fiture
প্রশান্ত ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা: 

'নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়।' 
--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

'বিজেপিকে পছন্দ না করলেও এই ভদ্রমহিলাকে অন্য চোখে দেখতাম। তিনি চলে গেলেন! খুব খারাপ লাগছে!' এটি ফেসবুকে আমাদের এক শিল্পী বন্ধুর পোস্ট। এমন বহু পোস্ট মঙ্গলবার রাত সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হয়েছে। আর এগুলো দেখলেই বোঝা যায় 
সুষমা স্বরাজকে সাধারণ মানুষ কেমন চোখে দেখত। আমাদের এক কবি বন্ধু লিখেছেন, 
'সুষমা স্বরাজ মারা গেলেন। বছর বিশ আগে এই সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম। খারাপ লাগছে।' 
এই যে খারাপ লাগা এটা আপনি দিয়ে গেলেন সুষমা স্বরাজ। এখানেই আপনার সাফল্য। কজন রাজনীতিক মারা গেলে এমন 'খারাপ লাগার' বন্যা বয়। এটা ঠিক যে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ফ্যাশন হয়েছে, কেউ মারা গেলেই নানা রকম পোস্ট আর RIP জানানো। এটাকে বলা যায় নেটিফ্যাশন। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি সুষমা স্বরাজ, আপনার জন্য এই যে 'খারাপ লাগা' এটার বেশিটাই অন্তর খেকে। ভঙ্গি দিয়ে ভোলানো এখানে নেই। এখানেই আপনার জয়। মানুষের মৃত্যু হলে মানব বেঁচে থাকে। আপনি ছিলেন সেই মানবী। 
আমাদের বাংলার কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, 
'মৃতেরা এ-পৃথিবীতে ফেরে না কখনো।
মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?
কোনো-কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের হৃদয়ের পথে ছাড়া 
মৃতের কোথাও নেই বলে মনে হয়;'
আপনিও তেমন বিদেশ-বিঁভুয়ে বিপদে পড়া যে যে দেশবাসীকে উদ্ধার করে এনেছিলেন কিম্বা প্রতিবেশী শত্রুদেশের সেই ছোট্ট মেয়েটাকে এখানে চিকিৎসা করাবার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ভিসা করে দিয়েছিলেন, তাঁদের হৃদয়ের পথে আপনি বার বার ফিরে আসবেন। তাঁরা বলবেন, তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ...আর সেটা ভাল বোঝা গিয়েছিল, যখন আপনার কিডনির অসুখ জানতে পেরে উদ্বেগে ছিলেন বহু মানুষ। এমনকী, কিডনি দেওয়ার জন্যও এগিয়ে এসেছিলেন। আসলে আপনার একটা গ্ল্যামার ছিল। তাই আপনার অনেক ফ‍্যান আছে। আমি তাঁদের দলে নই। ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনও রাজনীতিককে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বাদ দিয়ে বিচার করি না। আর করা যায়ও না বোধহয়। তবু আপনার অসাধারণ ব‍্যক্তিত্ব, বলিষ্ঠ বক্তব্য, সুস্পষ্ট উচ্চারণ আর সদা স্মিতহাস্য ব্যাপারটার প্রশংসা না করে থাকিনি। আমাদের দেশে এখন নয় নয় করে মহিলা রাজনীতিকের সংখ্যা কম নয়, এঁদের মধ্যে নিজগুণেই আপনি উজ্জ্বল। 
আর এই গুণেই সুষমা স্বরাজ ভারতীয় রাজনীতির সেন্ট্রাল স্টেজে চলে এসেছিলেন। আজ মোদীমোহে আচ্ছন্ন বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু একসময় বিজেপির প্রোজেক্টেড প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সুষমা স্বরাজের নাম উঠেছিল। আর এই ওঠাটা কারও কোনও অনুকম্পা বা সদাশয়ের বিষয় নয়, ইংরেজিতে যাকে বলে ডিজার্ভ, সুষমা স্বরাজ সেটা করতেন। নরেন্দ্র মোদীর প্রথম মন্ত্রিসভায় সুষমা স্বরাজকে বিদেশমন্ত্রী করাটাও একপ্রকার বাধ্য হয়েই। কেননা, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে তো আর দুদুভাতু মন্ত্রক দেওয়া যায় না। বিশেষ করে যে নেত্রী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ লোকসভায় বিরোধী দলনেত্রীর পদ সামলে এসেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর পরে তিনিই ভারতের মহিলা বিদেশমন্ত্রী। সুষমা বিদেশমন্ত্রী হিসাবে একাধারে যেমন দক্ষ তেমনই জনপ্রিয় ছিলেন। রাষ্ট্রসংঘে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে সুষমা যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা অভিনন্দন যোগ্য। এছাড়াও বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে সুষমা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর যোগ্যতা। সামলেছেন তথ্য ও সম্প্রচার এবং স্বাস্থ্য দফতরও। তারও আগে কয়েক মাসের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিজেকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। 
আরএসএস ঘরানার মেয়ে সুষমা। বাব হরদেব শর্মা এবং মা লক্ষ্মীদেবী দু'জনেই ছিলেন আরএসএসের সদস্য। স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের মেয়ে সুষমার আরএসএস পরিচালিত অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ(এবিভিপি)'এর হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ। পেশায় আইনজীবী সুষমা স্বরাজ ১৯৭৩ থেকে সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করেছেন। ঐতিহাসিক বরোদা ডিনামাইট মামলায় জর্জ ফার্নান্ডেজের লিগাল ডিফেন্স টিমের কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন সুষমা। 
জরুরি অবস্থার পর যোগ দেন জনতা পার্টিতে। পরে বাজপেয়ী, আদবানির সঙ্গে বিজেপিতে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত হরিয়ানা বিধান পরিষদের সদস্য থাকার সুবাদে মাত্র ২৫ বছর বয়সে সুষমা দেবীলালের ক্যাবিনেটের মন্ত্রী। ২৭ বছর বয়সে হরিয়ানা বিজেপির সভাপতি। হরিয়ানায় বিজেপি সরকার করলে ১৯৮৭–১৯৯০ পর্যন্ত সুষমাই ছিলেন হরিয়ানার শিক্ষামন্ত্রী। ১৯৯০ সালে জাতীয় রাজনীতিতে। এলেন রাজ্যসভায়। আর অল্প দিনের মধ্যেই জাতীয় স্তরের রাজনীতিক হিসাবে জায়গা করে নেন। 
যে রাজনীতি করে সে চুলও বাঁধে। ৪৩ বছরের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবনে সুষমা ছিলেন সুগৃহিণী। ভাল মা। সব ক্ষেত্রেই সফল। শুধু ললিত মোদীকে সহযোগিতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে একটা দাগ রেখে গেছে। যদিও এত মোদীর উত্থান হয়েছে যে ললিত এখন তামাদি। ২০০৪ সালে যখন সনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন চর্চা চলছে, তখন সনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে মন্দিরে গিয়ে মাথার চুল কামিয়ে পাপস্খালনের জন্য নেড়া হওয়ার শপথ করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, এমন শপথটা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে যায় না। বিশেষ করে একজন মহিলা রাজনীতিকের কাছ থেকে যিনি আর একজন নারীকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেবেন না, এটা মানায় না। আসলে এখানেই রাজনীতি আমাদের ছোট মাপের করে দেয়, যেমন সুষমা স্বরাজকে করেছে।
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours