Shikhar suchona
স্বপন সেন, ফিচার রাইটার, হালিশহর:

রোববার সকালে সবে চা আর পেপারটা নিয়ে বসেছি, ভাইঝির ফোন। যাদবপুরের প্রাক্তনী বর্তমানে আটলান্টিক পারের বাসিন্দা । ফোন তুলতেই হৈহৈ করে বলে উঠলো, কি জেঠু দেখলে তো যাদবপুর কেমন এগিয়ে!বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা তান্ডবের মধ্যেও উপাচার্য সুরঞ্জন দাস একবার ও পুলিশ ডাকলো না!  বললো পদত্যাগ করবো তবুও পুলিশ ডাকবো না । হুঁ হুঁ জেঠু এসব যাদবপুরেই পাবে।

বললাম ওরে শোন শোন,আরো একজন সেদিন পুলিশ ডাকেন নি....‌

আশির দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্য কিন্তু এতোটা ভাগ্যবান ছিলেন না। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের ডক্টরেট এই পন্ডিত মানুষটি। সেদিনের শাসক দলের প্রচণ্ড বিরোধিতা ও  বাধাবিপত্তির মধ্যে উপাচার্য হয়েছিলেন। কার্যভার গ্রহণ করতে তিনি যে দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিপ্লবী’ কর্মচারী সমিতির সদস্যরা দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ‘সন্তোষ ভট্টাচার্য মুর্দাবাদ’, ‘সন্তোষ ভট্টাচার্য নিপাত যাক’, ‘গো ব্যাক সন্তোষ ভট্টাচার্য’ স্লোগান দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কর্মচারীরা কী প্রচণ্ড মানসিক অত্যাচার তাঁর ওপর করেছিলেন, কহতব্য নয়। 

যখন তখন কর্মচারী সমিতির সদস্যরা তাঁর চেম্বারে ঢুকে স্লোগান দিতে শুরু করতো। অশ্রাব্য গালাগালির সাথে আধপোড়া বিড়ি অব্দি তাকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারতো। এ ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চললেও উনি মাথা নিচু করে নির্বিকার বসে থাকতেন। সহকর্মীরা পুলিশ ডাকার কথা বলেলে বলতেন,‘পুলিশ ডাকব, তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়েছে !

উপাচার্য হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এক দিন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এটা-ওটা কথার পর জ্যোতিবাবু নাকি ওঁকে বলেছিলেন, ‘শুনুন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। একটা কথা মনে রাখবেন, বেশি বাড়াবাড়ি কিন্তু করবেন না।’ যাকে বললেন তিনিও এককালে কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, কমিউন-এ থেকেছেন। তিনি কি এই ছেঁদো কথায় ভয় পান ! ভাবখানা, ‘আমি কি ডরাই কভু ভিখারী রাঘবে?’,

চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে তিনি জ্যোতিবাবুকে বলে গেলেন, ‘আমাকে ইট-পাটকেল ছুড়লে আমি কি রসগোল্লা ছুড়ব? গুড বাই।’ সব রকম মানসিক নির্যাতন সহ্য করেও তিনি উপাচার্য হিসেবে তাঁর মেয়াদ পুরো করেছিলেন । কোনও দিন পুলিশ ডাকেননি বা অসুস্থতার ভান করে বাড়ি বসে বেতন নেননি। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোনও সাহায্য না পেলেও সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছিলেন প্রকৃত কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত পন্ডিত মানুষটি।

এক দিন মেট্রোর সামনে ট্র্যাফিক লাইটে তাঁর গাড়ি থেমেছে। ডিউটিরত এক কনস্টেবল হঠাত্‌ তাঁর গাড়ির সামনে এসে স্যালুট করে বলল ‘স্যার, আপনি চালিয়ে যান, আমরা আপনার সঙ্গে আছি’। ওনার নিজের ভাষায়, এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে?

মৃত্যুর পর সরকার থেকে হাজার অনুরোধ এলেও পরিবারের লোকজন তাঁর মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নিয়ে যেতে দেননি । বেঁচে থাকতে পণ করেছিলেন যে আর কোনদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াবেন না !
বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অনেক এসেছেন, আগামীদিনে আসবেনও অনেকে, কিন্তু ডক্টর সন্তোষ ভট্টাচার্যের মতো সোজা শিরদাঁড়ার মানুষ আর কখনো দেখা যাবে না! ‌

শুনে টুনে ভাইঝি একেবারে ফিউজ । কিন্তু একালের মেয়ে, ভাঙে তবু মচকায় না । শেষমেশ বলে উঠলো, ধুশ আমি তখন জন্মেছি নাকি ? ওটার রেফারেন্স টানলে চলবে না।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours