মুজতবা আল মামুন, সাংবাদিক, কলকাতা : এভাবে শুরু করা যায়, যখন কেউ বলেন যে দেশ সবার ওপরে, তখন তিনি কি ভাবেন, দেশের সরকার বা নেতা মন্ত্রীরা সবার ওপরে ? না দেশের মানুষ সবার ওপরে ? লজ্জার এটাই, বেশির ভাগই যে দেশের কথা, দেশপ্রেমের কথা বলেন, আদতে সে প্রেম তার রাজনৈতিক মিশন সফল করার, বা ব্যক্তিস্বার্থে চরিতার্থ করার। অর্থাৎ দেশের সরকার বা নেতা-মন্ত্রীরাই সবার ওপরে থাকছে। জনগণ পদানত। আর গণতন্ত্র ? তাকে সং সাজা জোকারে পরিণত করা হয়। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ করা এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা প্রসঙ্গে, এটাই চমৎকার মুখ দর্পণ হতে পারে।
সারা দেশ জেনেছে, কাশ্মীর আর রাজ্য নয়। অঙ্গহানি হওয়া ওই জনপদ এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। যদিও বিধানসভা থাকবে। লাদাখকে কেটে দেওয়া হল। ৩৭০ ধারা, যা কাশ্মীরের ভারতভূক্তির প্রাণভোমরা, তা বাতিল হওয়া নিছক একটা ধারাবদল নয়, ওই উপত্যকার ভূমিপুত্রের বাঁচা-মরা এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। আমরা যারা উল্লাস বোধ করছি, তারা জানিই না, এর ফল বিষময়, নাকি সুস্বাদু হবে !
তবে বিশেষজ্ঞরা এর মধ্যে সংকটের কালো মেঘ দেখছেন।
কাশ্মীর ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল কতগুলো নির্দিষ্ট শর্তের বিনিময়ে। তার অন্যতম শর্ত ছিল ৩৭০ ধারা। চুক্তি মোতাবেক স্থির হয়েছিল চুক্তির শর্তগুলো বিলুপ্ত হলে চুক্তিরও বৈধতা থাকবে না। ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির অর্থ কাশ্মীরের ভারত ভুক্তি চুক্তিরও বিলোপ ঘটা। জাতিপুঞ্জ ইচ্ছা করলে এখন কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। কাশ্মীর নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সেটাও আর আইনগত ভাবে অবৈধ থাকছে না ৩৭০ ধারা বিলোপের পর ভারতভুক্তি চুক্তির অস্তিত্ব না থাকার কারণে। " জিহাদীদের খুব টাইট দেয়া গিয়েছে " ভেবে আমরা যারা উল্লসিত, সম্ভবত ধারণাই করতে পারছি না তাদের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ধর্মান্ধ নেতারা ভারত ইউনিয়ন ভুক্ত কাশ্মীর থেকে কাশ্মীরকে পরিণত করলেন মিলিটারি অকুপায়েড টেরিটোরিতে। ভারত ইউনিয়ন থেকে কাশ্মীরকে বের করে আনতে দীর্ঘদিন ধরে যে চেষ্টা হিজবুল লস্কর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা করে আসছিলেন, ভক্তদের মহান নেতারা সে চেষ্টাকে সফল করলেন। ভারত ইউনিয়ন থেকে আইনগত ভাবে সংবিধানগত ভাবে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করার আন্দোলনে সম্ভবত ধুনোর ধোঁয়া দিলেন। কাশ্মীর নিয়ে কাজ করা মানুষরা বলছেন, ৩৭০ ধারা তোলা, যার ফলে ৩৫এ অনুচ্ছেদ উঠে যাওয়া, এসব আসলে গুজরাটি বেনিয়াদের তুমুল ব্যবসা সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া।
যেটা বেশি করে প্রচার করা হচ্ছে তা, 'এক জাতি এক ভোট' বা 'এক দেশ এক আইন' এর স্বার্থে এসব করা হচ্ছে। সত্যিই কি তাই ? সবাই জানি কী যে,
জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের একমাত্র রাজ্য নয়, যে সংবিধানের দ্বারা 'স্পেশাল প্রভিশন' বা বিশেষ সুবিধা পায় বা পেতো। ভারতে আরও তেরোটি রাজ্য আছে, যারা সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭১, ও ৩৭১এ থেকে ৩৭১এইচ এবং আর্টিকেল ৩৭১জে - তে বিশেষ সুবিধা পায়। উত্তর পূর্ব ভারতের আরও সাতটি রাজ্য এবং উত্তর ভারতের একটি রাজ্য এই স্পেশাল স্ট্যাটাস বা স্পেশাল ক্যাটাগরিভুক্ত। এরা হল, অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, উত্তরাখন্ড, ত্রিপুরা, আসাম, হিমাচল প্রদেশ এবং সিকিম। এছাড়াও রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও মোদি-অমিতের রাজ্য গুজরাট । এদের জন্যও ভারতীয় সংবিধানে 'স্পেশাল প্রভিশন' রয়েছে। এছাড়াও সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল অনুসারে ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর জন্য 'স্পেশাল প্রভিশন' রয়েছে। আর্টিকেল ৩৭০ এবং ৩৭১ ও তার উপধারাগুলোর মধ্যে খুব একটা তারতম্য নেই। অমিত শাহের রাজ্যের কথায় আসা যাক, 'বিদর্ভ আন্দোলন' গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের অনেক পুরাতন একটি বিতর্কিত বিষয়। অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং এর মত । বিশেষ দুটি অনুসারে এই অঞ্চলের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ অর্থের হিসেব কেবলমাত্র বিধানসভাতে দিতে হবে, অর্থাৎ গুজরাট ও মহারাষ্ট্র এই নিয়ে কোনও হিসাব ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে বাধ্য নয়। এবং ভূমিপুত্রদের চাকরি ও শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। এক দেশ এক আইনের প্রবক্তা অমিত শাহরা সেসব তুলবেন ?
৩৭১-এর কিছু উপধারা অনুযায়ী, নাগারা তাঁদের নিজেদের তৈরি আইন মেনে চলবে অর্থাৎ নাগাল্যান্ডের বাইরের কোনও আইন সেখানে চলবে না, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় আইনও নয়। এমনকি সিভিল ও ক্রিমিনাল, উভয় ক্ষেত্রেই নাগাদের নিজস্ব আইন নাগাল্যান্ডে বলবৎ থাকবে, আছেও। এছাড়া ঠিক জম্মু ও কাশ্মীরের ন্যায়, অন্য রাজ্যের কেউ নাগাল্যান্ডে জমি ক্রয় এবং নাগাল্যান্ডের কেউ বাইরের কাউকে জমি বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারবে না। এগুলোর জন্য নাগাল্যান্ডের বিধানসভা যতক্ষন না অনুমতি দিচ্ছে, ততক্ষণ এগুলো করা যাবে না। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে রাজ্যপালের হাতে ন্যাস্ত (তিনি চাইলে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করতেও পারেন, আবার নাও পারেন)। তাংশেন জেলা সমেত নাগাল্যান্ডে একাধিক জঙ্গি কবলিত অঞ্চল রয়েছে। তাংশেন জেলা নিয়ে একাধিক পয়েন্ট রয়েছে ৫ নং এ। এর মধ্যে উল্লেখ্য হল যে এই জেলা থেকে, এই জেলা তে বসবাসকারী মানুষ ভোট দিয়ে নিজেদের নির্বাচিত কোনও জনপ্রতিনিধিকে নাগাল্যান্ডের বিধানসভায় পাঠাতে পারবেন না। এই জেলা থেকে কে বিধানসভায় থাকবে সেটা ঠিক করবে রিজিওনাল কাউন্সিল। এছাড়াও নাগাল্যান্ড রাজ্যের নিজস্ব কিছু আইন আছে, যেগুলোর দ্বারা দেশের বাকি অংশের মানুষের নাগাল্যান্ডের সর্বত্র বিচরণ করা আটকানো হয়েছে।
এরকম বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্যগুলো বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অমিত শাহরা চুপ কেন ? যত রোষ কাশ্মীরেই ?
