fiture
শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার: 

এই নির্দিষ্ট দিনটা এলে আজকাল শম্ভু মিত্রের অনবদ্য কণ্ঠে কবি বিষ্ণু দে-এর সেই কবিতাটি কানে ভাসে- 

'তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ্য, কবি?
হরেক উৎসবে হৈ হৈ 
মঞ্চে মঞ্চে কেবল-ই কি  ছবি?
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ 
আর বাইশে শ্রাবণ ?'

ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির  ফিলিপস কোম্পানির রেকর্ড প্লেয়ারে কতবার যে শুনেছি এই কবিতাটি তার ইয়ত্তা নেই। সেই কবে কালদর্শী কবি অনুভব করেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র উপলক্ষ্য হয়ে গেছেন। যে আমলে কবি বিষ্ণু দে একথা বলছেন, তখন আজকের মতো ঘরে ঘরে টেলিভিশনটাও পৌঁছায় নি।  মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি শব্দগুলি কল্পনাতেও নেই। সেই সময় যদি কবির এরকম মনে হয়ে থাকে, তবে আজকের দিনে হলে তাঁর কী মনে হত? ঠিক জানিনা কবি বিষ্ণু দে এসময়ে বসে কী লিখতেন! কিন্তু এটা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই যে, পঁচিশে বৈশাখের মতোই আজকের দিনটি অর্থাৎ বাইশে শ্রাবণ বাঙালি হুজুগের আর একটা দিনে পরিণত হয়েছে। 

অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বাঙালির শ্রেষ্ঠতম পুরুষটির প্রাপ্য কখনোই এরকম হতে পারে না। পাড়ায় পাড়ায় তাঁর ছবি নিয়ে প্রভাতফেরি করলাম, তাঁরই লেখা কিছু গান গাইলাম, রিনরিনে গলায় তাঁর কবিতা আবৃত্তি করল পাড়ার ছোট ছেলেটি, সুবেশ বেশে কিছু ছবি তোলা হল এবং তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় সেগুলি পোস্ট করা হল আর 'আজ ২২ শে শ্রাবণ, হে কবি লহ প্রণাম' বলে গাদাগুচ্ছের মেসেজ পাঠালাম এবং আমার ২২শে শ্রাবণ উদযাপন হয়ে গেল....ব্যাপারটা যদি এরকম হয় তবে এই পালন না হওয়াই ভাল। সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এরকমটা ভাবেন নি। 

এটা ঠিক যে, পারফর্মিং আর্টের আবেদন অনেক বেশি। কোনো লেখা লিখে যতজনকে প্রভাবিত করা যায় বা যতজনের কাছে পৌঁছনো যায়,পারফর্মিং আর্টের মাধ্যমে তার চাইতে অনেক বেশি দর্শক-শ্রোতার কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়, তা সে নাটক, গান, নাচ যা-ই হোক না কেন! মজার কথা এটা যে, রবীন্দ্রনাথ শিল্পের সব ধারাতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চর্চা অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু গান গেয়ে বা নাচ করে আর যাই হোক রবীন্দ্রচর্চা হয় না। সেটি করতে গেলে যে মনন ও বোধ দরকার তার থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি আমরা। আর নিজেদের এই ত্রুটি ঢাকতে 'হা কবি হা কবি' করে কেঁদে ভাসাচ্ছি। ভাবের ঘরে এই চুরি যে ধরা পড়ে যাচ্ছে তা যেন বুঝেও বুঝছি না! 

কয়েকদিন আগে প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বঙ্কিম গবেষক অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য্য আক্ষেপ করে বলছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব লেখাকে অনুবাদ করা সম্ভব হয় নি। ফলে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি নিজেদের দেশেও রবীন্দ্রনাথ বহু জায়গায় অপরিচিত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি যে, ভারতের বহু মানুষ জাতীয় সংগীতটি কার রচনা সেটা জানেন না। খারাপ লাগলেও মনকে স্বান্তনা দিয়েছিলাম এই বলে যে, এখনও আমরা, অনেক বাঙালিরা, জাতীয় সংগীতে 'উচ্ছল বঙ্গ` আর 'যমুনার গঙ্গা` গেয়ে অভ্যস্ত। ভেবেছিলাম যে, হিন্দিতে 'দেবদাস` ছায়াছবি নির্মাতা কলকাতায় এসে কী স্মার্টলি বলেছিলেন যে, 'শরতদা একটা দারুন নভেল লিখেছেন!' কাকে দোষ দেব? যারা বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নয় সেই মানুষগুলিকে, নাকি আমাদের নিজেদেরকে? আমাদের নিজেদের তরফে কোনো প্রচেষ্টা আছে জানানোর, চেনানোর? আজকাল তো 'ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী` বা 'পঙ্খিরাজ ঘোড়া` রিডিকুলাস স্টোরিতে পরিণত হয়েছে। পোকিমনের ঠেলায় 'নন্টে ফন্টে'র ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা। আমাদের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি নিরক্ষরতা দূরীকরণের কেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে। এরকম অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ উপলক্ষ্য ছাড়া আর কী হবেন?

অথচ এই সময়েই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তাঁর। কিন্তু এখন তো ঘরে আগুন লেগে গেছে, এখন পুকুর থেকে জল তুলে সেই আগুন নেভাবার চেষ্টা বৃথাই হবে না কি? তাঁর কথাতেই বলি 'মেঘ দেখে কেউ করিস না ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে'। 

আজ রবীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম মনে পড়ে। মনে পড়ে তাঁর 'রাশিয়ার চিঠি` বা `লোকহিত'। আরও একটু পিছিয়ে যাই। মনে করি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। বাবুয়ানার জন্য সে আমলে কলকাতার তরুণদের আইকন ছিলেন তিনি। ১৮৪৮ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর যখন প্রায় কপর্দকশুন্য দশা দেবেন্দ্রনাথের, তখনও কিন্তু শ`বাজারের জমিদারের নিমন্ত্রন রক্ষায় তিনি সাদা পোশাকে গেলেন, কোনোরকম জাঁকজমক না করে। কেবল পায়ে পড়লেন করমচাঁদ জহুরির তৈরী মখমলের জুতো যার ওপর ছোট ছোট দানা মুক্তো সাজানো। এই যে চারিত্রিক দৃঢ়তা, মরবার আগে হার না মানবার বলিষ্ঠ মানসিকতা...উত্তরাধিকার সূত্রে সবটাই তো রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন। তিনি চেষ্টাও করেছিলেন তাঁর স্বজাতিকে এই দৃঢ়তা ও মানসিকতার দীক্ষা দিতে। আমরা পারিনি, সে আমাদের ব্যর্থতা। 

২২ শে শ্রাবনের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য রবীন্দ্রনাথকে জানা, তাঁকে বোঝা। তাঁর সুচিন্তিত, কালজয়ী দর্শনকে আজও এতটাই প্রযোজ্য যে, যদি তা ছড়িয়ে দেওয়া যায় সর্বত্র তবে এই বিদ্বেষ, ঘৃণা, অসংযম ও অন্ধকার অবশ্যই দূর হবে।  
এই অদ্ভুত যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা ২২ শে শ্রাবণ চলে যাবে আর আমরা অসহায়ভাবে দেখে যাবো তা চলতে পারে না।
হে মানজাতি জাগ্রত হও। মানব সাগরতীরে আবার উচ্চারিত হোক, আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রানে। 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours