সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর:
১৫ই আগস্ট এই দিনটি আমাদের কাছে শুধু স্বাধীনতা দিবসই নয়, আজ থেকে প্রায় ১৬৫ বছর আগে এই দিনটিতেই বাংলার বুকে সংঘটিত হয়েছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা যাকে বলা যেতে পারে সত্যিকারের বিপ্লবের সূচনার এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস । ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম রেল চলাচলের সূত্রপাত হয়েছিল এই বাংলার বুকে । তবে এই শুভারম্ভের ইতিহাসের পিছনে অনেক উত্থান পতনের ইতিহাসও আছে ।
১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডে যখন প্রথম রেলইঞ্জিন চালু হলো তখন চার্চের পাদ্রীরা এই যন্ত্রদানবের বিরুদ্ধে প্রভূত বিষোদগার শুরু করে দিল । এই বাষ্পীয় যানকে শয়তানের প্রতিভূ হিসাবে চিহ্নিত করে যথেচ্ছভাবে প্রচার চলল । এই ধরনের অপপ্রচারের দরুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথমে এদেশে বাণিজ্যিকভাবে রেলগাড়ি চালু করতে রাজি হয়নি । রক্ষনশীল ভারতীয় সমাজে রেলপথ কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে সে সম্পর্কে তাঁরা সন্দিহান ছিলেন । তবে ১৮৪৩ সালে মিঃ রোনাল্ড স্টিফেনসন নামে এক ভদ্রলোক কোস্পানির কাছে যাতায়াতের সুবিধার্থে ভারতবর্ষের সর্বত্র রেলগাড়ি চালাবার জন্য সুপারিশ করে বসেন । এই উদ্দেশ্যে ১৮৪৬ সালে কোলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত তিনি একটি সার্ভে করেন । সার্ভে পর্যালোচনা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে কলকাতা থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে রেলগাড়ি চালাবার অনুমতি দেয় । ঐ সময় জর্জ টার্নবুল নামে এক ইঞ্জিনিয়ার স্টিফেনসন সাহেবকে রেলপথ নির্মাণে বিশেষভাবে সাহায্য করেন । এইভাবে ১৮৫৩ সালে রেলপথ তৈরি হয় হাওড়া হতে পান্ডুয়া পর্যন্ত । মুম্বাইয়ের আগেই বঙ্গদেশে হতে প্রথম রেলগাড়ি চালাবার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় । কিন্তু অকস্মাৎ দুটি বাধা এসে এই যাত্রাকে বিলম্বিত করে দেয় । প্রথমত, এইচ এম এস গুডডইন নামে যে জাহাজটি ইংল্যান্ড থেকে বগিগাড়ির মডেল-নক্সা-ড্রইং সমেত কোলকাতায় আসছিল সেটি হুগলী নদীতে ডুবে যায় । আর যে কটা ইঞ্জিন ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো হল সেগুলি ভুল করে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গেল । এদিকে চন্দননগর ফরাসীদের অধীনে থাকায় সেই এলাকায় রেলপথ পাতার সময় রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিল । অবশেষে অনেকে আলোচনার পর সমস্যার সমাধান হলে কলকাতায় ঘোড়ার গাড়ি তৈরির দুই সাহেব কোম্পানি সেটন এবং স্টুয়ার্ডকে রেলের কামরা তৈরির বরাত দেওয়া হল । এদিকে কিছু দিন পরে একটি জাহাজে অস্ট্রেলিয়া থেকে ইঞ্জিন ফেরত নিয়ে আসা হল । ২৮ জুন ১৮৫৪ সালে মিঃ হজসন নামে এক ইঞ্জিনীয়ার পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম হাওড়া থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত রেলগাড়ি চালিয়ে পরীক্ষা করেন । সেই বছরই ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া হতে হুগলী পর্যন্ত প্রথম নিয়মিতভাবে রেলগাড়ি চলাচলের সূচনা করা হল । ২৮ মাইল অতিক্রম করে হুগলী পৌঁছাতে সেদিন সময় লেগেছিল ৯১ মিনিট । প্রায় তিন হাজার আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র কয়েক’শ যাত্রীর সৌভাগ্য হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক যাত্রায় । তিনটি প্রথম শ্রেণী, দুটি দ্বিতীয় শ্রেণি, তিনটি ছাদবিহীন কামরা ও একটি গার্ড ব্রেকভ্যান সমেত গাড়িটি থেমেছিল শুধু বালি, শ্রীরামপুর ও চন্দননগরে । সেদিন যাত্রার প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল তিন টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির এক টাকা দু আনা এবং তৃতীয় শ্রেণি সাত আনা ।
সাড়ম্বরে এই রেলযাত্রার যাত্রীদের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া তৎকালীন বেঙ্গল হরকরা পত্রিকা থেকে কিছু কিছু জানা যায় । রূপচাঁদ ঘোষ নামে চিনা বাজারের এক আতর ব্যবসায়ী হুগলিতে নেমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না কি করে এত দ্রুত তিনি গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলেন । হুগলী স্টেশনে নেমে সকলকে জিজ্ঞেস করতে থাকেন এটা সত্যিই হুগলী কিনা । পন্ডিত রাধাশঙ্কর ব্যানার্জি নামে একজন জ্যোতিষী বহু গণনার পর রেলগাড়িতে উঠলেও ফেরার পথে তিনি গাড়িতে ওঠেননি । কেননা তাঁর ধারণা হয়েছিল রেলগাড়ির অত্যাধিক গতির জন্য তাঁর আয়ুক্ষয় হয়ে যাবে ।
রক্ষণশীল ভারতীয়রা কিন্তু অনেক সহজেই ইংরেজদের তুলনায় রেলইঞ্জিনকে সহজভাবে গ্রহণ করেছিল । ইংল্যান্ডে চার্চের পাদ্রীদের বক্তব্য ছিল তীব্রগতিতে ধাবমান এই বাষ্পীয় শকটকে দেখে মানুষ পাগল হয়ে যাবে, গোরুতে দুধ দেবে না, মুরগীতে ডিম পাড়বে না, আবহাওয়ায় পরিবর্তন দেখা দেবে । সেরকমভাবে কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে কোন অন্ধ ভুল ধারণা গড়ে ওঠেনি । ভারত দর্শনে এসে মার্ক টোয়েন লিখেছেন, “রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম ও স্টেশন যেন লোকজনের ঘরবাড়ী । যাত্রার কয়েকদিন আগেই তারা স্টেশনে আসে । স্নান, খাওয়া-দাওয়া সবই প্ল্যাটফর্মে করে । টিকিট ঘরের সামনে সকলে মিলে জড় হয়ে বসে থাকে আর টিকিটের দাম নিয়ে বহুক্ষণ দরকষাকষি করে ।”
এই ১৬৫ বছর পরেও ভারতীয় রেল এই দেশের জনমানসে বিশেষ করে সাহিত্য ও সিনেমায় বিষয়বস্তু হিসাবে সমানভাবে উপজীব্য । ‘পথের পাঁচালী’-তে অপু-দূর্গার রেল দেখার বিস্ময় এখনও যেন আমাদের শৈশবের কথা স্মরণই করিয়ে দেয় । কত গান, কতও গল্প, কত ছড়া, আজও মুখে মুখে ফেরে এই রেলগাড়ি নিয়ে । হুতোম, প্যারীচাঁদ, দেবেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, বনফুল কেউই এড়িয়ে যেতে পারেননি রেলগাড়ির সাহিত্যরসকে । তবুও যেভ বড়ই বেমানান লাগে সেদিনের বাংলার এই প্রবাদটিকে “জাত মারল তিন সেনে/ইস্টিশনে, উইলসনে, কেশব সেনে ।” সত্যি, ভারতীয় রেল প্রকৃত অর্থেই এদেশে বিপ্লব সংঘটিত করেছিল ।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours