Redior dokan
দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:  

কে বলে বাঙালী তার ঐতিহ্য থেকে সরে এসেছে! যুগ যতই পাল্টাক।  চিপ থেকে মাইক্রো চিপ। ল্যাপ থেকে রোল ল্যাপ। থ্রিডি থেকে ফোর ডি টিভি সেট যতই বাঙালীর জীবনে আসুক না কেন! যতই বিভিন্ন চ্যানেলে মহালয়ার অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা হোক। মহালয়ার ভোরে অর্থাৎ চারটে দশে আকাশবাণীর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মাতৃপক্ষের আরাধনা না শুনলে, বাঙালীর মন ভরে না। বীরেন্দ্র কৃষ্ণের গলায় রেডিওতে যেই বেজে ওঠে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীত, ধরণীর বহিরাকাশে--’ —মনে  হয় মা দুগ গা ঘরের উঠোনে দাঁড়িয়ে। আর তাই রেডিওর প্রয়োজন আজও ফুরিয়ে যায় নি বাঙালীর জীবনে। তাই চরম ব্যস্ততা রেডিও সারাইকারীর দোকানে। পুরানো ধুলোয় ঢাকা রেডিওকে একটা দিন সকলের মনে পড়ে! রেডিও সারাই মিস্ত্রী ও গ্রাহকের কথোপকথন অনেকটা এমনই-- ‘কাতুদা! (শনিবার) পরশু  ভোরে মহালয়া। আমার কিন্তু আজই রেডিওটা চাই। খুব সোঁ সোঁ আওয়াজ। ঠিক করে দিও কিন্তু’। বলেই হন্ত দন্ত হয়ে ছুটল পাড়ার সিধো দাস। কাতুদার সামনে ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে পুরানো রেডিওর সারি। কাতুদার ফুরসৎ নেই নাওয়া খাওয়ার। আজই সব ডেলিভারি দিতে হবে। মনে মনে সে মা দুগগার থেকে বেশি ধন্যবাদ জানায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণকে। তার জন্য সংসারে এই কয়দিনে দু’একটা পয়সার মুখ দেখছে সে! তাতাল হাতে নিয়ে রেডিও সারাই করতে করতে, মুখ নামিয়েই কাতুদা বলে চললেন, ‘ রেডিও একেবারে শেষ হয়ে যায় নি। অন্ততঃ মহালয়ার দিন বীরেন্দ্র কৃষ্ণের চণ্ডীপাঠের জন্য
রেডিওর বিকল্প নেই। তার গলার আবেগ, মাধূর্‍্য কোন দিন ম্লান হবে না। বাঙ্গালীর কাছে পুজো মানেই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ মানেই পুজো। তাই  সারা বছর অবহেলায় বাড়ির এক কোনে পড়ে থাকা রেডিওর চাহিদা, এই মহালায়ার দিনে তুঙ্গে। কথা শেষ না হতে, না হতেই ঘোষ গিন্নী বলে গেলেন, ‘কাতু ঠাকুরপো ! আজ সন্ধ্যায় কিন্তু রেডিও নিয়ে যাব’। ঠিক আছে বৌদি! ঘার কাত করে শোনাল কাতুদা। এরপর আক্ষেপ শোনা গেল কাতুদার গলায়। ‘দেখুন! একটা দিনেই বা কেন মনে পড়বে রেডিওকে? টিভি যতই আকর্ষনীয় হোক না কেন। রেডিওর জায়গা নিতে পারে? ভেবে দেখুন তো শ্রুতি নাটকের কথা! কানে শুনেও কি আমাদের কাছে তার ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না? বুঝলাম শুধু পেশার তাগিদে এই কথা গুলো বলছেন না বীরভূমের নলহাটি থানার ভদ্রপুর পঞ্চায়েতের এক অখ্যাত গ্রামের রেডিও মিস্ত্রী কার্তিক পাল ওরফে সকলের কাতুদা। তার দোকানের সামনে উঠে যাওয়া আকাশবানী লেখা হোর্ডিংটার রং কালের স্রোতে অনেকটা উঠে গেলেও, আজকে কাতুদার কথায় সেগুলি যেন বেশ সপ্রতিভ মনে হল। তিনি বলে চললেন, “ দোকানের মাথায় যে হোর্ডিংটা দেখছেন না। এই হোর্ডিংয়ে লেখা ‘আকাশ বানী’ র জেল্লায় ছিল এক সময়। কি ভিড় হতো। রেডিওর সম্মান আগে ছিল ঢের বেশি। রেডিওর গায়ে রং বেরঙের কাপড়ের ঢাকনার উপর ফুল আঁকা সেলাইয়ের নকশা থাকত। এখন তো আদুল গায়ে জঞ্জালের মত অনেক বাড়িতে পড়ে থাকে একটা রেডিও বাক্স। কি বলব! রেডিও সারাইয়ের আগে ঝুল ঝাড়তে, মাকড়সার বাসা ভাঙতে হয়। কোন কোন রেডিওতে আবার বোলতার বাসাও পেয়েছি। মানুষ কি পাবে সেই গল্প দাদুর আসর, প্রাত্যহিকী , গ্রীষ্মের দুপুরে নাটক,  ছায়াছবির গান, স্থানীয় সংবাদ , ফুটবল খেলার রিলের আনন্দ। বোধ হয় না। কিছুটা তবুও বাঁচিয়েছে রেডিও এফ এম। গ্রাম বাংলায় তো এফ এম ধরে না। তাই বছরের একটা দিন রেডিওকে মনে পড়ে। বেঁচে থাক বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র!”   সংলাপ গুলো কাল্পনিক মনে হলেও, চির সত্যি। মহালয়ার সাত দিন আগে থেকে যে কোন রেডিও সারাইয়ের দোকানে উঁকি মারলে এই ধরণের কথা বার্তা শোনা যাবেই। মনে হবে বাঙালী তার ঐতিহ্য ভোলে নি!
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours