udarbadi
শেখ ফরিদ, উদারবাদী লেখক, বাংলাদেশ:

শেখ ফরিদ একজন দরবেশের(সেইন্ট) নাম। ঢাকায়,একজন পাঁড় নাস্তিকের বাসায় যাওয়ার সময়, সিকিউরিটি আমার নাম লিখতে  বলছিলো, আপনার নাম তো খুব সুন্দর "আল্লার অলির"  নাম! এ কথা আমাকে স্কুলেও কেউ কেউ  বলতো। কলেজেও শুনেছি। আমার মামার বাড়িতে আমাকে কখনো কেবল ফরিদ বলে ডাকা হতো না,  স্যাক (শেখ). ফরিদ বলা হতো। কেন না, তা না হলে নাকি  নামের "শান" বজায় থাকে না। রহমান কে রহমান, আজীজ কে আজীজ বলাও নাকি "শানের" খেলাফ। তাই আব্দুর রহমান, আব্দুল আজীজ বলে ডাকা হতো। ছোট বেলায়, এরকম নাম গুলোর আগে "আব্দুল ও আব্দুর " যুক্ত না করলে ধমক শুনতাম। এখনো দেখি এক শ্রেনীর লোক  "রহমান" কে "রহমান" বললে বাধা দেয়! 

 শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সনদে আমার নামের আগে  মোহাম্মদ নেই।  একটি চাকরির ইন্টারভিউ এ নাম  জানতে চাইলে তাই আমি "শেখ ফরিদ"  বললে, আমাকে যা তা ভাষায়  অপমান করা হয়! কেন "মোহাম্মদ শেখ ফরিদ" বলিনি।  আমি বললাম, আমার নামের আগে মোহাম্মদ নেই, তাই বলিনি। এবার বোর্ডে থাকা দুজন এক যোগে ক্ষুব্ধ হন! মুসলমানের নামের আগে মোহাম্মদ থাকবে না তা কি করে হয়? তাদের ধর্ম ও নামের জ্ঞানের বহর দেখে অনেক কিছু বলার থাকলেও তো আর তখন কিছু বলা যায় না। কেন না, চাকরের তো বাকস্বাধীনতা থাকতে নেই। "চাকরি তো চাকরই!"  চাকর আর বাকস্বাধীনতা এক সাথে যায় না।

আমদের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে; "আমি  আমার ছেলের নাম, মেয়ের নাম" কোরআন দেখে রেখেছি"। পাল্টা প্রশ্ন করা যাবে না, "শয়তান", "" লাহাব," "ফেরাউন", "নমরুদ"  এ সবও তো কোরআনে আছে! মুহাম্মদ, আলী, খাদিজা, উসমান, তালিব, মুত্তালিব, আব্দুল্লাহ, নামগুলো ৫৭০ খৃষ্টাব্দের আগেও ছিলো প্রফেট মোহাম্মদের  জন্মের আগেও। এমনকি  মুহাম্মদ নামটাও রাখা হয় কোরআন প্রচারের ৪০ বছর আগেই!  কোরআন  কোরআন  সম্পর্কে আরবরা জানতে শুরু করে ৬১০ খৃষ্টাব্দে থেকে। আমার মায়ের নামও আমার নানা কোরআন পড়ে রেখেছিলেন। মা ও মামার মুখে শুনেছি। আমার নাম রেখে ছিলেন আমার মামা। মামা এনায়েতপুরের পীরের মুরিদ ছিলেন। সেই পীরের  দরবারে মামাকে জিজ্ঞেস করা হয় আমার বাবার বংশ কি? তিনি বলেন "আমরা  মন্ডল  আমার ভাগ্নেরা "স্যাখ""। তাৎক্ষণিক আমার নাম রাখা হয় শেখ ফরিদ। আমি জানি না, এই নাম রাখার কারনে আমার মামার কত মণ ধান ও বাবার কতটাকা নজরানা( ভেট / উপঢৌকন)  নিয়েছেন সেই পীর সাহেব! 
আমি আমার নাম ও ধর্ম বিশ্বাস পেয়েছি পরিবার থেকে। পরিবার থেকেই শিখেছি।  আল্লাহ আমার মা,বাবাকে ও আমাকে সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবী বানিয়েছেন। আকাশ বানিয়েছেন। সমুদ্র, পাহাড় গাছ পালা সবই। বানিয়েছেন ফেরেস্তা,শয়তান,  দোজখ, বেহেস্ত!  আমার ছোট বোনদের ছোটবেলায় কথা শেখার সময়ই  শেখানো হতো "আল্লা " বলো "আল্লা"  আমি ওদের তা শেখাতাম। বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাকেও তা শেখানো হয়েছিলো।  আমার মেয়ে ও ছেলেকেও তারা মা ও নানী তাই শেখায়! 

 আমার মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতেন।  আমার কিছুটা মনে আছে মায়ের সাথে নামাজ পরতাম। বাবা শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পরার জন্য মসজিদে নিয়ে যেতেন। মামার বাড়ি গেলে তো নামাজ পরা বাধ্যতা মূলক ছিলো। কৃষক  মামাকে দেখতাম কাজের চাপ থাকলে বাহির বাড়ির উঠনেই নামাজ পরতেন। পীর সম্পর্কে জানতে পারি মামার বাড়ির সুবাদে। অবশ্য আমার বড় জ্যাঠার ঘরেও  পীরেরাও আসতো। তবে আমি লক্ষ্য করেছি পীর ও তাদের প্রতিনিধিরা ধনী, সচ্ছল ও ক্ষমতাবানদের ঘরে মেহমান হতেন। আমাকে আমার বাবা ও মামা টাকা দিতেন "পীর বাবাকে"  পা ছুঁয়ে সালাম করে টাকা  নজরানা দিতে। তারা খুব সুখ পেতেন তাদের পুত্র ও ভাগ্নে পীরের পা ছুঁয়েছে বলে। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়ার কারনে আমার নাম হলো মুসলিম নাম, ধর্ম হলো ইসলাম।যদিও আমার বাবার নামে ফারসীর প্রভাব।।ভারত উপমহাদেশে সে নাম মুসলিম নাম হলেও। আরবরা  একজনও সে নাম রাখে না।   উল্লেখ্যে, এ অঞ্চলে ভূমিষ্ঠ হলাম বলে হয়ে গেলাম জামালপুইরা এবং বাংলাদেশী। আমার মা -বাবা  ছিলেন মুসলিম "মমিনসিংঙ্গা "  ও পাকিস্তানি। দাদী -দাদা ছিলেন মুসলিম, মমিনসিংঙ্গা ও (বৃটিশ) ভারতীয়।
আমার বাসার সামনেই ছিলো হিন্দু মহল্লা৷ তারাও আমার মতই সব একই তবে মুসলিমের জায়গায় কেবল হিন্দু শব্দটি বসাতে হবে। আল্লার জায়গায় ভগবান, কৃষ্ণ ও রাম শব্দগুলো। মসজিদের জায়গায় হবে  মন্দীর। তারাও তা  শিখেছে যা  তাদের সনাতনী (হিন্দু)  পরিবারের থেকে যা জেনেছে,শুনেছে শিখেছে বিশ্বাস করেছে। নামে, আচরনে, পোশাকে, আহারেও পরিবর্তন হয়ে গেলো ২০ গজ দুরে জন্ম নেয়ার কারনে। যদিও অধির পোদ্দার ও শেখ ফরিদ পাশাপাশি ঘরের জন্ম নিলো। একই বাজার, হাটে, ঘাটে, মাঠে তারা চলে খেলে খায় খেলে দৌড়ায়! ফরিদ ও অধির সকাল  সন্ধ্যায় মসজিদ ও মন্দীর নামের ১৫ কদম দুরে দুটি উপাসনালয়ে যায়। যদিও তারা একসাথে ঘোড়া চড়ে, ঘোড়া দৌড়ায় এবং ফুটবল খেলে! অধিরদের ১০/১২ টি ঘোড়া ছিলো। যে ঘোড়াগুলো কাপড়ের বোঝা বহনে ব্যবহৃত হতো। এই মহল্লার নামই ছিলো পোদ্দার পট্টি। তখন আমাদের এলাকার পথে ঘাটে গরু ঘোড়া মহিষের গাড়ি ছাড়া আর কিছু চলতো না। আমি ঐ পোদ্দার পট্টিতে একজন হিন্দুকেও গরু পালন করতে দেখিনি। তাদের প্রয়োজন ছিলো ঘোড়া। যা আমার মহল্লার  মুসলিমদের দেখিনি। প্রত্যেক ঘোড়ার পিঠে বড় বোঝা হলে দুটি ছোট বোঝা হলে চারটি চাপিয়ে দিতো। তবে আমার বড় জ্যাঠার ১৭/১৮ টি গরু ছিলো। তাকে কখনো গরু বিক্রি করতে দেখিনি! হালচাষও করতেন না। আমার কাজিনরা খুব বুঝাতেন তবুও বিক্রি করতেন না। যা আমাকে বিস্মিত করতো। গরু জন্ম নিতো, মরে যেতো।  তবে গাভীর দুধ বিক্রি করতেন। গরু মরে গেলে অঝরে কাঁদতেন। যেন তার পরিবারের কেউ মরে গেছে। আমিও কাঁদতাম; তবে  যতটা না গরু মরার জন্য ; তার চেয়ে বেশি জ্যাঠাকে কাঁদতে দেখে। তিনি কোন কোন গরুর নাম রাখতেন হিন্দু নারীর নামে! হিনৃদুয়ানী বলে আমাদের একটি এলাকার নাম বদলে ফেলা হয়। " রাম নগর "থেকে "আরাম নগর"  করা হয়। তিনি রাম নগরকে  কখনই "আরাম নগর" বলেননি। বলতেন "আম নগর", এ অঞ্চলে  অনেকে পুরোনো লোক "রা "  কে  "আা" উচ্চারন করে থাকে।
চতুর্থ কি পঞ্চম শ্রেনীতে প্রথম "নাস্তিক " শব্দটা বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে পড়ি। নাস্তিক =যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। এখন পড়ানো হয় শোনানো হয়, শেখানো হয় ; যে আল্লায় বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক(?) । আসলে  হবে,  যে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না সে  নাস্তিক। 
নাম, শব্দ, শব্দের অর্থ পরিবর্তন অনেক কিছুর ঈঙ্গিত বহন করে। সেখানে রাজনীতি,সমাজনীতি অর্থনীতি, ধর্ম, সম্প্রদায় প্রভৃতি সম্পৃক্ত থাকে। বাংলা যখন মোঘলদের 'সুবা' (প্রদেশ) তখন মুসলিম নাম হলেই বড় পদ পাওয়া যেতো না। তাকে আফগান, তুর্কী  আরব হতে হতো; তা হলে দাস হলেও সমস্যা হতো না চাকুরী পেতে বা বড় পদে আসীন হতে। নাম এমনই যে খিলাফতের সময় আব্বাসীয় ও উমাইয়াদের মধ্যে ছিলো চরম বিরোধ ও ঘৃণা  আরব ও মুসলমান হওয়া সত্তেও! তারা কবর থেকে পরস্পরের লাশ তুলেও শাস্তি দিতো!  খৃষ্টান সম্প্রদায়ও দু ভাগে ভাগ হয়ে শত শত বছর বিরোধে লিপ্ত ছিলো। 
নাম একটা বিষয় আমার এলকার এক ছোট ভাই, নাম মানিক। সে নিজেও কট্টর মুসলিম৷ কেবল নামটি হিন্দুয়ানী মনে হওয়াতে তাকে খিচুরীর সাথে গরুর  মাংস দেয়া হয় নাই! ডিম দেয়া হয় ছিলো। তারাও ছিলো কট্টর মুসলিম তবে অন্যদের মত হিন্দুকে কৌশলে গরুর মাংস না খাইয়ে দিয়ে ডিম ভেজে দিয়েছে। এজন্য তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এক পর্যায়ে সে তার বোনের নাম বলাতে, সবাই অট্ট হাসিতে ফেটে পরে।  এবং তার জন্য গরুর মাংস আনা হয়! 
নাম একটা বিষয়।  ৯৯/৯৮ সালে একবার অবৈধ ভাবে ত্রিপুরায় গিয়েছিলাম। সিআরপিএফ আমাকে তাদের একটি বাসে তুলে নেয়। ভাবলাম জেল নিশ্চিত! আমাকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে আমি সত্য নামই ই বলি। আমাকে ছেড়ে দেয়, এই বলে, ""কেয়া  তিরপুরা কা মোহামেডান হ্যায়! ছোর দো উসকো! তার মানে হলো ভারতীয় 'সেন্ট্রাল রিজার্ভ  পুলিশ ফোর্স ' ত্রিপুরার মুসলিমদের কে সাম্প্রদায়িক বা ঝুকিপূর্ণ মনে করে না!  উল্টোদিকে আসা আরো একটি সিআরপিএফ এর বাসে আমাকে তুলে দেয়, আর বলে, "জারা পুছতাছ কার কে ছোড় দে না!" সে যাত্রায় রক্ষে পাই। কিন্তু কাশ্মীর বা দিল্লী হলে আমাকে  জেলে পচতে হতো! 
নাম  ও ধর্ম পারিচয় একটি বিষয়।  তা,না হলে, ভিনদেশীরা দেশ দখল করে কেউ অঞ্চলের নাম, স্থানের নাম,পথ ঘাটের নতুন নাম বা নাম বদল করতো না। ভারতকে ইন্ডিয়া বানানো হয়েছে। বৃটিশরা দখলে নেয়ার পর  ভারত শব্দ ব্যাবহার করেনি। পুর্ব বাংলার নাম করা হয়েছিলো মাসরিকি পাকিস্তান। বাংলা, পশতুন, পাঞ্জাব ভেঙ্গে এবং সিন্ধ, বেলুচ নিয়ে নাম দেয়া হয়েছে পাকিস্তান।
নাম ও ধর্ম বিশ্বাসের প্রচন্ড শক্তি আছে আমি পাকিস্তানের ক্রিকেট টিম সমর্থন করতাম  পাকিস্তানিরা মুসলিম বলেই যদি ৯২ সালে ক্রিকপট খেলাটিই ঠিক মত বুঝতাম না! আজকের প্রধান মন্ত্রী ইমরান খানের পোষ্টার কিনে ঘরে সাটিয়ে রাখতাম।  আমি ইমরান খানের ভক্ত হই  এলাকার বুয়েটে পড়া একজন বড় ভাইয়ের কাছ থেকে শুনে শুনে।।তিনি ছাত্র শিবির করতেন তবে কোন খেলাতেই তার খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। তাকে আমি কোন দিন কোন খেলাধূলা করতে দেখিনি! 
ছোট বেলায় আমার মামার বাড়ি প্রথম শুনি দাবা খেলা মুসলমানদের নিষেধ! বড় হয়েও শুনেছি। এখনো আপনি যদি কোন মসজিদের 
আশে পাশে দাবা খেলতে বসেন এ কথাটি শুনবেনই কারো না কারো মুখে। 
নাম একটি বিষয়।  নামে তার ধর্ম পরিচয় ও বিশ্বাস চিন্তা  চেতনা, সামনে চলে আসে। কোন মুসলিম মেয়ের নাম পুজা হয় না। রহিমা রাখা হয় না কোন সনাতন ধর্মাবলম্বী মেয়ের। আমাদের পরিবার আমাদের হিন্দু মুসলিম পরিচয়ে বড় করে৷ সমাজ আমাদের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে পৃথক করে ফেলে। রাষ্ট্র আমাদের জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত করে গড়ে তোলে। আমাদের বিশ্বাস, ধর্ম পরিচয় সমাজ রাষ্ট্রের পরিচয় যাই ই হোক, আমাদের আগে শেখানো উচিত, আমরা সকলে মানুষ। আমার নাম ও আমার ধর্ম আমার বিশ্বাস তা শেখায় কি? কেবল আমারটা নয়, আপনার ধর্ম বিশ্বাস ও নাম আপনাকে প্রথমে মানুষ হতে শেখায়! 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours