আন্দোলন চালাবে বিজেপি। জেলার দায়িত্বে থাকা বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভয় পেয়েছেন। তাই এসব করছেন। তিনি নিজেই তো মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি করে ক্ষমতায় এসেছেন।  বিজেপির জেলা সভাপতি শ্যামাপদ মণ্ডল জানান, মৃতের পরিবার কোলকাতা থেকে ফিরলেই মৃতদেহ নেওয়া হবে এবং আন্দোলন চলবে যথারীতি।  এদিকে, মৃতের স্ত্রী চায়না গড়াই ফিরেই   হাসপাতালে যান। হাসপাতালে ঢোকার মুখে, উত্তেজিত বিজেপি কর্মীরা ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত খাম্বা ভাঙচুর করে। সৌমিত্র খাঁ সহ বিজেপি কর্মীরা সিয়ানের কাছে রাস্তা অবরোধে সামিল হয়।  এদিন মৃতের স্ত্রী মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের সাথে দেখা করেন।  জানা গেছে, সন্ধ্যার দিকে মৃতদেহ তিনি হাতে পাবেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিজেপি নেতৃত্বরা।  সৎকার না হওয়া পর্যন্ত মৃতদেহ মর্গে শুয়ে থাকবে। অপেক্ষায়! সেখানেও প্রশ্ন, তুমি কার? তার মৌনতায় বলে দেবে, সে কারও নয়!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours