কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
রানুকে নিয়ে হইচই।
হইচই 'পথের পাঁচালি'কে নিয়েও।
দুজনের আবির্ভাবেই 'দূরছাই'। অবহেলিত।
পরে বন্দিত। ভাইরাল। বাইরে স্বীকৃতি পাবার পর।
তবুও বাঙালি নাকি চরম শিল্পবোদ্ধা। তাঁর শিল্পবোধের সামনে দাঁড়ায় কার সাধ্য!
তাহলে কি ছিনতাই হয়ে গেলেন রানাঘাটের রানু মণ্ডল?
"এক পেয়ার কা নগমা হ্যায়
মৌজো কী রওয়ানি হ্যায়!"
নিজের
মনে বসে গাইতেন। এই তো গত মাসের কথা। রানাঘাট স্টেশনের ছ নাম্বার
প্ল্যাটফর্মে নামলেই, কানে আসতে লতা, রফির ওল্ড হিটস। একদিন হঠাতই ফেসবুকে
শোনা গেল, "এক পেয়ার কা নগমা হ্যায়।" তারপরেই ঝড় উঠলো ফেসবুকে। কে এই সহায়
সম্বলহীন মাঝবয়সী মহিলা?
সে সব জানতে না জানতেই, ফের
ভায়রাল ওই মহিলা। এবার খোদ হিমেশ রেশমিয়ার ইনস্টাগ্রামে। মাঝে মাত্র তিন,
চার সপ্তাহের ফারাক। এটুকু সময়ের মধ্যে, রানাঘাটের প্ল্যাটফর্ম থেকে
মুম্বইয়ের রেকর্ডিং স্টুডিওর রাস্তা পেরোলেন রানু মণ্ডল।
রেকর্ডিং
স্টুডিওতে প্ল্যাটফর্মের সেই মহিলা। এত অল্প সময়ে চেহারা বদলায়নি। জেল্লা
তো দূরের কথা, চামড়া চিকনও হয়নি। মুখে সেই চেনা হাসি। প্ল্যাটফর্মেও যা,
রেকর্ডিং স্টুডিওতেও তা। বদলেছে শাড়ি, ব্লাউজ। আর আমূল বদলেছে রানুর বরাত।
বরাত
বদলের বিধাতার নাম অতীন্দ্র চক্রবর্তী। বয়স ছাব্বিশ, পেশায় এঞ্জিনিয়ার।
মলিন শাড়ি গায়ে প্ল্যাটফর্মে বসে রানু। আপনমনে গেয়ে চলেছেন মহম্মদ রফির এক
গান। কানে যেতেই চমকে উঠলেন অতীন্দ্র। বসে গেলেন রানুর গান শুনতে। অতীন্দ্র
অনুরোধেই রানু ধরলেন, 'এক পেয়ার কা নগমা হ্যায়'। 'শোর' সিনেমার সেই
সুপার-ডুপার হিট গান। দিনটা ছিলো, একুশে জুলাই। নিজের মোবাইলেই গানের ভিডিও
রেকর্ড করে ফেললেন অতীন্দ্র। সোশ্যাল মেডিয়ায় শেয়ার করতেই, ভাইরাল হলো
রানুর গান। কানে যেতেই তাজ্জব মুম্বইয়ের সুরকার হামেশাই রেশমিয়া। তার পরের
ঘটনা এগলো ঝড়ের গতিতে।
তবে শোনা যায়, রানুর এক
প্রতিবেশী তপন দাশ। গতবছর অক্টোবর মাসে, তিনিও রানুর গানের ভিডিও শেয়ার
করেছিলেন। তবে যে কোনও কারণেই হোক, তা সোশ্যাল মেডিয়া প্রেমীদের চোখ এড়িয়ে
যায়।
কলকাতা থেকে রাণাঘাট।
কতটুকুই বা দূরত্ব? শিয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেনে চড়ে মোটামুটি আড়াই ঘণ্টার
রাস্তা। মেরেকেটে আটাত্তর কিলোমিটার। কিন্তু রানু কলকাতায় না পৌঁছে, পৌঁছে
গেলেন মুম্বইয়ে। কোন জাদুতে? দেশের মুকুটহীন শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী
কলকাতা। শিল্প সংস্কৃতির মহাজনেরা নাকি গিজগিজ করছেন শহর জুড়ে। প্রতিভা
দেখলেই খপ করে ধরে ফেলেন। ট্যালেন্ট হান্টের সব রাজসূয় যজ্ঞ। বাঙালির মতো
শিল্পের কদর করতে কেই বা জানে? ঘরে ঘরে, গলি মহল্লায় সঙ্গীত চর্চা। তারপরেও
সোশ্যাল মেডিয়ায় ভাইরাল রানু মণ্ডল, বাংলার হাতছাড়া হলেন কিভাবে?
কমপক্ষে
গত দশ বছর নাগাড়ে প্ল্যাটফর্মে গান শুনিয়ে গেছেন রানু। রানাঘাটের মেয়ে।
জন্ম কৃষ্ণনগরে। বয়স যখন বছর কুড়ি, তখন থেকেই পাড়ার ক্লাবে, জলসায় লতার গান
গেয়ে বেড়াতো সেই তরুণী। 'রানু ববি', এলাকার মানুষ তাকে ওই নামেই ডাকতো।
"রোজগার ভালোই হতো," বলেছেন চুয়ান্নর রানু। কিন্তু বাড়ির লোকের নাপসন্দ।
তাই ওখানেই শেষ অধ্যায়। এরপর রানুকে পাত্রস্থ করে নিজেদের দায় সারে পরিবার।
বাবুল মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরেই রানু চলে যান স্বামীর কর্মস্থল
মুম্বইয়ে। মা হলেন এক মেয়ের। কিন্তু মারা গেলেন স্বামী। অগত্যা রানাঘাটে
ফেরত। পেট চলতো ট্রেনে, প্ল্যাটফর্মে গান শুনিয়ে। গানের ফিরিওয়ালা।
প্রায়
বছর দশেক আগেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছিল মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু সুদিনের
সঙ্গে ফেরত এসেছে সেই মেয়ে। এখন মা আর ভবঘুরে না, রীতিমত বলিউডের নেপথ্য
কন্ঠশিল্পী। লক্ষীকান্ত প্যারেলাল জুটির 'এক পেয়ার কা নগমা হ্যায়' থেকে
হিমেশ রেশমিয়ার 'তেরি মেরি, মেরি তেরি কহানি'।
এবার এই সময়কে ফেলে বেশ খানিকটা পিছিয়ে যাই। পঁয়ষট্টি বছর আগের এক শুক্রবার। দিনটা ছিলো ছাব্বিশ অগাস্ট, 1955।
ভবানীপুরের
বসুশ্রী হলে রিলিজ হলো 'পথের পাঁচালী'। শূন্য আসন। "দাদা মাণিকদাকে নিয়ে
হলের উল্টো দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ঠিক কজন দর্শক হলে ঢোকে দেখতে।"
বলেছিলেন দেবজীবন বসু। তাঁর দাদা নির্মলকুমার বসু। টলিউড তাঁকে চেনে
মন্টুদা নামে। বসুশ্রীর কর্ণধার। "খোদ মাণিকদাও বুঝতে পেরেছিলেন, এই সিনেমা
এক সপ্তাহ টানা যায় না।" তবে খাঁটি শিল্পরসিক মন্টুদা ওসব হিসেব কিতেবের
মধ্যে না গিয়ে ছবির নিয়মিত প্রদর্শন করেন। তাতেও মন ভেজে না সংস্কৃতির
পীঠস্থান কলকাতার। এটাই শিল্প সমঝদার বাঙালির খাঁটি সাদাকালো ছবি। সোজা
কথায়, স্বঘোষিত শিল্পপ্রেমিক কলকাতা খারিজ করে দিয়েছিল সত্যজিত রায়ের 'পথের
পাঁচালি'কে। সেদিনও যা আজও তা। পঁয়ষট্টি বছরের ফারাক 'পথের পাঁচালি', রানু
মণ্ডলের মধ্যে। তবু শহরের নাক সেটকানোর ছবিটা আজও একইরকম।
অতীন্দ্র
চক্রবর্তীর মোবাইলবন্দি হয়েই মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন রানু। ফেসবুকে রানুর
ভিডিও শেয়ার করে 'বারপেটা টাউন দ্য প্লেস অফ পিস'। আড়াই লক্ষেরও বেশি
মানুষ ওই ভিডিও দেখে। শেয়ার সাতচল্লিশ হাজারেরও বেশি। তার পরের গোটাটাই তো
ইতিহাস। আর বলিউডের সিলমোহর দেগে দেওয়ার পর তিনি তো স্টার। রীতিমতো
সেলিব্রিটি।
'পথের
পাঁচালি'র পথও প্রশস্ত হয়েছিলো সাহেবদের খেতাব জোটের পর। 1955 সালের 3 মে।
সিনেমার প্রিমিয়ার শো হলো নিউইয়র্ক মিউজিয়াম অফ আর্টে। এরপরের প্রিমিয়ার শো
অ্যাডভার্টাইসিং ক্লাব অফ ক্যালকাটা- এর বার্ষিক অনুষ্ঠানে। কারোর ভালো
লাগলো না নতুনের স্বপ্ন দেখা তরুণ সত্যজিতের ছবি। শুরুতেই সিঁদুরে মেঘ
দেখলেন নব্য পরিচালক। বিশাল পোস্টার, হোর্ডিং নিজের হাতেই তৈরি করে ফেললেন।
নিয়নের আলোয় ছুটে চলেছে দুর্গাঅপু। দর্শকের চোখে পড়ার যাবতীয় কৌশল নিলেন
পরিচালক। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রিলিজ করলো এক আগন্তুক পরিচালকের প্রথম
কাজ, 'পথের পাঁচালি'। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, সব আশায় জল ঢেলে দিলেন তথাকথিত
শিল্পরসিক বাঙালি।
1956
সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। 'বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট অ্যাওয়ার্ড'-এর
বিদেশী মুকুট উঠলো বাংলার খারিজ করা 'পথের পাঁচালি'র মাথায়। আবার কলকাতার
হলে প্রত্যাবর্তন। এবার হিট 'পথের পাঁচালি'। কাঁপিয়ে দিলো বক্স অফিস। আগের
বার সাতদিনের দর্শক জোটেনি। এবার সাত সপ্তাহ ধরে সেই একই সিনেমা দেখলো
বাঙালি। তারিফ আর তারিফ। সাহেবদের রাজমুকুট মাথায় প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেল
অপুদুর্গার আলেখ্য।
এখানেই শেষ না। পশ্চিম বাংলার
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় আয়োজন করে বসলেন সিনেমার এক
স্পেশ্যাল শো। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পরিচালকের শহরে বসে
দেখে গেলেন তাঁর কীর্তি। তাতেও কিন্তু বিবাদ, বিরোধ শেষ হয়নি। সরকারের
মধ্যে থেকেই কড়া বিরোধিতার সুর শোনা গেছিলো সেদিন। কলকাতাতে, দিল্লিতেও।
অভিযোগ, শিল্পের আড়ালে পরিচালক দেশের দারিদ্র্য বেচছেন।
1957 সালের ডিসেম্বরে 'পথের পাঁচালি' দেখানো হলো নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউ প্লে হাউসে। টানা আট মাস দর্শকরা সেই ছবি দেখেছিলেন।
আজ আবার হইচই সেই একদা বাতিল 'পথের পাঁচালি'র পঁয়ষট্টি বছর নিয়ে।
হইচই প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা রানু মণ্ডলের রাতারাতি সেলিব্রিটি হওয়া নিয়েও।
'স্বর্গীয়
কন্ঠ!' ভিডিওতে রানুর গলা শুনেই মন্তব্য করেছিলেন হিমেশ। তারপর একটুও দেরি
করেননি তিনি। 'হ্যাপি হার্ডি অ্যান্ড হির' সিনেমার জন্য গাইয়ে ফেললেন
রানুকে। 'তেরি মেরি, মেরি তেরি কহানি'। তারপরেই সেই গান রেকর্ডিংয়ের দৃশ্য
শেয়ার করলেন তাঁর ইনস্টাগ্রামে। এরমধ্যেই এক লক্ষেরও বেশি মানুষের নজর
কেড়েছেন রানু। বলিউডের নায়ক সুনীল শেট্টি জানিয়েছেন শুভেচ্ছা। মুম্বই থেকে
রানু ফিরতেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়লো মধ্যমগ্রামের এক অনুষ্ঠানের ছবি।
সম্বর্ধনা পেলেন রানাঘাট প্ল্যাটফর্মের সেই হতদরিদ্র রানু। কলকাতাতেও প্লে
ব্যাকের অফার পেয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। গেয়েছেন শহরের কোনও এক নামী
দূর্গাপুজোর থিম সং।
তবে সে যাই হোক, মুম্বই চেনালো বাংলার রানু মণ্ডলকে।
কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চিনিয়েছিলো বাংলার সত্যজিত রায়কে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours