শামা আরজু, ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:
আজকাল এসব কেবলই কাঁদায় আমায়।
প্রচন্ড
মারতাম তোকে। কি সুন্দর রেশমী চুল তোর! কাটিনি, বড় করেছিলাম। আর সেই যত্নে
বড় করা চুল ধরেই শক্ত দেয়ালের সাথে তোর নরম মাথা ঠুকিয়ে বলতাম-- মরতে
পারিস না তুই, মরিস না কেনো! তুই কেবলই কাঁদতিস। তবু রাগ কমে না আমার। তোর
ফর্সা গোলাপি গালে ঠাস ঠাস চড় মেরে আঙুলের দাগ ফেলে দিতাম। তোর বাপ তো আমায়
প্রায়ই বলতো, লজ্জা করে না তোর! বেঁচে আছিস যে বড়! আত্মহত্যা করতে পারিস
না? আমার জীবনের সব ঝাল যে আমার তোর পিঠের ওপরই ঝাড়তে হবে। আরতো কোথাও কেউ
নেই আমার। ন'টায় অফিস। তোর বাপ বাজার করতে যাবে সকাল সাতটায়। ফ্রীজ
আছে,তবুও। টাটকা খাবে। মাত্র পাঁচ মিনিটে গোসল করে শাড়ি পেঁচিয়ে বের হবো,
অমনি তুই নেই। প্রায়ই এমন করতিস। হন্যে হয়ে তোকে খুঁজে পাইনা কিংবা পাই
স্বর্ণাদের ঘরে। ধরে এনে ধুমাধুম মার। মারার ও সময় নেই। অফিসে ছুটি।তোকে
মায়ের বাড়ি রেখে তারপর অফিস। কিন্তু অফিসের কাজে কিছুতেই আমার মন লাগে না।
বসকে এটা সেটা মিথ্যা বলে তোর কাছেই ছুটি। তোকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই তোর
প্রশ্ন
আক্কব্বি(আর করবি)?
না মা, আর করবো না।
তোকে বুকে জড়িয়ে চোখের জলে শীতল হবার চেষ্টা কেবল, বৃথাই চেষ্টা। অফিস করি বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে।
প্রতিদিন
প্রতিজ্ঞা করি আর মারবো না তোকে। প্রতিদিন ভঙ্গ করি। আসা যাওয়ার পথে দশ
মিনিট করে হাঁটতে হয়। তোর নাদুসনুদুস শরীর। কিন্তু তুই হাঁটবি না। আমার
ছোটখাটো শরীর। তার ওপর শরীরের ওপর করা অত্যাচার অনাচার যায় কোথায়! তবু এই
শরীরেই তোকে কোলে নিয়েই হাঁটতে হবে আমায়। তাই করতাম। পথে বারবার থেমে
অবশেষে ঘর নামের টর্চার সেলে প্রবেশ। মাঝে মাঝে ঘরে ঢুকেই কষ্টে কান্না
শুরু করে দিতাম। তুই এগিয়ে আসতি আদর করার জন্য, মেজাজ তখন তুঙ্গে। আবার
মারতাম তোকে। জীবনের সব ঝাল যেন তোরই পিঠের ওপর ঝাড়তে হবে আমায়, তুই কেবলই
কাঁদতিস। আমারতো কান্না করারও সময় নেই। এই ঘরের হুজুর আমি, তোকে পড়ানোর
মাস্টার আমি। মাঠ পেরিয়ে কলসী ভরে খাবার পানি আনতে হবে, সেও আমি। কাজের
বুয়াও আমিই।
একদিন সন্ধ্যায় আমি তোকে আদর করার জন্য
হাত বাড়াতেই তুই সরে গেলি। লাফ দিয়ে উঠে পড়লি সোফার টেবিলে। আমি নকশিকাঁথার
কাজ করে মেজেন্টা রঙের একটা ঘাগরাসেট বানিয়ে দিয়েছিলাম তোকে। সেটার নিচের
অংশ উপরে তুলে ধরে আমায় ধমকে বললি-- আগে আমার পা ধরে মাফ চা! ভুলেই
গিয়েছিলাম যে একটু আগেই তোকে মেরেছিলাম আমি। তুই মনে করিয়ে দিতেই আমি হেসে
গড়াই। সেদিনের সেই ছবি এখনও লেগে আছে আমার চোখে।কিন্তু হাসি আর আসে না রে
মা! আমি এখন বদলে গেছি খুব। তুই বদলাসনি। এতো মারের পরও তোর আমাকেই লাগে।
কাক ডাকা ভোরে উঠেই কাজ। তুই যখন উঠতি তখন আমি রান্না আর সমাজবিজ্ঞান পড়া
মুখস্থয় ব্যস্ত ভীষণ। উঠেই তোর হাঁকডাক। আম্মু কোলে নে! আম্মু আদর কর!
ছোটবোন মাঝে মাঝে বাসায় থাকতো। না, সেও বিছানা থেকে তোকে নামাতে পারতো না।
রান্নাঘরের ব্যস্ততা রেখে তোকে আদর করে বিছানা থেকে নামাতে হতো আমাকেই।
তারপর রান্নাঘরেই পাটি বিছিয়ে একই সংগে তোকে পড়াতে হতো। তোর সাত বছর বয়সে
বাবু এলো। ভয়ে ছিলাম তোকে নিয়ে। কিন্তু না, ভাইয়ের জন্য তোর আদরের কমতি নেই
কোনো।
পনেরো ষোলো বছর বয়সে জড়িয়ে পড়লি এক
মাদকাসক্তের সাথে। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি নি। একসময় ঘর ছাড়লি। শেষ
পর্যন্ত পারলিই না। আরো ভুল করা তোকে পেয়েই বসলো যেন। আমিও জীবনযন্ত্রণায়
বিধ্বস্ত খুব। সবমিলিয়ে তোর ওপর অত্যাচারটা বেড়েই গেলো। আমার ওপর হ্যাঁ
শুধু আমার ওপর রাগ করেই তুই চারবার একগাদা করে ঘুমের বড়ি খেলি, নিজেকে শেষ
করে দেবার জন্য। একবার দিলি ফাঁস। ছোট্ট তন্ময় না দেখলে সেদিনই তোর খেলা
শেষ হয়ে যেতো। আমি যখন তোকে ফাঁস থেকে নামাই তখন তুই অজ্ঞান। তবু সেই
অবস্থাতেই আমি তোকে মেরেছিলাম খুব। চারবার ঘুমের বড়ি খাবার জন্য চারবারই
ওয়াশ করা হয়েছিলো তোকে। দ্বিতীয়বার ওয়াশ দেয়ার পর হাসপতাল থেকে তোকে রিলিজ
দিয়েছিলো ডাক্তার। বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য বলেছিলো। কিন্তু আমার যে বাড়ি নেই,
তা কি আর ডাক্তার জানে! আমি বারবার তোর বন্ধ চোখ খুলে পরখ করি তোর চোখের
মণি নড়ে ওঠে কি না! নাহ্ নড়ে না একটুও। স্থির। তুই মৃত। আমি তোকে নিয়ে একা।
ডাক্তারকে বললাম আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে যাই? নিতে পারেন, তবে লাভ নেই। আমি
আমার সিদ্ধান্তে অটল। অফিস শেষ করে, ছোট ভাই এলো। বারো'শ টাকা বের করে বললো
আমার কাছে আর নেই। বলে চলে গেলো। আমি কপালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। ফোন করলাম
দু' জনকে। ভালোই সাড়া পেলাম।
মাইক্রোবাস নিয়ে ঢাকা
মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্যে। সারাটা পথ কেবল মেয়ের নাকের কাছে হাত দিয়ে শ্বাস
পড়ছে কিনা পরখ করছিলাম। আমার মেয়ে নাই। কেবল কাঁদছি আল্লাহকে বলছি আল্লাহ
তুমি পঙ্গু করে হলেও আমার মেয়েটাকে আমার জন্য রেখে যাও। আমি পঙ্গু হলেও ওকে
চাই। রাত সাড়ে তিনটায় ঢাকা পৌঁছাই। আবার ওয়াশ। তখন তোর কোনো চিৎকার নেই।
তোর যে চিৎকার করার শক্তিটুকুও আর নেই। ঢাকা মেডিক্যালের বারান্দায় তোকে
ফেলে রাখা হল আমি তখন প্রথম আলোর পাঠক এর পাতায় টুকটাক টুকটাক লিখি সেই
পাতার বিভাগীয় সম্পাদক এসেছিলেন তোকে দেখতে বেডে উঠানোর জন্য তিনি অনেক
চেষ্টাও করলেন। উঠালো না কেউ। এটা নাকি শাস্তি তোর।এইতো মাত্র সেদিন
দেখলাম, আমেরিকার বিজ্ঞানীরা মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার অনুমতি দিয়েছেন।
ক্লিনিক্যালী মৃত ঘোষনার পর লাইফ সাপোর্টে রাখা যায় আর সেখান থেকেই আবার
জীবিত করার চেষ্টা। বিজ্ঞানে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। আদৌ তাঁরা একাজ করতে
পারবেন কি পারবেন না আমি জানি না। তবে এটা ঠিক যে আমার মনে হয় যে আমি মৃত
তোকেই ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। একটা সময় তুই আমাকে
ছেড়ে চলেই গেলি। এর আগেও গিয়েছিলি। বাপের কাছে। কিন্তু সে কি আর মেহেদী পরা
হাতে এতো বড় একটা মেয়ে রাখতে পারে তার নতুন সংসারে! সে তখন নতুন বর, অন্য
রমণীর। তুই আসলে যাসনি। যেতে বাধ্য হয়েছিস। বাপের কাছ থেকে ফিরে এসে আমাকে
বলেছিলি- মা রে আর একটু হলেই ওখানে আমি দম বন্ধ হয়ে মরেই যেতাম। কতোবার যে
তুই মরতে মরতে বেঁচে উঠেছিস তার কোনো ইয়ত্তা নেই রে মা!
যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেলি তারপর আমি সত্যি মরে গেলাম। এখন আমি নিজেই নিজের লাশ টেনে বেড়াই।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours