পারমিতা মালী, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কোন্নগর:
যেকোনো সমাজে দার্শনিকের প্রয়োজন। বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল,
আঁতেল ওসব নাম দিয়ে আমরা যতই থিওরিবিদদের নস্যাৎ করার চেষ্টা করি না
কেন,আমাদের অগোছালো সভ্যতার প্রকৃত ভাষ্য তাঁরাই দিয়েছেন। যাঁরা আমাদের
ভাবতে শেখান, তাঁরাই আসল নেতা। তাঁরাই থাকে মিছিলের পুরোভাগে। সে মিছিল পথে
নামুক বা নাই নামুক, সভ্যতার ইতিহাসে সে মিছিলের দাম কিছু কম নয়। তেমনই এক
চিন্তাশীল মানুষ রবীন্দ্রনাথ। এমনই এক ব্যক্তি, যিনি একটা গোটা জাতকে
দিয়েছিলেন শীলিত রুচি, সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ। আজ বাইশে শ্রাবণ। তাঁর
মৃত্যুদিন। তাঁর গান, তাঁর কীর্তি নিয়ে অসংখ্য বার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু
সেভাবে তাঁকে ধারণ করতে পারিনি আমরা। পূজো করেছি, আত্মীকরণ করিনি হৃদয়ে।
যদি সত্যিই প্রতিটি গানকে আদর করে কোলে নিই, তারা বোধহয় এভাবেই ধরা দেবে
আমাদের কাছে। যেমন ধরুন ,
"বিশ্বহৃদয় হতে ধাওয়া আলোয় পাগল প্রভাত হাওয়া...."
এই হাওয়া টা কেমন জানেন? আজকে সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে বটে, কাল কিন্তু
ঠিক এইরকম হাওয়া ছিলো। উত্তাল হাওয়া। একটুও গরম লাগছিলো না সারাদিন।
ছাদের ঘরে পর্দা টর্দা উড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। খোলা ছাদে দাঁড়ালে, চুল অগোছালো
করে, জামাকাপড় উড়িয়ে টুড়িয়ে একশেষ! কিছুতেই তাকে সামলানো যায় না! তারে মেলে
দেওয়া কাপড়জামা সব দুলিয়ে, গাছের পাতা এলোমেলো করে দিয়ে ছুটতে ছুটতে
হাওয়াটা কোথায় যে চলে গেলো! 'আসছিইইই' বলে গেলো বটে, তবে এ ছেলেকে বিশ্বাস
নেই। আদৌ আসবে কিনা কে জানে!
ওই যে, দেবব্রতর কন্ঠে "আমি আপন মনে মাঠে বনে উধাওওওওওও হয়ে যাইইইই...!"
ওই যে উধাউউউউ হয়ে গেলো যে হাওয়া টা, এইটা হচ্ছে সেই হাওয়া! এ খালি উধাওওও হয়ে যায়!
আবার দেখুন,
" ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।"
এইখানে কিন্তু হাওয়াটা কোত্থাও যাচ্ছে না। লক্ষী ছেলের মতো ঘুরে যাচ্ছে
ওই ছাদের ওপরেই। এদিক ওদিক ঘুরছে,আবার ঠিক তোমার কাছে চলে আসছে। সুরটাও
যেন হাওয়ার হাত ধরে ধরে ধিরিধিরি করে নাচছে। নাচতে নাচতে ঘুরছে।
অন্য এক জায়গায় দেখা যাবে,
অমল ধবল পালে লেগেছে,মন্দ মধুর হাওয়া
দেখি নাই কভু দেখি নাই, এমন তরণী বাওয়া
এই হাওয়াটা আবার অন্যরকম। কেমন যেন মন্দমধুর। জোরালো নয়, ধীইইইইরে ধীরে
বইছে। নদীর বুকের ওপর বাতাস দিচ্ছে, পালে বাতাস লেগেছে। খুউউউব ধীরে বইছে
বাতাসটা । জলে একটুও ঢেউ নেই। সামান্য একটু দুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো হাওয়াটা।
আর ফিরে আসবে না। এই হাওয়াটা যেমন জানে না, কোথায় কোন পাড়ার উপর দিয়ে সে
বইবে, এই সুরও তেমনি জানে না। হালকা করে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শুধু। তাতে
নৌকার পাল নড়বে, খুঁটি কি আর নড়বে? আপনি যদি সেনসেটিভ হন, তবে তিরতির করে
কাঁপবে এই হাওয়ায়, নইলে খেয়ালই করবেন না,কখন আপনাকে পেরিয়ে চলে গেলো....!
তাঁর সব কবিতায়, সব গানে এমন ছবি আছে। সব কটা সুরের ভিসুয়ালাইজ
করা যায়। যাকে সুর পাগল করে দেয়, তাকে তুলি হাতে দিয়ে দাও, দরবারি কানাড়াও
সে এঁকে দেখিয়ে দেবে। ইমনের ওই কড়ি মধ্যমের ছোঁয়াটুকু লাগলে বুকের ভেতরটা
কেমন হায় হায় করে ওঠে না? ওই হায় হায় টুকুও রঙে এঁকে দেখিয়ে দেবেন আপনাকে
সেই শিল্পী...!!. শরতের ভোরের আকাশে, যখন চারদিকে রোদ্দুরে রোদ্দুর। ঝকঝক
করছে সবদিক, ঠিক তখন আসে বিলাওবল। বিশুদ্ধ বিলাওবল...সব স্বর তার শুদ্ধ।
তারপর,
"যখন পাতায় পাতায়... বিন্দু বিন্দু ঝরে
জল....,ঠিক দেবব্রতর মতো উচ্চারণে, ওই বিন্দু বিন্দু জলটুকু শুধুমাত্র
কোমল নি। আস্তে করে লাগলো সকালের আলোতে, আর চরাচর হয়ে গেলো আলাহিয়া
বিলাওবল...
আজ যেমন বৃষ্টির আকাশে মেঘলা সুর...শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, তোমার
সুর.... আজ বাইশে শ্রাবণ...ভরা পূর্ণিমার দিন যদি সমস্ত আকাশ মেঘে ঢাকা
থাকে,তাহলে চারপাশে একরকম মায়াবী জোৎস্নার আভায় ভরে থাকে। বাইশে শ্রাবণও
ঠিক তেমনই।
হে কবি,
"দাও হে হৃদয় ভরে দাও
তরঙ্গ উঠে উথলিয়া সুধাসাগরে,
সুধারসে মাতোয়ারা করে দাও
যেই সুধারস পানে ত্রিভুবন মাতে,
তাহা মোরে দাও।।"
(ঋণস্বীকারঃ জয় গোস্বামী ও তাঁর কবিতাবলি)
পারমিতার লেখা রবীন্দ্র ভাবনায় অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
ReplyDeleteখুব প্রশংসনীয় ভাবনায় জারিত এই লেখা।