Nari sromik nirapotahinotay vugchen
মুসবা তিন্নি, ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ: 


গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ৩০ ভাগ নারী শ্রমিক নিরাপত্তাহীনতায় ভু্গছেন৷ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণেই তাদের এই শঙ্কা৷ মহিলা পরিষদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৬ ভাগ নারী শ্রমিকই মনে করেন তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নেই৷ তাদের আশংকা যে কোন সময় তারা কাজ হারাতে পারেন৷ অন্যদিকে মালিকদের পক্ষ থেকে নতুন ন্যূনতম মজুরি শতভাগ বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও প্রায় ৪০ শতাংশ নারী শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পাননি বলে জানিয়েছেন৷ অবশ্য শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অসন্তুষ্টি আগের তুলনায় কমছে৷ এখন দুই-তৃতীয়াংশ নারী শ্রমিক তাদের মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট৷ গার্মেন্টস এ সাধারণত সাত তারিখে সেলারী , বেতন পাওয়ার দিনে বেকার স্বামী ঘরেই অপেক্ষা করে আবার কেউ কেউ তো ফ্যাক্টরি গেটেই দাঁড়িয়ে থাকে! মেয়েটা সারা মাসের খাটুনির বিনিময়ে পাওয়া টাকাগুলো দিয়ে দেয় বজ্জাতটার হাতে! কেউ আবার বাবার ওষুধ কিনার জন্য কিংবা ছোট বোনের একজোড়া পায়েল কিনার জন্য দুই চারশ টাকা আলাদা করে রাখে! অনেক সময়ই হয়তো স্বামী সেটা ধরতে পারে না কিন্তু মাঝেমধ্যে তো ধরা পরতেই হয়! যেদিন ধরা পরে যায় সেদিন আর রক্ষা নেই!

যাদের কষ্টের বিনিময়ে এই দেশের অর্থনীতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে তাদের অনেকের জীবনে একটু সম্মান আর ভালোবাসা নেই, একটু স্বস্তির সাথে হাসিমুখে এক দন্ড কথা বলার কেউ নেই, কেউ না! গার্মেন্টসে নিরাপত্তাহীন ৩০ ভাগ নারী শ্রমিক’।

বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷ যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷

প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!

পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷

কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷

২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ রানা প্লাজার এই ট্রেজেডিটি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে বিশ্বপোশাক শিল্পের প্রতিযোগিীতা থেকে ৫ গুণ পিছিয়ে দিয়েছে । অনেক পোশাক তৈরীর কারিগরদের মন ভেঙে গেছে এতোবড় একটি দূর্ঘটনা। অনেকে এই শোক সইতে না পেরে এই পেশা থেকেই নিজেকে সরিয়ে ফেলেছেন ! দক্ষ শ্রমিকের ফলে পোশাক শিল্পে অনেকটাই অবনতি ঘটেছে।

এবারে আসি গার্মেন্টস মালিকদের দ্বারা নারী শ্রমিকদের যৌন হেনস্থার বিষয়ে, কারণ শতকরা ৮ ভাগ নারী শ্রমিকের বয়স ১৮ বছরের নীচে৷ আসলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সবগুলো গার্মেন্টসে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, একটি গার্মেন্টসে মাত্র একজন নারী শ্রমিক পাওয়া গেছে যার বয়স ১৮ বছরের কম৷ তাও সে তার মায়ের সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে কাজ করে৷ এই সকল নারী শ্রমিকদের মালিক থেকে সুপারভাইজার পর্যন্ত অধিকাংশই শারীরিক ভাবে হেনস্থা করে থাকে। গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সদস্য এমন ১২টি কারখানার ১,০১৩ জন নারীর উপর এই জরিপ চালানো হয়েছে৷ জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৭ শতাংশ নারী শ্রমিকের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি৷ জরিপে দেখা গেছে ৯৬ শতাংশ নারী শ্রমিকই ভাগাভাগি করে টয়লেট, গোসলখানা ও রান্নাঘর ব্যবহার করেন৷ এর মধ্যে প্রতি ২২ জন মিলে একটি টয়লেট ব্যবহার করেন৷

 ‘সরকারের পক্ষ থেকে গার্মেন্টস মালিকদের করছাড়সহ যে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, তার কতটুকু শ্রমিকদের জন্য ব্যয় হচ্ছে?' ‘সরকার ও বিজিএমইএ'র উদ্যোগে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকের সংখ্যাসহ কয়েকটি বিষয়ের জন্য একটি সঠিক জরিপ করা দরকার৷' সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ছাড় দেয়া শুল্কের একটি অংশ, কারখানার কমপ্লায়েন্স তহবিল বাবদ একটি অংশ এবং ক্রেতার কাছ থেকেও শ্রমিকের কল্যাণে একটি অংশ আদায় করার উপায় বের করতে হবে।   

সবশেষে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই ,  বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি , চির কল্যানকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী ,অর্ধেক তার নর ! যে বাংলাদেশে  ৯০ দশকের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী হতে প্রধান বিরোধি দলীয় নেত্রী পর্যন্ত নারী হয়। এবং দীর্ঘ ২৯ বছর যেদেশে নারী শাসন প্রতিষ্ঠিত , সে দেশে কেনো এখনো নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়না ? সেদেশে এখনো কেনো নরীদের সাথে নির্যাতনের বিভৎসতা হয়? এদেশে তো এমন হবার কথা নয়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours