পার্থ বসু, লেখক, হাওড়া:
পিতৃপক্ষের অবসান,দেবীপক্ষের সূচনা এইসব তত্ত্বকথায় যাচ্ছি না।আমি জীবনের সত্তরটি শরৎ পার করে এসে এখন যা বুঝি, বাঙালির মহালয়ার ভোরটি বীরেন ভদ্রের।দিনমান তর্পনের।তর্পনের পরম্পরা সনাতন ধর্মের।এই রে, তর্কে ঢুকবো না।আমি আসলে হিন্দু শব্দটি পাশ কাটাতে চেয়েছি।হিন্দুত্ব কোন সমসত্ত্ব ধারণা নয়।ভারতের এক এক দেশে এক এক রকম।আবার সনাতন শব্দটিও সব ‘হিন্দু' র এজমালী সম্পত্তি নয়।আদিবাসি ধর্মগুলির হিস্যা আছে।বোঙ্গা আছেন।সাঁওতালিরা তর্পন করেন?মুণ্ডারা? মহালয়ার সাত দিনের মাথায় দুর্গা পূজা।এটিই বা কতোদিনের? সাঁওতালিরা পালন করেন হুড়ুম দুগ্গা।অসুর পূজা।সে এক অন্য দূর্গার গল্প।পরের পর্বে শোনাবো।আজ বলবো আমার শৈশবে এক মহালয়ার ভোরের স্মৃতি।এবং প্রৌঢ় বয়সে তর্পনের গল্প। বলতে গিয়ে সলতে পাকাই।ধান ভানতে শিবের গীতও।চণ্ডীপাঠের পুরাণ মানে মার্কণ্ডেয় পুরাণ।এই পুরাণের প্রাপ্য পুঁথির প্রাচীনতমটি আমাদের পূর্বদেশের।আট শ’ বছরের পুরোনো। নেপালের।ভাষা সংস্কৃত।লিপি? ভূজিমল।ব্রাহ্মীলিপির পরম্পরা যা থেকে বাংলা লিপিও।মোদ্দা কথা সংস্কৃতের চর্চা হোত যুগে যুগে যে যার লিপিতে।দেবনাগরী তার নিজস্ব লিপি না।আমরা তা ভুলতে বসেছি। এই লিপির সূত্রেই আত্মীয়তা।তো পুরাণপাঠে ফিরি।
পাঠ শুরু করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।১৯৩১ সালে কলকাতায় গার্স্টিন প্লেসের আকাশবাণীর পুরোনো বাড়িতে।লোকে কইতো ভূতের বাড়ি।আগামী ২০৩১ য়ে এই অনুষ্ঠানের শতবর্ষ। তো এটিও বাঙালির পরম্পরার অঙ্গ হতে চলেছে।শিকড়ে বাকড়ে এখনই মহীরূহ। তর্পন একটি ধর্মীয় আচার। এর আবেদন বাঙালি হিন্দুর কাছে। মহালয়া?
কয়েক বছর আগে বাগনানের স্থানীয় টিভি চ্যানেল দর্পণের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলাম।এই দিনের প্রভাতী সম্প্রচারে।সঞ্চালক ছিলেন এলাকার বিখ্যাত বাচিক শিল্পী সৈয়দ আজিজুর রহমান।তিনি শুরুতেই জানালেন—আজকের দিনে তর্পন বাঙালি হিন্দুর।কিন্তু বীরেন ভদ্রর ঝুঁঝকোবেলার চণ্ডীপাঠ আপামর আমবাঙালির।আমার দাদা,দাদী,মা কাকীমাও রেডিওয় কান পাততেন তুমুল আগ্রহে।সবাইকে জাগিয়ে দিতেন।মিস হলেই দিন বিস্বাদ।মুষড়ে পড়া।তো মহালয়া শোনার আগে রেডিওয় আসি।গ্রামে যাই।আমার শৈশবে।
গ্রামের নাম হরিহরপুর।থানা বাগনান।অজগ্রাম বললেও গায়ে মাখব না।কিছুটা দূর্গম তো বটেই।আজকের নিরিখে।বাগনান থেকে দক্ষিণে শ্যামপুর কমলপুর বাসরাস্তায় আন্টিলার খাল পেরিয়ে, নুন্টেবাঁটুলের স্বপ্নলোক সিনেমাহল পেরিয়ে, খাজুরদহ পেরিয়ে, বুড়ীবামুনের ভুতুড়ে পুকুরধার পেরিয়ে, সেই খালপাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বাঁশের সাঁকোয় খাল ডিঙিয়ে বেলির ডাঙা।আমাদের পারিবারিক শ্মশান।এক মাঠের পর আমাদের ভিটে।রাইদিঘী কাজিপাড়া হয়ে এলে হাঁটতে কম হতো।ঘোষালপাড়া পেরিয়ে এলেই বোসপাড়া।মাইল খানেক হাঁটলেই অনিল মুদীর দোকান।কাঠি আর গুলি লজেন্স।আমাদের ছেলেবেলায় আর চাই কি? আমাদের বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠত।নীচের পৃথিবীতে তখন গাছগাছালির অন্তরালে নিঝঝুম অন্ধকার।ঝিঁঝিঁর ডাক।নিশির ডাকও।কেরোসিন বা রেড়ির তেলে লম্ফ জ্বলত।বড় বাড়িতে লন্ঠন বা হ্যারিকেন।গরমে সম্বল তালপাতার পাখা।তা হোক,নতুন পুকুরের পাড়ের ঢালে জল ছুঁই ছুঁই একটি ত্ষ্ণার্ত আমগাছের শাখার তলায় আমোর মৌসমে মউলের গন্ধমাখা দখিনা পবন কি যে মিষ্টি লাগতো!এখনও গ্রাম ঢুকে আছে মজ্জায়,শুধু গ্রামে নেই।শহরে আমার সন্তানেরা এমন শৈশব পায় নি।বঞ্চিত হয়েছে।
যাই হোক মহালয়ায় আসি।বিদ্যূতের তার না থাক, আমাদের বাড়ি বেতার এসে গেল। রেডিও।এবারও আমাদের বাড়িটির একটু বর্ণনা না দিলে ধর্মে সইবে না।আমাদের বাড়িটি ছিল মাটির দোতলা।বিঘে খানেক জায়গা জুড়ে।ঠিক লেপা মাটির দেওয়াল নয়।পিতামহ শখ করে বানিয়েছিলেন।হরপ্পার মতো মাটির ইঁট, তবে পোড়া নয়, শুকিয়ে নিয়ে।তারপর পাকাবাড়ির মতো গাঁথনি।চিনিয়ে দিই? বাতাবী লেবু গাছের নাক বরাবর সামনের দুয়ার।ঢুকেই ডান হাতে বারোয়ারী পাকশালা।মাটির উনান।ডাঁই করা কাঠের জ্বালানি।বাঁহাতে আয়তাকার গোলা।সামনে ভিতরের উঠান।পাশেই ঠাকুরঘরটি।তারপর মূল কাঠামো।বারদুয়ারের ডাইনে পারিবারিক রান্নাঘর।ভাঁড়ারঘর।দেওয়াল বেয়ে মাটির সিঁড়ি।দ-য়ের মতো টানা বারান্দা।ওপর নীচে সব মিলিয়ে ছয়টি ঘর।ব্যাঁখারির বেড়া।গ্রিলের বিকল্প।
আর বাড়াবো না ছবিটি।এই গ্রামে রেডিও আসার ও মহালয়া শোনার প্রথম দিনটির অভিজ্ঞতা বুঝতে ও বোঝাতে এর কমে পরিবেশটি আঁকা যেতো না।একান্ন সালের গল্প।
বাড়িতে রেডিও এলো। আজকের ট্র্যানজিসটর সেট নয়।বহন যোগ্য।সে রেডিও ভারে বিপুল।দোতলার বারান্দায় পূর্বের দেয়ালে দোতলা তাক খোঁড়া হলো।কুলুঙ্গীর মতো।শুধু বহরে বড়ো। আয়তাকার।ওপরের তাকে শব্দযন্ত্র।নীচের তাকে তার কিসব ব্যাটারি! অতশত মনেও নেই।আর আমি তো মিস্তিরি নই।বোঝাতে পারবুনি।
পাড়ায় প্রচার হয়ে গেল।হৈ হৈ ব্যাপার।ভোর বেলায় সারা পাড়া ভেঙে পড়ল নীচের উঠানে।বসার জন্য সারি সারি মাদুর।আঁধার থাকতেই,হিমেল হাওয়ায় শাল চাদরপ মাথা মুড়ি দিয়ে গাঁয়ের মানুষ হাজির।আমরা শিশুরা কেউ কেউ উত্তেজনায় রাত জেগে সেই লগ্নে ঘুমে ঢুলছি।শুরুতে জাগি নি,কিন্তু হঠাৎ কানের ভিতর দিয়া মরমে প্রবেশিল সেই তীক্ষ্ণ,কিছুটা সানুনাসিক দৈব কণ্ঠ—যা,দেবী সর্বভূতেষু—
তাকিয়ে দেখি লোকারণ্য উঠান।ঝাপসা আঁধার।ফিকে হচ্ছে।নিঝুম নিঃশব্দ গ্রাম জেগে উঠছে।
অলৌকিক।
সেই গ্রাম নেই।সেই অপার মুগ্ধতারও অবকাশ নেই।বাড়ি বাড়ি অজস্র বীরেন্দ্র ভদ্র খান খান করছেন নীরবতা।সেই অপার বিস্ময় এক কথায় ফেরার।
এবার তর্পনে আসি।
বাবাকে দেখতাম আজীবন তর্পন করতে।খুব যে পরকাল নিয়ে তাঁর ভয়ভাবনা ছিল তা মনে হয় নি কিন্তু।তবে তর্পনের ভাবনাটিতে তৃষ্ণার্ত পূর্বপুরুষকে জল দেওয়ার ধারণাটি তাঁকে টানতো।আব্রহ্মতৃণে জলদান।ব্রহ্ম হতে কীটপরমানু।বিশ্বাস অবিশ্বাস নয়,আমি ছিলাম এইসব ধর্মকর্মে অনেকটা নিস্পৃহ।ক্লাস ফাইভেই সরস্বতী পুজোয় ঘুরতে ঘুরতে পুষ্পাঞ্জলির লগ্ন পার করেছিলাম।তারপর থেকেই যে কোন পুজোয় অঞ্জলি দেওয়াটাও আমার কাছে কেমন অবান্তর হয়ে গেল।বড় হতে হতে দুর্গা পূজাতেই দেখেছি অঞ্জলির মন্ত্রে শুধু ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে কেবল চাই চাই।অর্থং দেহি,ধনং দেহি,পুত্রং দেহি,সর্বকামাংশ্চ দেহি মে।হিন্দি নয়।আমাদের সময় সংস্কৃত পড়েছি ক্লাস এইট অব্দি।সেইটুকু বিদ্যেতেই বুঝে গেছিলাম এগুলো বড়দের মন্ত্র।কিছুটা লোভীদের মন্ত্রও।এখন এ বয়সে হয়তো আড়বুঝি এগুলি পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গাঁথা। কন্যাং দেহি কয় না কেউ।এমনকি তর্পনেও বংশমালাটির মাতৃত্বের সুতোটি কাটা।মাতৃপরম্পরা নয়।পিতৃপরম্পরায় জলদান।
বাবা মা গত হয়েছেন বিশ বছর আগে।তখনও আমার এতোটা অধঃপতন হয় নি হয়তো।আসামে শিলচরে গিয়ে মহালয়ার দিন তর্পনের জন্য মন অধীর হলো।মা সেরিব্রাল স্ট্রোকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বাগনানে দিদির বাড়িতে।তখন মোবাইল ছিল না।আমার শিবপুরের বাসায় টেলিফেোনও না।মায়ের সাথে শেষ বাক্যালাপ অন্তত আরও দু সপ্তাহ আগে।বাবা অসুস্থ।মা বাবাকে ছেড়ে থাকতেন না কখনও।মেয়েদের বাড়ি গেলে বাবাকেও সাথে নিয়ে যেতেন।আমরা একচক্ষু হরিণের মতো বাবাকে নিয়ে এতেটাই ব্যস্ত ছিলাম,যে মা একটি সারিডনও খান নি কখনও তাঁর রক্তচাপ মাপি নি কখনও।চিকিৎসার সুযোগই হ’ল না।ছ'মাসের মাথায় বাবা গত হলেন।একই বছরে।ছিলাম মেজাজে রাজপুত্র।এখন সর্বহারা ভিখারী।বাবাকে শেষ মুহূর্ত অব্দি সেবা করেছি।অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল বাবার।মৃত্যুর দিন পনেরো আগেও আবৃত্তি করেছেন--- এ কথা জানিতে তুমি ভারত ঈশ্বর শাজাহান--- খোকন দেখ তো ভুলে যাচ্ছি কিনা!মাযের কিন্তু নিজস্ব অভিমান ছিল।লোকগীতির সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের স্নেহের রাজকুমারী, ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালির শিল্পী,এইচ এম ভি-র রয়্যাল্টি প্রাপিকা,বেতারশিল্পী,কোলকাতা থেকে সুদূর গ্রামে এসে নিজের সংগীত জীবনের অনিচ্ছুক অসহায় সমাপ্তি দেখেছেন সংসারের যাঁতাকলে ,ঈদানীং সে সব কথা বলার অবকাশ খুঁজছিলেন--- সময় পেলেন না।নিষ্ঠুর মৃত্যু তাঁর মুখ চাপা দিল।মা যেন জীবন নাট্যের সেই চরিত্র যিনি শেষের সংলাপ গুলি বলার আগেই বিদেহী।
মায়ের মৃত্যুর পর স্বপ্নেও মা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতেন।কথার থৈ না পেয়ে।কথাই হতো না।এই কষ্ট।তর্পনে মা আসবেন? বাবা?
শিলচরে বরাবক্র নদ।গঙ্গা নেই।অফিসে ছুটিও নেই।
আমার শিলচরের বাসায় পাশের বাসার মাসীমা জানতেন আমি কবিতা লিখি।বললেন—তুমি কবিতায় তর্পন কর।
কঠিন নয়।হয়তো ঠিক আধুনিকও নয়।গদ্য শুধু কবিতার মতোন সাজানো।শিলচর দূরদর্শনে সারাভারত কবিসম্মেলনে পড়েছিলাম।এখানে শুনিয়ে শেষ করব।তারপর কথা হয় না।আমায় নীরবে একটু কাঁদতে দিন।
তর্পন
তোমার নাতনীর জন্য মণিপুরী মেখলা কিনেছি,
তোমার নাতির জন্য নাগাদের বাহারি জ্যাকেট।
ওরা দু'জনেই পরবে,ভাই বোন,আর ঠাকুমাও—
মানে তুমি বেঁচে থাকলে ওরা তা তোমায় পরাতোই।
তোমার বউমার জন্য কি কিনেছি জানতে চাও নাকি?
তুমি গেছ,সে এখন হয়ে গেছে ভীষণ সংসারী।
সে এখন চায়ে কম চিনি দেয়,লবণ বিষয়ে
ডাক্তারের সতর্কতা মান্য করে কাঁটায় কাঁটায়।
সে এখন সব কিছুতে না না করে, কিনতে চায় না কিছু।
সে কেবল দেখতে চায় ছেলেমেয়ে ভালো থাকলো কিনা,
পাছে তার জন্য কিছু কিনে ফেলি দামী উপহার
বাধা দেয়,তার জন্য যা কেনার,সে কেনে নিজেই।
খবর শুনলে তো? আজ মহালয়া,ভোরের শিশিরে ঝরছে তোমাদের স্নেহ
পথে খুব কষ্ট হ’ল? তর্পনের জল দিলাম। খেও। চারণা
পার্থ বসু, লেখক, হাওড়া:
পিতৃপক্ষের অবসান,দেবীপক্ষের সূচনা এইসব তত্ত্বকথায় যাচ্ছি না।আমি জীবনের সত্তরটি শরৎ পার করে এসে এখন যা বুঝি, বাঙালির মহালয়ার ভোরটি বীরেন ভদ্রের।দিনমান তর্পনের।তর্পনের পরম্পরা সনাতন ধর্মের।এই রে, তর্কে ঢুকবো না।আমি আসলে হিন্দু শব্দটি পাশ কাটাতে চেয়েছি।হিন্দুত্ব কোন সমসত্ত্ব ধারণা নয়।ভারতের এক এক দেশে এক এক রকম।আবার সনাতন শব্দটিও সব ‘হিন্দু' র এজমালী সম্পত্তি নয়।আদিবাসি ধর্মগুলির হিস্যা আছে।বোঙ্গা আছেন।সাঁওতালিরা তর্পন করেন?মুণ্ডারা? মহালয়ার সাত দিনের মাথায় দুর্গা পূজা।এটিই বা কতোদিনের? সাঁওতালিরা পালন করেন হুড়ুম দুগ্গা।অসুর পূজা।সে এক অন্য দূর্গার গল্প।পরের পর্বে শোনাবো।আজ বলবো আমার শৈশবে এক মহালয়ার ভোরের স্মৃতি।এবং প্রৌঢ় বয়সে তর্পনের গল্প। বলতে গিয়ে সলতে পাকাই।ধান ভানতে শিবের গীতও।চণ্ডীপাঠের পুরাণ মানে মার্কণ্ডেয় পুরাণ।এই পুরাণের প্রাপ্য পুঁথির প্রাচীনতমটি আমাদের পূর্বদেশের।আট শ’ বছরের পুরোনো। নেপালের।ভাষা সংস্কৃত।লিপি? ভূজিমল।ব্রাহ্মীলিপির পরম্পরা যা থেকে বাংলা লিপিও।মোদ্দা কথা সংস্কৃতের চর্চা হোত যুগে যুগে যে যার লিপিতে।দেবনাগরী তার নিজস্ব লিপি না।আমরা তা ভুলতে বসেছি। এই লিপির সূত্রেই আত্মীয়তা।তো পুরাণপাঠে ফিরি।
পাঠ শুরু করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।১৯৩১ সালে কলকাতায় গার্স্টিন প্লেসের আকাশবাণীর পুরোনো বাড়িতে।লোকে কইতো ভূতের বাড়ি।আগামী ২০৩১ য়ে এই অনুষ্ঠানের শতবর্ষ। তো এটিও বাঙালির পরম্পরার অঙ্গ হতে চলেছে।শিকড়ে বাকড়ে এখনই মহীরূহ। তর্পন একটি ধর্মীয় আচার। এর আবেদন বাঙালি হিন্দুর কাছে। মহালয়া?
কয়েক বছর আগে বাগনানের স্থানীয় টিভি চ্যানেল দর্পণের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলাম।এই দিনের প্রভাতী সম্প্রচারে।সঞ্চালক ছিলেন এলাকার বিখ্যাত বাচিক শিল্পী সৈয়দ আজিজুর রহমান।তিনি শুরুতেই জানালেন—আজকের দিনে তর্পন বাঙালি হিন্দুর।কিন্তু বীরেন ভদ্রর ঝুঁঝকোবেলার চণ্ডীপাঠ আপামর আমবাঙালির।আমার দাদা,দাদী,মা কাকীমাও রেডিওয় কান পাততেন তুমুল আগ্রহে।সবাইকে জাগিয়ে দিতেন।মিস হলেই দিন বিস্বাদ।মুষড়ে পড়া।তো মহালয়া শোনার আগে রেডিওয় আসি।গ্রামে যাই।আমার শৈশবে।
গ্রামের নাম হরিহরপুর।থানা বাগনান।অজগ্রাম বললেও গায়ে মাখব না।কিছুটা দূর্গম তো বটেই।আজকের নিরিখে।বাগনান থেকে দক্ষিণে শ্যামপুর কমলপুর বাসরাস্তায় আন্টিলার খাল পেরিয়ে, নুন্টেবাঁটুলের স্বপ্নলোক সিনেমাহল পেরিয়ে, খাজুরদহ পেরিয়ে, বুড়ীবামুনের ভুতুড়ে পুকুরধার পেরিয়ে, সেই খালপাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বাঁশের সাঁকোয় খাল ডিঙিয়ে বেলির ডাঙা।আমাদের পারিবারিক শ্মশান।এক মাঠের পর আমাদের ভিটে।রাইদিঘী কাজিপাড়া হয়ে এলে হাঁটতে কম হতো।ঘোষালপাড়া পেরিয়ে এলেই বোসপাড়া।মাইল খানেক হাঁটলেই অনিল মুদীর দোকান।কাঠি আর গুলি লজেন্স।আমাদের ছেলেবেলায় আর চাই কি? আমাদের বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠত।নীচের পৃথিবীতে তখন গাছগাছালির অন্তরালে নিঝঝুম অন্ধকার।ঝিঁঝিঁর ডাক।নিশির ডাকও।কেরোসিন বা রেড়ির তেলে লম্ফ জ্বলত।বড় বাড়িতে লন্ঠন বা হ্যারিকেন।গরমে সম্বল তালপাতার পাখা।তা হোক,নতুন পুকুরের পাড়ের ঢালে জল ছুঁই ছুঁই একটি ত্ষ্ণার্ত আমগাছের শাখার তলায় আমোর মৌসমে মউলের গন্ধমাখা দখিনা পবন কি যে মিষ্টি লাগতো!এখনও গ্রাম ঢুকে আছে মজ্জায়,শুধু গ্রামে নেই।শহরে আমার সন্তানেরা এমন শৈশব পায় নি।বঞ্চিত হয়েছে।
যাই হোক মহালয়ায় আসি।বিদ্যূতের তার না থাক, আমাদের বাড়ি বেতার এসে গেল। রেডিও।এবারও আমাদের বাড়িটির একটু বর্ণনা না দিলে ধর্মে সইবে না।আমাদের বাড়িটি ছিল মাটির দোতলা।বিঘে খানেক জায়গা জুড়ে।ঠিক লেপা মাটির দেওয়াল নয়।পিতামহ শখ করে বানিয়েছিলেন।হরপ্পার মতো মাটির ইঁট, তবে পোড়া নয়, শুকিয়ে নিয়ে।তারপর পাকাবাড়ির মতো গাঁথনি।চিনিয়ে দিই? বাতাবী লেবু গাছের নাক বরাবর সামনের দুয়ার।ঢুকেই ডান হাতে বারোয়ারী পাকশালা।মাটির উনান।ডাঁই করা কাঠের জ্বালানি।বাঁহাতে আয়তাকার গোলা।সামনে ভিতরের উঠান।পাশেই ঠাকুরঘরটি।তারপর মূল কাঠামো।বারদুয়ারের ডাইনে পারিবারিক রান্নাঘর।ভাঁড়ারঘর।দেওয়াল বেয়ে মাটির সিঁড়ি।দ-য়ের মতো টানা বারান্দা।ওপর নীচে সব মিলিয়ে ছয়টি ঘর।ব্যাঁখারির বেড়া।গ্রিলের বিকল্প।
আর বাড়াবো না ছবিটি।এই গ্রামে রেডিও আসার ও মহালয়া শোনার প্রথম দিনটির অভিজ্ঞতা বুঝতে ও বোঝাতে এর কমে পরিবেশটি আঁকা যেতো না।একান্ন সালের গল্প।
বাড়িতে রেডিও এলো। আজকের ট্র্যানজিসটর সেট নয়।বহন যোগ্য।সে রেডিও ভারে বিপুল।দোতলার বারান্দায় পূর্বের দেয়ালে দোতলা তাক খোঁড়া হলো।কুলুঙ্গীর মতো।শুধু বহরে বড়ো। আয়তাকার।ওপরের তাকে শব্দযন্ত্র।নীচের তাকে তার কিসব ব্যাটারি! অতশত মনেও নেই।আর আমি তো মিস্তিরি নই।বোঝাতে পারবুনি।
পাড়ায় প্রচার হয়ে গেল।হৈ হৈ ব্যাপার।ভোর বেলায় সারা পাড়া ভেঙে পড়ল নীচের উঠানে।বসার জন্য সারি সারি মাদুর।আঁধার থাকতেই,হিমেল হাওয়ায় শাল চাদরপ মাথা মুড়ি দিয়ে গাঁয়ের মানুষ হাজির।আমরা শিশুরা কেউ কেউ উত্তেজনায় রাত জেগে সেই লগ্নে ঘুমে ঢুলছি।শুরুতে জাগি নি,কিন্তু হঠাৎ কানের ভিতর দিয়া মরমে প্রবেশিল সেই তীক্ষ্ণ,কিছুটা সানুনাসিক দৈব কণ্ঠ—যা,দেবী সর্বভূতেষু—
তাকিয়ে দেখি লোকারণ্য উঠান।ঝাপসা আঁধার।ফিকে হচ্ছে।নিঝুম নিঃশব্দ গ্রাম জেগে উঠছে।
অলৌকিক।
সেই গ্রাম নেই।সেই অপার মুগ্ধতারও অবকাশ নেই।বাড়ি বাড়ি অজস্র বীরেন্দ্র ভদ্র খান খান করছেন নীরবতা।সেই অপার বিস্ময় এক কথায় ফেরার।
এবার তর্পনে আসি।
বাবাকে দেখতাম আজীবন তর্পন করতে।খুব যে পরকাল নিয়ে তাঁর ভয়ভাবনা ছিল তা মনে হয় নি কিন্তু।তবে তর্পনের ভাবনাটিতে তৃষ্ণার্ত পূর্বপুরুষকে জল দেওয়ার ধারণাটি তাঁকে টানতো।আব্রহ্মতৃণে জলদান।ব্রহ্ম হতে কীটপরমানু।বিশ্বাস অবিশ্বাস নয়,আমি ছিলাম এইসব ধর্মকর্মে অনেকটা নিস্পৃহ।ক্লাস ফাইভেই সরস্বতী পুজোয় ঘুরতে ঘুরতে পুষ্পাঞ্জলির লগ্ন পার করেছিলাম।তারপর থেকেই যে কোন পুজোয় অঞ্জলি দেওয়াটাও আমার কাছে কেমন অবান্তর হয়ে গেল।বড় হতে হতে দুর্গা পূজাতেই দেখেছি অঞ্জলির মন্ত্রে শুধু ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে কেবল চাই চাই।অর্থং দেহি,ধনং দেহি,পুত্রং দেহি,সর্বকামাংশ্চ দেহি মে।হিন্দি নয়।আমাদের সময় সংস্কৃত পড়েছি ক্লাস এইট অব্দি।সেইটুকু বিদ্যেতেই বুঝে গেছিলাম এগুলো বড়দের মন্ত্র।কিছুটা লোভীদের মন্ত্রও।এখন এ বয়সে হয়তো আড়বুঝি এগুলি পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গাঁথা। কন্যাং দেহি কয় না কেউ।এমনকি তর্পনেও বংশমালাটির মাতৃত্বের সুতোটি কাটা।মাতৃপরম্পরা নয়।পিতৃপরম্পরায় জলদান।
বাবা মা গত হয়েছেন বিশ বছর আগে।তখনও আমার এতোটা অধঃপতন হয় নি হয়তো।আসামে শিলচরে গিয়ে মহালয়ার দিন তর্পনের জন্য মন অধীর হলো।মা সেরিব্রাল স্ট্রোকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বাগনানে দিদির বাড়িতে।তখন মোবাইল ছিল না।আমার শিবপুরের বাসায় টেলিফেোনও না।মায়ের সাথে শেষ বাক্যালাপ অন্তত আরও দু সপ্তাহ আগে।বাবা অসুস্থ।মা বাবাকে ছেড়ে থাকতেন না কখনও।মেয়েদের বাড়ি গেলে বাবাকেও সাথে নিয়ে যেতেন।আমরা একচক্ষু হরিণের মতো বাবাকে নিয়ে এতেটাই ব্যস্ত ছিলাম,যে মা একটি সারিডনও খান নি কখনও তাঁর রক্তচাপ মাপি নি কখনও।চিকিৎসার সুযোগই হ’ল না।ছ'মাসের মাথায় বাবা গত হলেন।একই বছরে।ছিলাম মেজাজে রাজপুত্র।এখন সর্বহারা ভিখারী।বাবাকে শেষ মুহূর্ত অব্দি সেবা করেছি।অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল বাবার।মৃত্যুর দিন পনেরো আগেও আবৃত্তি করেছেন--- এ কথা জানিতে তুমি ভারত ঈশ্বর শাজাহান--- খোকন দেখ তো ভুলে যাচ্ছি কিনা!মাযের কিন্তু নিজস্ব অভিমান ছিল।লোকগীতির সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের স্নেহের রাজকুমারী, ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালির শিল্পী,এইচ এম ভি-র রয়্যাল্টি প্রাপিকা,বেতারশিল্পী,কোলকাতা থেকে সুদূর গ্রামে এসে নিজের সংগীত জীবনের অনিচ্ছুক অসহায় সমাপ্তি দেখেছেন সংসারের যাঁতাকলে ,ঈদানীং সে সব কথা বলার অবকাশ খুঁজছিলেন--- সময় পেলেন না।নিষ্ঠুর মৃত্যু তাঁর মুখ চাপা দিল।মা যেন জীবন নাট্যের সেই চরিত্র যিনি শেষের সংলাপ গুলি বলার আগেই বিদেহী।
মায়ের মৃত্যুর পর স্বপ্নেও মা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতেন।কথার থৈ না পেয়ে।কথাই হতো না।এই কষ্ট।তর্পনে মা আসবেন? বাবা?
শিলচরে বরাবক্র নদ।গঙ্গা নেই।অফিসে ছুটিও নেই।
আমার শিলচরের বাসায় পাশের বাসার মাসীমা জানতেন আমি কবিতা লিখি।বললেন—তুমি কবিতায় তর্পন কর।
কঠিন নয়।হয়তো ঠিক আধুনিকও নয়।গদ্য শুধু কবিতার মতোন সাজানো।শিলচর দূরদর্শনে সারাভারত কবিসম্মেলনে পড়েছিলাম।এখানে শুনিয়ে শেষ করব।তারপর কথা হয় না।আমায় নীরবে একটু কাঁদতে দিন।
তর্পন
তোমার নাতনীর জন্য মণিপুরী মেখলা কিনেছি,
তোমার নাতির জন্য নাগাদের বাহারি জ্যাকেট।
ওরা দু'জনেই পরবে,ভাই বোন,আর ঠাকুমাও—
মানে তুমি বেঁচে থাকলে ওরা তা তোমায় পরাতোই।
তোমার বউমার জন্য কি কিনেছি জানতে চাও নাকি?
তুমি গেছ,সে এখন হয়ে গেছে ভীষণ সংসারী।
সে এখন চায়ে কম চিনি দেয়,লবণ বিষয়ে
ডাক্তারের সতর্কতা মান্য করে কাঁটায় কাঁটায়।
সে এখন সব কিছুতে না না করে, কিনতে চায় না কিছু।
সে কেবল দেখতে চায় ছেলেমেয়ে ভালো থাকলো কিনা,
পাছে তার জন্য কিছু কিনে ফেলি দামী উপহার
বাধা দেয়,তার জন্য যা কেনার,সে কেনে নিজেই।
খবর শুনলে তো? আজ মহালয়া,ভোরের শিশিরে ঝরছে তোমাদের স্নেহ
পথে খুব কষ্ট হ’ল? তর্পনের জল দিলাম। খেও।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours