baishe srabon
রণজিৎ গুহ, সমাজকর্মী ও লেখক, দুর্গাপুর:

বঙ্গ পরম্পরায় আমরা প্রিয়জনের জন্মদিন বা জন্মতিথিই সাগ্রহে পালন করি। উদযাপন করি।স্মরণ করি প্রিয়জনকে। ব্যাতিক্রম মাত্র দু'একটা ক্ষেত্রেই। আজ বাইশে শ্রাবণ।রবীন্দ্রনাথের প্রয়ান দিবস।আজকের দিনে রবীন্দ্র স্মরণে আমরা দেখে নিতে পারি রবীন্দ্রনাথ নিজে মৃত্যুকে কিভাবে দেখেছেন। মৃত্যুকে অর্থাৎ প্রিয়জনের বিয়োগ বেদনাকে কিভাবে রবীন্দ্রনাথ সহনীয় করে তুলেছিলেন তার অসংখ্য উদাহরণ তাঁর জীবন জুড়ে।নিজের আসন্ন মৃত্যু নিয়েও অসম্ভব প্রশান্তি নিয়ে উচ্চারণ করেন--

"দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে
এসেছে আমার দ্বারে;
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু
কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত
অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার।
যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস
ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।
এই হার-জিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক
শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা,
দুঃখের পরিহাসে ভরা।
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি--
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।"

একেবারে মৃত্যুর দুয়ারে শেষ সময়ে বলছেন--
"প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে--
কে তুমি,
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়--
কে তুমি,
পেল না উত্তর।"

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।নাচে গানে কবিতায় অর্ঘ সাজিয়ে প্রতি বছর ২৫ বৈশাখ ২২ শ্রাবণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হয় যথেষ্ট আড়ম্বরেই।সে কিছু মন্দ নয়।কিন্তু প্রশ্ন ওঠে রবীন্দ্র সাধনার মুল ধারাটি আমরা কতটা অনুসরণ করছি। মৃত্যু ভাবনাতেও রবীন্দ্রনাথ ব্যাক্তিবোধ থেকে  নিজেকে সুচারু ভাবে উত্তির্ন করেন বিশ্বভাবনায়।
প্রিয়জনের মৃত্যু-শোকেও অবিচলিত থাকেন তিনি।পুত্র শমীন্দ্র অকালে চলে গেলে বলে উঠতে পেরেছিলেন সহজ সত্য প্রকাশের ভঙ্গিতে — "শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু-কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি — সমস্তের মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে। সমস্তর জন্য আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনোখানে কোনো সূত্র যেন ছিন্ন না হয়ে যায় ....।"

অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ। বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর যাপন ও ভাবনায় ভেদ রাখেননি কখনও।  'শরীরের দোহাই পাড়লে' যা বলতেন তা শিক্ষণীয় তো বটেই একই সঙ্গে অবিশ্বাস্যরকমের অভিনব — "যারা মানী লোক তাদের ফিরিয়ে দিতে আমার দ্বিধা হয় না, কিন্তু যারা অতি অভাজন, যাদের সকলেই অনায়াসে অবজ্ঞা করতে পারে, তাদেরকে দেখা হবে না বলতে আমি পারিনে। আমি জানি এতে আমার সময় নষ্ট হয়, বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটে, কিন্তু উপায় কি বলো?" আজকের সামাজিক মান্যজনদের মনে কি বিশ্ব-বন্দিত মানুষটির এই নিরুপায়-ভাবনা কোনও  আলোড়ন তোলে?
কবি অসুস্থতার সময়ও প্রিয়জনকে ডেকে বলছেন --"যে আমার কাছে আসে তাকে আমি কিছু দিতে চেষ্টা করি কেবল তার সেবা নেব, এ আমার ধর্ম নয়। আমার মধ্যে যা বিশুদ্ধ, যা উত্তম তাদের আমি দিয়ে যেতে চাই।" এই হলো সাধনার ধারা।যা পেয়েছি ফিরিয়ে দিতে হবে অকাতরে। যে আদর্শ লেখায় প্রচার করেছেন সেই আদর্শ শেষদিন পর্যন্ত জীবনেও পালন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। 
প্রিয়জনের বিয়োগ বেদনায় অথবা নিজস্ব শরীর যাতনায় রবীন্দ্রনাথ অপরিসীম ধৈর্যের সাথে নিজে সংযতচিত্ত থেকেছেন। গুরুতর অসুস্থতার মাঝেও প্রিয় ভৃত্য বনমালীর জমি সংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। উদ্বেগ প্রকাশ করছে। নিজের শরীর যন্ত্রনায় সাংসারিক দায় কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন না।মৃত্যু দুয়ারে দাঁড়িয়েও রসবোধের সামান্য খামতি নেই।
 কবির প্রিয় সেবক বনমালী বয়সের ভারে অশক্ত হয়ে পড়েছে  তাই   রামচরিতকে কবির পরিচর্যার কাজে লাগানো হলো কবি কিন্তু বললেন, "ঐ গুণের চাকরকে তুমি ফিরিয়ে নাও। ... কোনো ঠাট্টা-তামাশা ওর সঙ্গে করতে পারিনে, ঠাট্টা করলে ও হাসতে জানে না, শুধু কাজ নিয়ে আমি কি করবো? আমার 'লীলমণি' (বনমালী) আর কিছু পারুক না পারুক পেট ভরে হাসতে জানে, ঠাট্টায় যোগ দেয় — তাই ওর সঙ্গে কথা বলে আমি আনন্দ পাই।" 
রবীন্দ্রনাথের একান্ত প্রিয়জন নির্মলকুমারী মহলানবিশ  কবির শয্যার পাশে এসে জানালেন বিমর্ষমুখে — আজ তিনি ট্রেনের তলায় চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে ফিরেছেন উদ্বিগ্ন মন নিয়ে কবির কাছে আসার পথে। কবি তাঁর বিষন্নতা-বিপন্নতা কাটাবার জন্য বললেন, "বলো কি? তার চেয়ে আমার জন্যে কিছু টাকা দিলে পারতে। সে গল্প জানো না বুঝি? একজন আর একজনকে বলছে এ-তো প্রাণ নয় যে দিয়ে ফেললেই হ'ল, এ হচ্ছে টাকা! দেওয়া অত সহজ নয়।" লেখিকার মনের সব কষ্ট ধুয়ে-মুছে গেল বাঁধন-হারা হাসিতে সে রসিকতা শোনার পর।
রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র ব্যাক্তি জীবনযাপনের পথ নির্দেশ করেছেন তাই নয় সমাজ জীবনে নিজস্ব ভুমিকা স্পষ্ট করেছেন অকপটে। "যখন দেখলুম সত্যি কাজের চেয়েও নামের নেশা বেশী, কি কাজ হ'ল তার চেয়েও কে করেছে সেইটাই বড়ো কথা, তখন বুঝলুম আমার ওর মধ্যে থেকে সময় নষ্ট করলে চলবে না, তাই সরে দাঁড়ালুম। এই দলাদলির বিষই আমাদের মেরেছে। অনেক লোককে আমি দেখেছি যাদের মনোভাব হচ্ছে তার দ্বারা কিংবা তার দলের দ্বারা যদি স্বদেশ উদ্ধার না হয় তাহলে অন্য কারও দ্বারাও হয়ে দরকার নেই। দেশের লোকের ভালো হোক এটার চেয়েও বড়ো কথা আমার দ্বারা বা আমার দলের দ্বারা সেই ভালো হল কি না। এরকম জায়গায় কখনও আমি থাকতে পারি?" একই সংগে নিজের দায় অস্বীকার করছেন না। দায়িত্ব সচেতনতার স্পষ্ট ঘোষণা "আমি কবি, আমার সবচেয়ে বড়ো কাজ দেশের লোকের দৃষ্টি যাতে ভালোমন্দর তফাতটা পরিষ্কার দেখতে পায় সেই সাধনায় আত্মনিয়োগ করা, চরিত্রের মর্যাদা যেখানে খর্ব হয় সেখানে দেখিয়ে দিতে পারা আসল গৌরবটা কি। সবচেয়ে বড়ো কাজ সত্যের আহ্বানে সাড়া দিতে পারার মতো চেতনা জাগানো।"
আজকের বঙ্গীয় বা ভারতীয় রাজনৈতিক আবহে বাইশে শ্রাবণ পালন নিছক গতানুগতিক নাচ গানে বদ্ধ না থেকে  রবীন্দ্র ভাবনার দিকগুলো চর্চিত হোক। একালের দুর্নীতি-দুষ্কৃতি-নির্ভর পথভ্রষ্টদের তৈরি করা দুর্দিনের অবসান রবীন্দ্র ভাবনার একনিষ্ঠ প্রয়োগ নৈপুণ্যেই সম্ভব।আমাদের রবীন্দ্রনাথ স্মরণ রবীন্দ্র অর্চনা সার্থকতা পাবে রবীন্দ্র ভাবনা কার্যকর করেই। 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours