স্বাতী রায়, লেখিকা ও চিত্রগ্রাহক, কলকাতা:
 
“বেড়াতে যাওয়ায় সব থেকে মনোগ্রাহী ব্যাপার কি?” যদি আমায় কেউ জিজ্ঞাসা করে আমি বলব ওই যাচ্ছি যাচ্ছি ব্যাপারটা, তার উপরে যদি আবার চুরি করে হয়, তাহলে এক্কেবারে সোনায় সোহাগা| অফিসে ছুটি না পাওয়ার কারণে কাল্পনিক গল্প বানাতে হলো অগুন্তি বারের মত এই বারেও| এ ব্যাপারে মিথ্যে বলতে আমার জুড়ি নেই, বিবেকেও বিশেষ বাঁধে না|

এবারে গন্তব্য বাড়ির পাশে আরশিনগর তথা উড়িষ্যা|কলিঙ্গ দেশ নামটি আমাদের সবারই অল্প-বিস্তর পরিচিত ছোটবেলায় বুড়িছোঁয়া করে পড়া ইতিহাস বইতে | কলিঙ্গ বললেই সম্রাট অশোক ও সেই বিদ্ধংসী যুদ্ধ, চন্ডাশোকের ধর্মাশোকে উপনীত হওয়ার গল্প মনে পড়ে| কিন্তু মৌর্য যুগের কলিঙ্গ – ব্রহ্মপুরানে বর্ণিত উৎকল দেশ, আরো অনেক ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই পড়শী দেশটার ভিতর, যার মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে এর নামকরণের একটা ছোট্ট উৎপত্তি – উৎকর্ষ-কলা থেকে উৎকল| অনেকে অবশ্য বলেন উত্তর কলিঙ্গ থেকে উৎকল, কিন্তু আমার প্রথমটি বেশি পছন্দ| নাম নিয়ে পন্ডিতেরা মারামারি করুন, আমরা উৎকলভ্রমনে যাই চলুন|

পুরীধাম থেকে মাত্র ৪৯ কি.মি দুরে অবস্থিত সাতাপাড়া দিয়ে আমরা চিল্কা পৌছলাম –উত্তরে পুরী ডিস্ট্রিক্ট থেকে দক্ষিনে গঞ্জাম ডিস্ট্রিক্ট অবধি ১১৬৫ বর্গ কি.মি বিস্তৃত এশিয়া মহাদেশের এই সবচেয়ে বড় নোনা জলের উপহ্রদ যা বঙ্গোপসাগর থেকে আলাদা হয়ে আছে প্রায় ৬০ কি.মি বিস্তৃত জলাভূমি এবং বালিয়াড়ি সম্বলিত কয়েকটি দ্বীপ দ্বারা| আমরা উত্তরের দিক দিয়ে যাওয়া মনস্থ করেছিলাম, এক তো সময় বাঁচানো, দ্বিতীয়ত ডলফিন দেখার লোভে| এক ঘন্টা অটোতে বসে একঘেয়ে ঘুটঘুট আওয়াজে ক্লান্ত হয়ে চোখ লেগে এসেছিল, সঙ্গে রাতের ট্রেনজার্নির ক্লান্তি - হঠাত চোখ খুলে গেল ঝিরঝিরে নোনা হাওয়ায়, তাকিয়ে দেখি দিগন্তে নীল্ জলের রেখা| একটি ব্রীজ পেড়িয়ে ঢুকে পরলাম চিল্কা ঝিলের দেশে, রাস্তার পাশে পাশে পুরো উড়িষ্যা ট্যুরিসম এর বাংলো পর্যন্ত একচিলতে চিল্কারানী সঙ্গে এলো আমাদের স্বাগত জানাতে| সাতাপাড়া উড়িষ্যা ট্যুরিসম এর সুন্দর সাজানো রিসর্টটা দেখে প্রথমেই মন উৎফুল্ল , তার পর সংলগ্ন ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে সামনে দিগন্ত বিস্তৃত চিল্কা দেখে আমাদের আর পায় কে!সারা রাত্রিব্যাপী দীর্ঘ ট্রেনজার্নিও আমাদের কাবু করতে পারেনি| কোনো মতে জলখাবার খেয়েই আমরা একদম তৈরী নৌকো ভ্রমন এবং ডলফিন দর্শনের জন্যে| পান্থনিবাস থেকেই ডলফিন দেখা ও বঙ্গোপসাগর লাগোয়া দ্বীপ বেড়ানোর নৌকো ছাড়ে, মাথাপিছু ২০০ টাকা, ঘন্টা চারেকের বেড়ানো| আমরা দ্বিপ্রাহরিক রাজকীয় আহারের ব্যবস্থা করে ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পরলাম| নৌকোয় জনা ১৮ ভ্রমণপিয়াসী, প্রায় প্রত্যেকেই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে ক্যামেরা তাক করে  বসে, ডলফিন দেখতে পেলেই ক্যামেরাবন্দী করবে বলে, আমরাও বাদ নেই| আমার যদিও বেশি আগ্রহ তখনো অবধি চোখের দেখাতেই ছিল, ক্যামেরায় হাত ছোঁয়াইনি প্রথম ১ ঘন্টা| 
প্রচন্ড গরম, আর্দ্র আবহাওয়া সব পেরিয়ে সলোমন ও নেফারতিতি আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ করতে কার্পন্য করেনি| আমরা খোশমেজাজে রাজহাঁস দ্বীপ পৌছলাম| এখানে একটি ছোট্ট টিলা আছে যেখান থেকে একদিকে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর ও অন্য দিকে চিল্কা ঝিল এবং ইরাবতি নদীর মোহনা দেখতে পাওয়া যায়, উপরিপাওনা বালির টিলার জঙ্গলে নানান রঙের গিরগিটি ও সরীসৃপ, প্রজাপতি, পাখি ইত্যাদি - ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারদের স্বর্গ| 
সামনা সামনি পর পর তিন-চারটি ঝুপড়ি, সেখানে ইচ্ছেমতো বেছে নিতে পারেন সামুদ্রিক কাঁকড়া – চিংড়ি – পমফ্রেট ইত্যাদি মাছ, বললে তারাই ভেজে গরমাগরম সামুদ্রিক স্বাদের খাবার আপনার সামনে হাজির করবে | সাথে বেছেনিন উপকূলীয় ডাবের জল বা মালীয় ঠান্ডা বিয়ার|
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours