কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
ঠিক কতটা পথ পেরোলে, পথিক বলা যায়?
ঠিক কতদিন স্থায়ী হলে, তাকে অস্থায়ী বলা যায়?
দ্বিতীয়
প্রশ্নটির উত্তর কে দেবেন? কংগ্রেসের গুলাম নবী আজাদ, মণীশ তিওয়ারি নাকি
অধীর রঞ্জন চৌধুরী। রাহুল গাঁধির টুইটের অপেক্ষা করতে গেলে তো বিপদ।
কুম্ভকর্ণের ঘুম। সেই ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা বয়ে যায়। রাজ্যসভায় জম্মু
কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল পাস হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পর, টুইট করার সময় পেলেন
তিনি।
বাড়িটা নিজের। আর
সেই নিজের বাড়িতেই মামাবাড়ির আবদার, আদরে বেশ ছিলেন কাশ্মীরের রাজনৈতিক
অভিভাবকরা। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, ধারা 370 এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। সেদিন
শেখ আবদুল্লার প্রস্তাবেও রাজি হননি প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল
নেহরু। তাই সংবিধানে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা নিয়ে 370 ধারার
অন্তর্ভুক্তি হয়েছিল অস্থায়ী হিসেবেই। সেকথা স্বীকার করেছিলেন খোদ শেখ
আবদুল্লাও।
কিন্তু তাতে কী? কংগ্রেসের নেহরু পরবর্তী
নেতারা পারলে ওই ধারাকে স্থায়ী করেই আজম্ম রেখে দিতেন। ঠিক যেমনটা
রেখেছিলেন গত সত্তর বছর ধরে। রাজ্যসভা, লোকসভায় দলের সাংসদদের জ্বালাময়ী
ভাষণ শুনে তেমনটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু নেহরুই বা সেদিন আগ বাড়িয়ে, শেখ
আবদুল্লাকে কেন ওই ধারার খসড়া তৈরি করতে বলেছিলেন? বিশেষ করে যখন শঙ্কা
লুকিয়ে ছিল তাঁর মনের মধ্যেও। আর নেহরুর সেই আশঙ্কা যে ভ্রান্ত ছিল, জম্মু
কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাস তা বলে না।
"শ্রীনগরের
কিছু বাস্তুঘুঘু জাতীয়তাবাদের ধুঁয়ো তুলছে। মানুষের পুরনো আবেগ উসকে দিয়ে
মদত দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের।" মাত্র কয়েকদিন আগেই, এক সংবাদমাধ্যমকে
একথা বলেন করণ সিং। জম্মু কাশ্মীরের ডোগরা রাজত্বের শেষ মহারাজ হরি সিংয়ের
ছেলে। কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্য। কাশ্মীরের প্রথম রাজ্যপাল ছিলেন
এই করণ সিং।
সংযুক্তিকরণ
না, সড়ক না, মানচিত্র না, সংবিধানও না। একমাত্র ধারা 370 কাশ্মীরের সঙ্গে
সেতুবন্ধন করছে ভারতের। সোমবার রাজ্যসভায়, মঙ্গলবার লোকসভায়, এমনটাই
বোঝানোর চেষ্টা চালায় কংগ্রেস। ইতিহাস কী বলে?
1947
সালের 26 অক্টোবর। কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের সংযুক্তিকরণে(instrument of
accession) সইসাবুদ করলেন মহারাজ হরি সিং। চুক্তিতে সিলমোহর পড়লো পরদিনই।
প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি আর ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগ
ব্যবস্থা, জম্মু কাশ্মীরের এই তিনটি ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার গেল
দিল্লির হাতে, জানান করণ সিং।
ওদিকে জম্মু কাশ্মীরকে
সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে শর্ত আরোপ করে দিল্লিও। সেই শর্তমাফিক কাশ্মীরের
ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা শেখ আবদুল্লা জম্মু কাশ্মীর সরকারের 'হেড অফ
এমারজেন্সি অ্যাডমিনিসট্রেশন' এর কুর্শিতে চড়ে বসলেন। এক বছর কাটতে না
কাটতেই, আবদুল্লা হলেন প্রধানমন্ত্রী, আর 'প্রিন্স রিজেন্ট' হলেন মহারাজ
হরি সিংয়ের ছেলে করণ সিং। তখন জম্মু কাশ্মীরের মর্যাদা ছিল প্রিন্সলি
স্টেট- এর।
ভারত জম্মু
কাশ্মীর সম্পর্কের শেষকথা সংযুক্তিকরণ, একথা নেহরুকে লেখা এক চিঠিতে(জুলাই
4, 1953) স্বীকার করেছিলেন খোদ আবদুল্লা। তিনি লেখেন, 370 ধারা সংযোজন
হলেও, আমরা সর্দার প্যাটেলের কথায় আশ্বস্ত হই যে সংযুক্তিকরণের শর্ত মেনেই
ভারত জম্মু কাশ্মীরের সম্পর্ক চূড়ান্ত হয়েছে। আয়েঙ্গার তখনই জানিয়ে দেন যে
370 ধারা কোনও স্থায়ী ব্যবস্থা না। উপযুক্ত সময়ে তা খারিজ হয়ে যাবে।
এরপরেও
কংগ্রেস কিভাবে দাবি করে ধারা 370 জম্মু কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের সেতুবন্ধন
সূত্র, তা বোঝা মুশকিল। হতে পারে এ ব্যাপারে কংগ্রেসের অজুহাত ছিল,
কাশ্মীরের শেষ যুবরাজ করণ সিংয়ের বক্তব্য। 2016 সালে রাজ্যসভায় বক্তব্য
রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, "জম্মু কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র এবং
কাশ্মীরের সংবিধানের পাহারাদার ধারা 370।" তবে সংযুক্তিকরণ নিয়ে কোনও
প্রশ্নই উঠতে পারে না, একথাও এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন করণ সিং। কাজে
লাগবে না বুঝে, করণ সিংয়ের সেই বক্তব্য চেপে যায় কংগ্রেস।
সাল
1949। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু শেখ আবদুল্লাকে বললেন কাশ্মীরের জন্য মানানসই
এক খসড়া তৈরি করতে। এ ব্যাপারে তৎকালীন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ভীমরাও
আম্বেদকরের সঙ্গে কথা বলতেও বললেন। আবদুল্লা সেই মতো কথা বলতে গিয়ে বিষম
জোর এক ধাক্কা খেলেন। তাঁর গোটা প্রস্তাবকে শুধু উড়িয়ে দিলেন তাই নয়,
প্রচন্ড খেপে গেলেন আম্বেদকর। মেজাজ হারিয়ে তিনি বলেই ফেললেন, ভারত
কাশ্মীরকে খাওয়াবে পড়াবে, তার সীমান্ত পাহারা দেবে। কিন্তু ভারতীয়দের কোনও
অধিকার থাকবে না কাশ্মীরে। এটা হতে পারে না। এমন জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ
তিনি করতে পারবেন না। সোজা রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন শেখ আবদুল্লাকে।
কিন্তু,
সম্রাটের কৃপাদৃষ্টি থাকলে উজির মন্ত্রীর ক্ষমতা কি কিছু করার? নেহরুর
ইচ্ছেতেই 370 ধারার খসড়া তৈরি করার ভার পড়লো মন্ত্রকহীন মন্ত্রী
গোপালস্বামী আয়েঙ্গার ওপর।
আয়েঙ্গার কেন?