এথনিক কনফ্লিক্টের অভ্যন্তরে রেখে সার্ব উগ্রজাতীয়তাবাদকে দেখলেই বোঝা যায় কীভাবে যুগোশ্লাভিয়ার এথনিক ফল্ট-লাইন ধরে সাম্রাজ্যবাদী ভূ-আধিপত্য নিয়ন্ত্রণের খেলা চলছিলো। উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রয়োজন তখনই পড়ে যখন জাতির নেতৃত্বদায়ী শ্রেণী তার শ্রেণী হেজিমনি কনসেন্টের মাধ্যমে বজায় রাখতে অপারগ। তাই নিজ জাতির উপর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার থেকে, একটি দুর্বল "অপর" খুঁজে নিয়ে তার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আবেগকে পরিচালিত করে চলে, যেমন অসমে বাঙালি শত্রু দেখিয়ে চলছে। । কিন্তু জাতীয় শ্রেণী আধিপত্যের সমস্যাটা তো থেকেই যায়। সেই সমস্যা চাগাড় দিয়ে উঠে, যখন যাকে "অপর" তৈরি করা হয়েছিলো, সে প্রতিরোধ করতে শুরু করে, বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তখন জাতির অভ্যন্তরে ও জাতির বাইরে থেকে চাপের মুখে শ্রেণী ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য আরও ক্ষমতাবান শ্রেণীশক্তির আশ্রয় নিতে হয়। সেটাই প্রতিক্রিয়াশীলদের আরও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের আর্থ-সামাজিক ডায়নামিক্স।
সুবিধাপ্রাপ্ত অন্যান্য রাজ্যের অধিকারগুলো কিন্তু কেন্দ্রের ক্ষমতা নেই কাড়ার । জম্মু কাশ্মীরের এই নাটক শুধু সামনের চার রাজ্যের ভোটের দিকে তাকিয়ে ?
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কাশ্মীরী জনগণকে কেন সামরিক বাহিনীর ভয় দেখানো হলো? প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী সহ প্রাক্তণ মুখ্যমন্ত্রীদের কেন বন্দী করতে হলো? যে রাজ্যের বাসিন্দাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত, সেই কাশ্মীরীদের জনজীবনকে স্তব্ধ করে ও তাদের কণ্ঠরোধ করার রাষ্ট্রীয় পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেটা কী গণতন্ত্রকে পদদলিত করা নয়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে ভাবে দ্রুত ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটছে তার খেসারত শুধু ভারতবাসীকে নয়, দিতে হবে সবকটি রাজ্যকে, এমনকী বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকেও।
ডি-মোনিটাইজেশনের মাধ্যমে সন্ত্রাস শেষ হয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়েছিলো। এবার কী ডি-মোনিটাইজেশন থেকে উঠে আসা অর্থ দিয়ে ঘুরপথে রি-মোনিটাইজেশন হবে? জোর জবরদস্তি কমন মার্কেট তৈরি করার বাসনা গণতন্ত্রকে হত্যা করতে পারে, অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে পারে না। আর গণতন্ত্রকে হত্যা করে কাশ্মীর সমস্যায় আমেরিকার হস্তক্ষেপের বাসনাকেও বেশীদিন ঠেকানো যাবে না, কারণ আফগানিস্তানের খেলায় আমেরিকা পাকিস্তানকেও বন্ধুর মর্যাদা থেকে বাদ দেবে না। উগ্রজাতীয়তাবাদ সবসময়ই বড় শক্তির কাছে আত্মসমর্পনে বাধ্য করে। অসমিয়া বা বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদ হলে কেন্দ্রের কাছে আত্মসমর্পণ, আর ভারতীয় উগ্রজাতীয়তাবাদ হলে সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ। কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরি জনগণের তথা তপসিলি জাতি জনজাতি তথা মহিলাদের ন্যায়ের কথা বলছে। সেটাই যদি আসল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেই সিদ্ধান্তগুলি কাশ্মীরী জনগণের গণভোটের মাধ্যমে স্বীকৃতি আদায় করে নিক। বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, অন্যথায় এই পদক্ষেপ সমগ্র দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার মহড়া হিসাবেই বিবেচিত হবে। যেমন অসমে রাষ্ট্রহীন হওয়ার ভয়ে নাগরিকরা এমনিতেই ভোট-গণতন্ত্রের স্বাদও ভুলতে বসেছেন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours