প্রশান্ত ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
পিঠের কাছে ঠেকিয়ে আছো নল
টিগারে আঙুল সতত প্রস্তুত
আমি তো তাই শান্তিতে স্নান করি
ঝিলাম কিম্বা শতদ্রুর জলে,
শান্তি এবং সান্ত্রি জমকালো
আলোর ভাল অন্ধজনেও বোঝে
পাঁজর ভাঙা উপত্যকার কোলে
আমার দেশ স্বাধীন ভাবে দোলে
আকাশে দেখো গৈরিক শামিয়ানা
তাহার নিচে আজকে স্বাধীনতা।
পরিস্থিতি
অনুকূল থাকলে ১৫ আগস্ট লালচকে আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন কেন্দ্রীয়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এটা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব ঘটনা। এইরকম একটা
দিনের জন্য কাশ্মীরবাসীসহ ভারতবাসী বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। আর এই
অবস্থাটা প্রলম্বিত হলে আহ্লাদের আর শেষ থাকবে না।
ঠিকই
তো, আমরা তো চাই গোটা দেশটা হার্দিক উচ্ছ্বাসে স্বাধীনতা দিবস পালন করুক।
থাক না পেটে খিদে বাকি ৩৬৪দিন, তবু একটা দিন স্বাধীনতা পুজো হোক
ষোড়শোপচারে। অভাব তো থাকবেই, সুষম খাদ্যের অভাব, বাসস্থানের অভাব, লজ্জা
নিবারণের আবরণের অভাব, অসুখ হলে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব, লেখাপড়া করার মতো
বয়সিদের সেই সুযোগের অভাব, বিনোদনের অভাব -- এসব তো থাকবেই। কিন্তু
স্বাধীনতা দিবস! সে এক অতীব প্রাপ্তি। কোনও সম্পদ, কোনও বৈভবের নিরিখে তাকে
বিচার করা চলে না। ওটা একটা অতীন্দ্রিয় বিষয়। অনেকটা ঈশ্বর-গড-আল্লার মতো,
একটি নির্বিচার প্রকল্প। বিগ্রহের মতো এই জিনিসটাকে আমরা ৭২ বছর ধরে আগলে
আসছি। স্কুলজীবনে একটা লজেন্স পাওয়ার জন্য ১৫ আগস্ট স্কুলে গিয়ে হাজির
হতাম। তারপর যখন লজেন্স নামক লোভটি হাওয়া হয়ে গেল বয়স গড়িয়ে যাওয়ায়, তখনও
স্বাধীনতা দিবসে স্কুলে হাজিরা দিতাম পড়ায় ফাঁকি দেওয়া যাবে বলে। কলেজ জীবন
তো লায়েক হয়ে ওঠার ওয়ার্কশপ। হাতেপায়ে স্বাধীনতা, অতএব চুটিয়ে ভোগ কর একটা

আমার
বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের এই ৭২ বছরের স্বাধীনতায় আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা
নানা রঙে, বিবিধ ভণিতায় লঙ্ঘিত হয়েছে। বহুস্বরের বিস্তার তো ঘটেইনি,
উপরন্তু একস্বরের বিভৎসা আমাদের বাকস্বাধীনতা লুঠে নিয়েছে। বিকাশের পরতে
পরতে যে উদারতার অনুশীলন ছিল জরুরি, তা রুদ্ধ করা হয়েছে নানা অছিলায়। আজ
তাই বিপন্ন সময়ের একটা বোঝা বয়ে চলতে হচ্ছে। আমরা কী খাব, আমরা কী পুকার
করব, সব ঠিক করে দেওয়ার এক বাহিনী তৈরি হয়েছে, যাদের স্পনশর করছে সরকার।
তাদের পাশবিক উল্লাসে স্বাধীনতার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। গত ৭২
বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে এই অনাচার হচ্ছে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়াগুলোর প্রয়োগের মাধ্যমেই। এখানেই আমাদের স্বাধীনতার প্রাণভোমরা।
এই তো দেখুন না, গত ৫ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের ১০ দিন আগে সংসদীয় রীতিকে
পূর্ণ মান্যতা দিয়ে হত্যা করা হল একটা রাজ্যকে। কেড়ে নেওয়া হল একটা
ভূখণ্ডের আমাদেরই সহনাগরিকদের সমস্ত নাগরিক অধিকার। একটা ভূখণ্ডকে বানিয়ে
দেওয়া হল উন্মুক্ত জেলখানা। আর সেই কাজটি করার জন্য ওই মানুষগুলোর কোনও
অনুমোদনের প্রয়োজন বোধ করা হল না। উল্টো বিনা বিচারে জেলে পুরে রাখা হয়েছে
বহু কাশ্মীরবাসীকে। ভূখণ্ডটি তো ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভারী বুটের তলায় চাপা
পড়ে আছে। সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরাধীন ভারতে বলেছিলেন, বিনা
বিচারে বন্দি করে রাখার আইনটাই পরধীনতার কথাটা স্পষ্ট করে মনে করিয়ে দেয়।
যা আজ মনে করাচ্ছে উপত্যকার নাগরিকদের। ফলে সেখানকার অধিবাসীরা প্রতিটি
কোষে কোষে টের পাচ্ছেন তাঁদের প্রতি ভারত রাষ্ট্রের অবহেলা, বঞ্চনা,
অবজ্ঞা। 'এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা' মাথায় রেখে নতুন কাশ্মীর বানানোর এই
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এক ঔপনিবেশিক চেতনা থেকেই বলে তাঁরা মনে করছেন। আর
এই মনে করাটাও অস্বাভাবিক নয়। কেননা, জম্মু-কাশ্মীরের এত বড় এবং ঐতিহাসিক
ঘটনা ঘটানো হল কাশ্মীরিদের কোনও অনুমোদন না নিয়ে। ঠিক যেভাবে উপনিবেশের
বিস্তার হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আর যেভাবে জম্মু-কাশ্মীরের বিরোধী
নেতাদের হয় জেলে নয গৃহবন্দি করে
সংসদে
তড়িঘড়ি বিল এনে জম্মু-কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত করে রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে,
তাকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা করে তোলা হল, তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী।
এতদিন এলাকার বাসিন্দাদের চাহিদা ও রাজ্য সরকারের অনুরোধ মেনে রাজ্য
পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া হত। এবার কেন্দ্রীয় সরকার জোর করে যে কোনও রাজ্য
পুনর্গঠনের নজির তৈরি করল। পেল যে কোনও রাজ্য আলাদা করার অধিকার। এরপরে
৭৩তম স্বাধীনতা দিবস আমরা যতই হইহই করে চোঙা ফুকে পালন করি না কেন উপত্যকার
মানুষগুলো স্বাধীনভাবে শ্বসনক্রিয়াও বোধহয় চালাতে পারবে না। তাই ৭৩ তম
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আমার শুধু আব্রাহাম লিঙ্কনের এই কথাটা মনে পড়ছে,
'Those who deny freedom to others deserve it not for themselves.'
Post A Comment:
0 comments so far,add yours