কারণ
তিনি ছিলেন মহারাজ হরি সিংয়ের জম্মু কাশ্মীরের দেওয়ান। নিজে একজন কাশ্মীরী
হওয়ায় নেহরু জানতেন, গোটা কাশ্মীর উপত্যকাকে হাতের তালুর মতো চেনেন
আয়েঙ্গার। খসড়া তৈরি করতে বসে পড়লেন আয়েঙ্গার। প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশনীতি
আর যোগাযোগ ব্যবস্থা রইলো দিল্লির জিম্মায়। বাকী সব ব্যাপারেই স্বতন্ত্র
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গেল জম্মু কাশ্মীরের হাতে। ঘটনার শেষ এখানেই না।
এ
পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিলো। বাদ সাধলো আবদুল্লার সীমাহীন উচ্চাশা। তিনি
চাইলেন ধারা 370- এর স্থায়ী বন্দোবস্ত করতে। এবার বেঁকে বসলেন নেহরু। ঘুড়ির
সুতো ঠিক কতটা ছাড়লে নিরাপদ, তা ভালভাবেই জানতেন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ
নেহরু।
সাল 1949। এক অস্থায়ী বন্দোবস্তে ভারতীয়
সংবিধানে জায়গা করে নিল ধারা 307। ওই ধারাতেই জম্মু কাশ্মীরের হাতে ছাড়পত্র
তুলে দেওয়া হলো স্বতন্ত্র সংবিধান, পতাকার। সেই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা জারি
হলো, ওই রাজ্যে দেশের অন্য কোনও প্রদেশের মানুষের সম্পত্তি কেনাবেচার ওপর।
সেসময় পাসপোর্ট ছাড়া জম্মু কাশ্মীরে ঢোকা ছিল বেআইনি। তবে ঠিক কী কারণে
নেহরু কাশ্মীরের জন্য ওই খসড়া তৈরি করতে বলেছিলেন, তা নিয়ে নানা মুনির নানা
মত।
তবে সে যাই হোক না কেন, অঙ্কের হিসেব বলে, ধারা
370 সংবিধানে সংযোজন হওয়ার ঝাড়া দু'বছর আগেই হরি সিং তাঁর রিয়াসত জম্মু
কাশ্মীরের, ভারতভুক্তি চুক্তিপত্রে সাইন করেছিলেন। সেদিনই সেতুবন্ধন হয়ে
গেছিল জম্মু কাশ্মীর, ভারতের। করণ সিংয়ের গলাতেও একই সুর শোনা গেছিল এক
ইংরেজি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে। "আইন, নীতি- নৈতিকতা আর রাজনৈতিক
বিচারে জম্মু কাশ্মীর ভারতের অভিন্ন অঙ্গ। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশ
নেই।" স্বাভাবিকভাবেই, কংগ্রেস আজ সংযুক্তিকরণের যে তত্ত্ব তুলে ধরছে, তা
যুক্তিহীন।
1952 সালে
বিধানসভা নির্বাচন হলো জম্মু কাশ্মীরের। তারপরেই প্রিন্সলি স্টেটের খেতাব
হারালো জম্মু কাশ্মীর। যুবরাজ করণ সিং, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হয়ে
পদমর্যাদা পেলেন 'সদর-ই-রিয়াসত'- এর। এরও দু'বছর পর ভারতের সংবিধানে জায়গা
করে নিলো '35 এ' ধারা। তারিখটা ছিল 14 মে,1954 সাল। ওই ধারাতেই ব্যাখা
দেওয়া হলো কাশ্মীরী আর বহিরাগতের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, জম্মু
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে আরও সুনির্দিষ্ট করতেই আমদানি করা হয়েছিল 35এ।
সংবিধানে 370 ধারা সংযোজন করে, জম্মু কাশ্মীরের মাথায় বিশেষ খেতাব চড়ানোর নেপথ্য কারিগর কী একা নেহরুই?
কংগ্রেস
কিন্তু বারেবারে এ কথায় আপত্তি জানিয়েছে। দলের তরফ থেকে এমনও দাবি করা
হয়েছে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সিলমোহর নিয়েই
ওই ধারা সংবিধানে জায়গা করে নেয়।
এক পক্ষের মত,
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা নিয়ে নিজের আপত্তির কথা সরাসরি নেহরুকে জানিয়ে
দিয়েছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাই জুনাগড়, হায়দরাবাদ সংযুক্তিকরণে
প্যাটেলের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গিয়েছিল, জম্মু কাশ্মীরের বেলায় তা
চোখে পড়েনি।
আরেক পক্ষের মত, ধারা 370- এর খসড়া তৈরি
করার পর আয়েঙ্গার তা প্যাটেলের কাছে পাঠান। তিনি বলেন, "নেহরু ওই খসড়া
আবদুল্লার কাছে পাঠানোর আগে, আপনি একবার দেখে নিন। তারপর আপনার মতামত
সরাসরি জানিয়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে।" বৈঠক বসেছিল প্যাটেলের
বাড়িতেই। নেহরুর সঙ্গে আলাপ আলোচনায় সম্ভবত খুব খুশি হতে পারেননি সর্দার।
তবে তিনি আয়েঙ্গারকে বলেন কাজ চালিয়ে যেতে।
ওদিকে
সমানে হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছেন আবদুল্লা। কাশ্মীরিদের মৌলিক অধিকারে, হাত
দেওয়া চলবে না। দিল্লির নির্দেশনামার কোনটা মানা হবে আর কোনটা হবেনা, তা
ঠিক করবে জম্মু কাশ্মীর বিধানসভা। অন্যথা হলে, তিনি কনস্টিটিউয়েন্ট
অ্যাসেম্বলি থেকে ইস্তফা দেওয়ার হুমকিও দিয়ে রাখলেন।
এরই
মধ্যে বিদেশ সফরে গেলেন নেহরু। 1949 সালের 3 নভেম্বর, প্যাটেল নেহরুকে
জানালেন, দলের সবার সঙ্গেই আলোচনা করেছেন। কোনমতে তাঁদের রাজিও করাতে
পেরেছেন সংবিধানে 370 ধারার অন্তর্ভুক্তিতে সম্মতি দিতে। নেহরুকে ফিরে আসতে
বললেন প্যাটেল।
বিবাদের
শুরু ঠিক এ জায়গাতেই। কোনও রাখঢাক না করে, সর্দার প্যাটেলের দিকে আঙুল
তুলেছেন শিবসেনা নেতা সঞ্জয় রাউত। দলের মুখপত্র 'সামনা'য় তিনি লিখেছেন, 370
ধারায় কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার জন্য একমাত্র জওহরলাল নেহরুর ঘাড়ে
দোষ চাপালে চলবে না। ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও।
সত্যি কি তাই? যত দোষ নন্দ ঘোষ, হয়ে যাচ্ছে নাতো!
কারণ
সেরকমই ইঙ্গিত মিলছে হরিয়ানার সোনিপতের অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক এবং ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রীনাথ রাঘবনের লেখায়। মন্ত্রকের
তথ্যপ্রমাণ, প্রতিরক্ষা কমিটির মিটিংয়ের রিপোর্ট প্রভৃতি ঘেঁটে একটা সত্যই
উঠে আসছে। জুনাগড়, হায়দরাবাদ, জম্মু কাশ্মীরের সব সমস্যার সমাধানে নেহরু,
প্যাটেল হাত মিলিয়েছিলেন। নেহরু প্রায় কখনোই এক তরফা সিদ্ধান্ত নেননি।
তাঁদের মতভেদ থাকার কথা স্বীকার করে রাঘবন লিখছেন, কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে
আসার আগে একে অন্যের সঙ্গে অবশ্যই শলা- পরামর্শ করে নিতেন।
প্রায়
একই কথা শুনিয়েছেন আরেক নামজাদা ইতিহাসবিদ এজি নুরানি। তাঁর বক্তব্য,
জম্মু কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেছিলো সর্দার প্যাটেলের বাড়িতে বসেই।
পরপর দুদিন, 15 আর 16 মে, 1949, আলাপ আলোচনা চলে। বৈঠকে আবদুল্লাকে সঙ্গে
নিয়ে হাজির ছিলেন খোদ নেহরু। সেসময় আলোচনা হয়েছিল জম্মু কাশ্মীরের সংবিধান
রচনা আর কেন্দ্র- রাজ্যের ক্ষমতা বন্টন প্রসঙ্গে। ধারা 370 নিয়ে লেখা তাঁর
'আ কনস্টিটিউশন্যাল হিস্ট্রি অফ জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর' বইয়ে নুরানি খুব
স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, 370 ধারা নিয়ে নেহরুর সঙ্গে কখনও কোনও বিবাদ
বাঁধেনি প্যাটেলের।
ওদিকে
জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও
সম্পর্ক তিক্ত হয় নেহরুর। ওই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ যায়
শ্যামাপ্রসাদের। তাঁকে চক্রান্ত করে মেরে ফেলার অভিযোগ করেছিলেন প্রয়াত
প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়িও।
শ্যামাপ্রসাদের
রাজনৈতিক উত্তরসূরি বিজেপি নেতারা সে ঘটনার কথা মনে রেখেছিলেন। 1991 সালে,
প্রয়াত নেতা শ্যামাপ্রসাদের দেখানো রাস্তাতেই 'ভারত যাত্রা'য় নেমেছিলেন
মুরলীমনোহর যোশি। সেই যাত্রায় যোশির সঙ্গী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি।
কন্যাকুমারী থেকে শ্রীনগরের ওই যাত্রা শুরু হয় ডিসেম্বরের 11তারিখ।
শ্রীনগরে যাত্রা শেষ হয় পরের বছর 26 জানুয়ারি। শ্রীনগরের লালচকে ভারতের
তেরঙ্গা ওঠানোর সময় ফের শোনা গেছিলো 'এক দেশ এক পতাকা'র অঙ্গীকারের কন্ঠ।
সম্প্রতি
সোশ্যাল মেডিয়ায় মোদির ভাইরাল হওয়া এক ছবি শেয়ার করেছিলেন বিজেপি'র সাধারণ
সম্পাদক রামমাধব। ছবির পেছনে 370 ধারা হটানোর শ্লোগান। 'ভারত যাত্রা'র সময়
ছবিটা তোলা হয়েছিল বলে এক প্রথম সারির ইংরেজি ম্যাগাজিনের দাবি।
তবে
বহু বিতর্কিত এই ধারা নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন কালের গর্ভে তলিয়ে
যাওয়া ডোগরা রাজবংশের শেষ যুবরাজ করণ সিং। "ধারা 370 আর 35এ নিয়ে
পুনর্বিবেচনা করার সময় পা বাড়াতে হবে অতি সাবধানে। কারণ সেখানে আইনগত,
নীতিগত, সাংবিধানিক দিক ছাড়াও রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। জড়িয়ে আছে
রাজ্যের মানুষের আবেগ। সবদিক বিবেচনা করেই এগোতে হবে।"
আজ
জম্মু কাশ্মীর নিয়ে কংগ্রেসের যে আবেগ উপচে পড়ছে, তার কতটুকু খাঁটি তা
নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর দিল্লিতে কাটানোর অভিজ্ঞতা
প্রসঙ্গে অষ্টআশি বছরের প্রবীণ যুবরাজের আফশোস, সবাই বলে, কাশ্মীর হমারা
হ্যায়। কিন্তু কাশ্মীরদরদী কাউকে দেখিনি। ঠিক একইরকমভাবে পাত্তাই পায়নি
করণ সিংয়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও। জম্মু কাশ্মীর- ভারত সম্পর্কের নবনির্মানে
উপেক্ষিতই থেকে গেলেন তিনি।
ধারা
370, 35এ সংযোজনের মূল কারিগর যে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, তা নিয়ে কোনও
বিতর্ক নেই। বিতর্ক ওই দুই ধারার সংযোজনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার
বল্লভভাই প্যাটেল, নেহরুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কিনা সেই প্রসঙ্গে। তবে ধারা
বিলুপ্তির সঙ্গে, তার সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও আগ্রহ হারাবে মানুষ। এবার মনে
জায়গা করে নেবে বিলুপ্তির ইতিহাস। মধ্যের এই ছোট সময়টাতে কিছু রাজনৈতিক
কাদা ছোড়াছুড়ি তো চলবেই।
তবে
বিজেপির রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় স্পষ্ট, জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা
অবলুপ্তিকে পাখির চোখ করে এগিয়ে গেছিলেন দলের বিভিন্ন প্রজন্ম নেতারা।
প্রয়াত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সেই অসমাপ্ত আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছিলেন
মুরলীমনোহর জোশীর মতো দলের প্রথম সারির নেতারা। উত্তরাধিকার সূত্রে সেই
অধরা স্বপ্নপূরণের দায় বর্তায় নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহর ওপরে। সময়ের সঙ্গে
তাল মিলিয়ে দলে নেতার মুখ বদল হয়েছে, লক্ষ্য বদলায়নি।
5
অগাস্ট, 2019। রাজ্যসভায় পেশ হলো জম্মু কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল। নেহরুর
সত্তর বছরের পুরনো অস্থায়ী ধারার এক্সপায়ারিতে সংসদ পাসের সিলমোহর দেগে
দিতেই, শেষ হাসি হাসলেন মোদি- শাহ জুটি। বহু প্রতিক্ষিত স্বপ্নপূরণ হলো
বিজেপি'র। বিশেষ রাজ্যের তকমা হারালো জম্মু কাশ্মীর। ভূস্বর্গ মিলেমিশে
একাকার হয়ে গেল 'সুজলাং সুফলাং' ভারতের সঙ্গে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours