fiture
রঞ্জন সেন, লেখক ও সাংবাদিক, কলকাতা:

‘আমি পথের দুপাশে বটবৃক্ষ রোপন করেছি, যা মানুষ ও পশুদের ছায়া বিতরণ করবে। আমি আম্রকুঞ্জ ও উদ্যান রচনা করেছি এবং প্রতি আট ক্রোশ অন্তর পান্থশালা নির্মাণ, বিশ্রামাগার ও জলপানের জন্য কূপ খনন করেছি। এই স্বাছন্দ্যগুলি অতি প্রয়োজনীয়।’ একটা শিলালিপিতে কথাগুলি লিখেছিলেন সম্রাট অশোক। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, অশোকের কথাগুলোতে কোন রাজকীয় ফরমান নয় বরং একটা আন্তরিকতার ঢঙ রয়েছে। পাঠক যদি সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্য যে জায়গায় বিস্তৃত ছিল সেই বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রবল গরম, জলকষ্ট, কাজকর্মের প্রয়োজনে দুপুরের প্রখর রোদে বেরনো পথচারীদের কথা মনে করেন তাহলেই এই শিলালিপির সারবত্তা বুঝতে পারবেন। প্রাচীন ভারতের প্রজারঞ্জক রাজারা স্বাধীনতার অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছিলেন। আর স্বাধীনতার পর হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ। তার থেকেও দুঃখের ব্যাপার হারিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণের ইচ্ছা। 
কাগজে কলমে ঘোষণার ঘাটতি না থাকলেও পরিবেশ ব্যাপারটা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নতুন ভারতের রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তা ও চেতনায় কোনকালেই খুব একটা পাত্তা পায়নি, এটা কোন সময়েই তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় আসেনি। এখন দিনকাল বদলেছে, চাপে পড়ে নিজেদের নির্বাচন কেন্দ্রের ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে অনেকে পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বলছেন বটে কিন্তু তাতে ঘোষণার তুলনায় আন্তরিকতা কম। জল ও বায়ুদূষণ যেভাবে মানুষকে বিপন্ন করছে তার চাপে আমাদের রাজনীতিবিদরা পরিবেশ সংরক্ষণের কথা বললেও তা এখনও অবধি কথার কথাই রয়ে গেছে। 
আমাদের রাজনীতিতে কোন কালেই ইস্যুর কোন অভাব ছিলনা, এখনও নেই। কিন্তু এই ইস্যুর ভিড়ে পরিবেশের কোন জায়গা নেই। নেই তার হয়ে কথা বলার মত কোন রাজনৈতিক দল। বুদ্ধ, অশোকের দেশে আমাদের রাজনীতির দিগন্ত থেকে পরিবেশ ব্যাপারটা যেন মিলিয়ে গেছে। কারণ পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যাপারটার মধ্যে কোন চমক নেই, এটা আড়ালে থেকে কাজ করার ব্যাপার। এতে পরিশ্রম বেশি, প্রচার কম, আমদানিও কম। কাজেই রাজনীতির এতে কোন আগ্রহ নেই।  
স্বাধীনতা মানুষকে ঠিকঠাক বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠার পরিবেশ দেয়। এই কাজে পরিবেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কারণ, তার বুকে দাঁড়িয়েই মানুষ বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব সবকিছু করে। কিন্তু পরিবেশে যদি তার বাঁচার নুন্যতম শর্তগুলি না থাকে তাহলে মানুষ লড়াই করবে কী করে? এই সরল সত্যটা তাৎক্ষনিকতায় আক্রান্ত   রাজনীতিবিদরা ভাবেন না। এরা সব দলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরিবেশ ব্যাপারটা রাজনীতি থেকে উধাও হওয়ার এটাই মূল কারণ। আমি পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে স্বাধীনতার বিপরীতে দাঁড় করাচ্ছি না, দাঁড় করানোর কোন জায়গাও নেই। কিন্তু স্বাধীন ভারতে মানুষের স্বাধীনতার ব্যাপারটা যেন পরিবেশের স্বাধীনতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছে। 
পরিবেশ যেন যা ইচ্ছে তা করা যায় এমন একটা বারোয়ারি ব্যাপার। যে কোন সময়ে যে কোন জায়গায় মাইক বাজানো যায়; নিজের প্রয়োজন মত গাছপালা কাটা যায়; নিষেধ সত্বেও দূষিত করা যায় নদী; যত্রতত্র টাওয়ার বসিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া যায় পক্ষীকূল; জলাজমি, পুকুর চুরি করে তোলা যায় আখাম্বা ইমারত; পুলিশ ও  প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালানো যায় বায়ু দূষণ ছড়ানোর অভিযোগে বাতিল যানবাহন। স্বাধীন ভারতে পরিবেশ বরাবরই চির পরাধীন হয়ে রইলো। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত মানুষ তার দিকে আধেক আঁখিরও কোনে তাকানোরও ফুরসৎ পেলনা।
সইতে সইতে আর তিষ্ঠতে না পেরে সে এখন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার যে দেশের বিজ্ঞানী ঘোষণা করেন গাছেরও প্রাণ আছে, যে দেশ শতাব্দীর পর শতাব্দী বৃক্ষকে পুজো করে এসেছে, বন্দনা করেছে মাতা বসুন্ধরার, পুজো করেছে সমুদ্রকে, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ সবকিছুতে নদীর জলে নিজেকে শুদ্ধ করেছে সে দেশ পরিবেশ ও প্রকৃতিকে এত তুচ্ছ করতে শিখলো কীভাবে! কেউ বলবেন প্রয়োজন বড় বালাই, কিন্তু প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আমরা যে নিজেদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করছি তা দেখবো না! 
আমাদের বেঁচে থাকার আওয়াজ, আমাদের স্বাধীনতার কুচকাওয়াজ, পরিবেশের স্বাধীনতার আওয়াজকে যেন ডুবিয়ে না দেয়। আসুন, তার স্বাধীনতাকে আমরা একটু স্বীকৃতি দিই, একটু ভালোবাসি তাকে।
              
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours