Masher jiboner dhormer proyojoniota
সোমা নাথ, লেখিকা, কলকাতা:

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতি বাস করে, তাদের আচার ব্যবহার, রীতি নীতি পৃথক, রঙ , বর্ন , ধর্ম সব কিছুই ভিন্ন।  তাই তাদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য ঈশ্বর, ও ঈশ্বরের বন্দনা করার জন্য ধর্মও ভিন্ন। ভিন্ন প্রজাতির মানুষ ভিন্ন ধর্মাচরণ করে থাকে । প্রতিটি ধর্মের আচার আচরণ খোলা চোখে অর্থাৎ ধর্মীয় ভাব ও আবেগ মূক্ত চোখে দেখলে , এই আচরণ গুলি খুব অদ্ভুত। কিছু অদ্ভুত শব্দ আওরানো, অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি , যার অর্থ খুঁজে পাওয়া ভার ! হ্যাঁ একান্ত ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্য  এই আচরণ গুলি একেবারেই অর্থহীন। কিন্তু তলিয়ে ভেবে দেখতে গেলে , প্রতিটি আচরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য পূর্ণ কারণ রয়েছে।

প্রতিটি ধর্মানুষ্ঠানের মূল  কারণ , সমাজের সবাইকে একত্রিত করা, সবার মধ্যে একটা সম্প্রীতি গড়ে তোলা!

ব্যক্তি মানুষ প্রতিনিয়ত নিজ নিজ কর্ম ক্ষেত্রে আবদ্ধ। নিজ গণ্ডি, প্রতিদিনকার প্রয়োজনের গণ্ডিতে আবদ্ধ। এই গণ্ডি প্রতিনিয়তই তাকে নিজ কেন্দ্রে আবদ্ধ করে তোলে। এই গণ্ডি থেকে বাইরে বার করা, বা আরো বৃহত্তর গণ্ডিতে আবদ্ধ করা হল ধর্ম ব্যবস্থা ও তার ধর্মাচরণ।

আবার আরেক দিক থেকে দেখতে গেলে মানুষ সব সময় প্রয়োজনের পিছনে ছুটে চলেছে, ব্যক্তিগত ঈর্ষা, লোভ, অজানিতের প্রতি আকর্ষণ তাকে বিভ্রান্ত করে তোলে। এই বিভ্রান্ত মনকে সংযত করে , নিজ মধ্যে ও নিজের প্রিয় জনের সাথে একাত্ম করার পন্থাই এই ধর্মাচরণ।

বস্তুত এক ও অনন্তের মধ্যে সম্মিলন, ভারসাম্য রক্ষা ধর্মাচরণ গুলির লক্ষ্য !

মানুষ ধর্মের - ঈশ্বরের ভয়ে ভীত হয়ে যত ন্যায় ও অন্যায় করে তার সিকি ভাগও অন্য কিছুর ভয়ে করে না - তাই ধর্মাচরণ । ধর্মাচরণ এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা সৃষ্টি করে মানুষের মন কে আবদ্ধ করে।

আসি হিন্দু ধর্মের আচার আচরণ নিয়ে।

মহিলারা পুজোর ব্যবস্থা  জোগাড় -যন্ত্র, গোছ গাছ করবে, পুরুষ তার যোগান দেবে, জোগাড় - যন্ত্র সম্পন্ন হলে নারী - পুরুষ সম্মিলিত ভাবে পূজার্চনা তে মন দেবে, নিয়ম বিধি পালন করবে সম্মিলিত ভাবে। এতে নারী পুরুষ উভয়ের ভাবার আদান প্রদান ঘটবে, দূরত্ব ঘুঁচবে! আসল উদ্দেশ্য সেটাই।

ধর্মাচরণ প্রথম ও প্রধান অঙ্গ আরতি ! - যা ঈশ্বর বন্দনার মূল পদ্ধতি । এর মাধ্যমে ঈশ্বরকে মনের মধ্যে আবাহন করা হয়।

প্রদীপ ধরিযে হাত বিভিন্ন কায়দায় চক্রাকারে ভগবানের মূর্তির সামনে বার বার ঘুরিয়ে এই আরতি করা হয়  । প্রদীপ ছাড়াও ধুপ, ধুনো, জ্বালানো হয়,  শঙ্খ বাজানো হয়।কখন  আরতি করা হয় কোনও ব্যক্তি বিশেষের ওপর কুদৃষ্টি কাটাতে, বলা হয়। কিন্তু যখন চক্রাকারে ওই প্রদীপ বা ধুপ - ধুনো মূর্তির সামনে ঘোরানো হয় মানুষের মন ওই দিকে নিবন্ধ হয়। ধুপ , ধুনোর গন্ধে মন ভালো হয়ে যায়। কুচিন্তা, দুশ্চিন্তা মন থেকে মুছে যায়। মন পবিত্র হয়। শুধু তাই নয় আস পাশের পোকা মাকড় ইত্যাদির বিনাশ ঘটে।  এই গুলিকেই প্রাচীন কালের থেকে সাধারণের বোধগম্য করতে কু দৃষ্টি থেকে মুক্তি, কুগ্রহ থেকে মুক্তি বলে ব্যাখ্যা করা হয়।
অতীত কালে বিদ্যুৎচালিত আলোর ব্যবস্থা ছিল না । আলোর উৎস ছিল প্রদীপ। 

মন্দিরে এবং গৃহে ও সন্ধ্যা হলে প্রদীপ জ্বালানো হত। তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালানো হত, মঙ্গল কামনা র উদ্দ্যেশে - এটা বলা হয় , কিন্তু আঙিনা আলোকিত করার ওটাই এক মাত্র মাধ্যম ছিল তৎকালে, সেই প্রথাই আজও চলে আসছে ।  বহু শতাব্দী আগে থেকেই রাজা বা উচ্চ বংশে ঈশ্বরের  মূর্তি  গর্ভগৃহে রাখা হত । গর্ভগৃহের  বিপুল -গভীর অন্ধকার দূর করতে ,  তখন ছোট মাটির প্রদীপ ধরানো যথেষ্ট ছিল না, তখন সে অন্ধকার দুর করতে প্রথমে প্রচুর মাটির প্রদীপ ও কালক্রমে পিতলের পঞ্চ প্রদীপের প্রয়োজন হয়  । ভক্তেরা যখন মন্দিরে পৌঁছত,তখন পূজারি প্রদীপটা মুর্তির কাছে নিয়ে গিয়ে ধরতেন দর্শনের জন্য। শুধু ঈশ্বর নন , মানুষের মুখ দেখার ও ওটাই এক মাত্র পথ ছিল, সেটাই কাব্যিক রূপে বর্ণনা করা হয়। প্রদীপ জ্বালানোর তৎকালীন প্রয়োজন পরবর্তীকালে  রীতি বা রেওয়াজে  পরিণত হয় আরতির রুপে, তার আনুষ্ঠানিক মাধুর্য ও অস্বীকার করা যায় না। । আরতি কথাটা এসেছে "আ" মানে সম্পূর্ণ ও "রতি" মানে ভালোবাসা থেকে। ভগবানের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের উদ্দেশে ই এই আরতি। 

আরতি ছাড়াও ভক্তি ভরে শ্রদ্ধার সাথে মণ্ত্রচ্চারণ, করতালি,ভক্তি গীতি ও ধ্যনমগ্নতা সবই কাল্পনিক ঈশ্বর এর উদ্দেশে নিজেকে সমর্পণ।   সচেতনতার সমষ্টিগত নিবেদন।

ঈশ্বর বা গুরুজনদের প্রণাম করার বিধিও তৈরি হয় এই মন সংযম বা আত্মনিবেদনের উদ্দেশে। মানুষ যখন তার দুটি হাত প্রথমে নিজের বুকের কাছে নিয়ে যায় তখন তার স্পর্শ, অনুভূতি তার হৃদয়ে প্রবেশ করে। যখন তা নিজের কপালে স্পর্শ করে তখন মন সংযোগ হয়। ষষ্ঠ অঙ্গে নমস্কার বিধি ধরিত্রীর সাথে সংযোগের সুযোগ ঘটায়। শুধু তাই নয় হাঁটু ভাঁজ করে, মাথা মাটিতে ঠেকানোর পদ্ধতিও শুধু মন সংযম না, ব্যায়াম ও।

পুজোয় যে কর্পূর, ধুপ, ধুনো দেওয়া হয়, তার উদ্দেশ্য অশুভ শক্তির বিনাশ, অর্থাৎ পোকা, মাকর ইত্যাদি নির্মূল করা।

পুজোয় শঙ্খ বাজাবার, উলুদ্ধনীর রীতি বহু প্রাচীন। বহুকাল আগে যখন সে রীতি চালু হয়, তখন দুর দূরান্তে সে শঙ্খ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ত। সমষ্টি গত সে আওয়াজে জীব , জন্তু জানোয়ার দূরে থাকতো। তাছাড়া শাঁখ নিয়ম অনুযায়ী তিন বার ফুঁ দিতে হয়। যেটা স্বাস প্রশ্বাস এর একটা বড় ব্যায়াম। সেযুগে মহিলাদের শরীর চর্চার নিয়ম ছিল না। শঙ্খ বাজালে ভিতরের যা কিছু ময়লা, অশুভ বাইরে বেরিয়ে যেত।

পূর্বে পুজোতে ঈশ্বরের সামনে প্রসাদ দেবার কোন বিধি ছিল না , ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ যা কিছু মনকে সংযত, প্রফুল্য ও ঈশ্বরের প্রতি প্রাণ নিবেদিত করে তার অর্পণ। পরবর্তীকালে স্বার্থান্বেষী মানুষ নিজের স্বার্থ সিদ্ধির কারণে উপকরণ , ইত্যাদি বাড়িয়েছে নিজেদের স্বার্থ ও সামর্থ অনুযায়ী। মূল উদ্দেশ্য যে চিত্ত শুদ্ধি , তার নজির আজ বিরল।

আজও উৎসব হয় , বহু অর্থ ব্যয় করে, বহু মানুষের সমাগম হয় , কিন্তু মূল উদ্দেশ্য চাপা পড়ে যায়।

প্রতিটি ধর্মেরই কিছু স্থির আচরণ প্রথা থাকে, সব এরই মূল উদ্দেশ্য একতা, শিষ্টের পালন, অন্যায়ের ধ্বংস, আত্ম সংযম। 

সব ধর্মের মানুষের প্রতি আমার অনুরোধ যদি নিজ ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে ধর্ম পালন করেই থাকেন, তার যথার্থ মর্যাদা, অর্থ রক্ষা করেই করুন - সেটা না হলে তো তার প্রয়োগ অর্থহীন কতগুলি হাত পা নাড়া ছাড়া কিছুই নয়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours