প্রতিম বসু, সিনিয়র জার্নালিস্ট ও লেখক, কলকাতা:

বিতর্কের সলতেটা ধিক ধিক করে জ্বলছিল গত সপ্তাহ খানেক ধরেই। গুঞ্জন উঠেছিল ভূস্বর্গের অলিগলি জুড়ে। দিল্লির ক্ষমতায়নের অলিন্দে অলিন্দে চরম ব্যস্ততা। শেষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বোম্বিং করেই দিলেন ৭০ বছরের ৩৭০ ধারার এক জগদ্দল পাহাড়ে।

সবাই আন্দাজ করছিল বড় একটা কিছু হবে। গত শুক্রবারে হটাত করে অমরনাথ যাত্রা রদ করা ও অতিরিক্ত প্রায় ২৮,০০০ সেনা মোতায়েন করার পর থেকেই সন্দেহ দানা বাঁধছিল। শনি ও রবিবার ধরে সরকার, বহিরাগতদের কাশ্মীর থেকে সরিয়েছেন। পর্যটক, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র, খেলোয়াড় কেউ বাকি নেই। এর সঙ্গেই পাকিস্তানি হানাদার ও ফৌজের গুলিতে তাদের মৃত্যু এসবও ঘটেছে।
বোঝাই যাচ্ছিল কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার আগাম প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সংসদে ‘বোমা’ পড়বে কেউ ভাবে নি। সেটাই পড়ল। সকাল সাড়ে নটায় ক্যাবিনেট বৈঠকের পরে, জানা গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, এগারোটার সময়ে সংসদের উচ্চকক্ষ অর্থাৎ রাজ্যসভায় বক্তব্য রাখবেন। আর তার পরেই বোমাটা পড়লঃ সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫(এ) ধারার রদের মাধ্যমে কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি বাতিল। কাশ্মীরিরা এখন থেকে ভারতের আর পাঁচটা নাগরিকের সমান সুযোগসুবিধে পাবেন।
জম্মু ও কাশ্মীর নামে কোন রাজ্যও নেই। জম্মু-কাশ্মীর এখন একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সেখানে ভোট হবে, বিধানসভাও থাকবে। তবে কাশ্মীর থেকে লাদাখকে আলাদা করা হয়েছে। সেটিও এখন থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, তবে সেখানে আলাদা বিধানসভা থাকবে না।
শাহ অবশ্য প্রস্তাব এনেছিলেন। বিকেল গড়াবার আগেই তা রাজ্যসভায় পাস। কংগ্রেস, বাম, তৃনমূল, লালু যাদবের আরজেডি এরকম কয়েকটি হাতেগোনা দল এবং কাশ্মীরি দলগুলি ছাড়া বাকি সবাই প্রস্তাবের পক্ষে। বিজেপি বিরোধী জোট ভেঙ্গে ছত্রাখান। আপের মত কট্টর বিজেপি বিরোধীও ৩৭০ ধারা রদের পক্ষে, তাছাড়া মায়াবতীর বিএসপি, বিজেডি এরাও প্রস্তাবের পক্ষে। রাজ্যসভাতে বিজেপির সংখ্যাগরিস্থতা নেই, ফলে সেখানের গাঁট পেরনো মানেই কাজ শেষ।
৩৭০ ধারা কি?
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াতেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা খুব সাধারন নয়। আচমকা গোল খেয়ে কংগ্রেসের বড় মাপের নেতা ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গোলাম নবী আজাদ গোটা ঘটনাটাকে বোমার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজাদের মতে এতে কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তি লঙ্ঘিত হল।
উত্তরে বিজেপি মনে করিয়ে দিয়েছে ৩৭০ ধারাটা আনা হয়েছিল সাময়িক সুবিধা হিসাবে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগস্টের পরে রাজাগজাদের ভারতভুক্তি হয়েছিল। তখনও সংবিধান রচনা হয় নি। ধারনা ছিল অন্যান্য রাজ্যের মতই কাশ্মীরও ভারতীয় সংবিধান মেনে বিধানসভায় সংশোধনী আনবে। কিন্তু সেটা হয় নি। তদানীন্তন জহরলাল নেহরু সরকার সেটা মেনে নিয়েছিলেন। আর কাশ্মিরের রাজনীতি এটাকে তাদের প্রাপ্য বলে ধরে নিয়েছিলেন।
এর ফলশ্রুতিতে ভারতের রাজ্য হলেও কাশ্মিরের আলাদা পতাকা ও সংবিধান আছে। প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ও যোগাযোগ বিষয়ক ব্যাপারগুলি ছাড়া কাশ্মিরে কেন্দ্রের ক্ষমতা সীমিত। রাজ্যের আইন অনুযায়ী বাইরের কেউ সেখানে জমি কিনতে পারবেন না। কোন কাশ্মীরি মহিলা যদি বাইরের কাউকে বিয়ে করেন তাহলে সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। বহিরাগত কাকে বলা হবে সেটাও ঠিক করবে রাজ্য।
এরকম নিয়মকানুন হলে শিল্পায়ন বা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি অসম্ভব। কারন যিনি বিনিয়োগ করবেন তিনি তো অন্যের কথায় চলবেন না। আর সব জনজাতির ব্যবসাবুদ্ধি সমান না। এর ওপর আছে হিংসামূলক ঘটনা। সুতরাং কাশ্মিরের অর্থনীতি দুর্বল। রাজ্য চলে কেন্দ্রের অনুদানে। অথচ কেন্দ্রের হিসাব চাইবার কোন অধিকার নেই। ফলে যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের পোয়াবারো।  ফল ভোগ করেন সাধারন মানুষ।
আলাদা সংবিধানের কিছু অদ্ভুত দিকও আছে। আজও কাশ্মির বিধানসভায় পাক-অধিকৃত কাশ্মিরের জন্যে গোটা কুড়ি চেয়ার আছে, যেগুলো ফাঁকা থাকে। এবার এসব খোলনলচে বদলাবে।

এবার কি?  
কাশ্মির যে কোন সাধারন বিষয় নয় সেকথা সবাই জানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যোগদান ও পাকিস্তানের হারের পর থেকে ইসলামাবাদ কাশ্মিরকে পাখির চোখ করেছে। যার ফলশ্রুতিতে মৃত্যুমিছিল বেড়েছে। আজকের ঘটনার পর ইমরান খান সরকার বলেছেন পাকিস্তান এর বিরোধিতা করবে। কাশ্মিরের দলগুলিও হয়ত কোর্টের দ্বারস্থ হবে। সুতরাং সামনের কিছুদিন গণ্ডগোল বাড়তে পারে।
তবে ভারতের ও উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে আজকের সিদ্ধান্ত বড় বদল আনতে পারে। ৩৭০ ধারা যে কাশ্মিরকে দেশের মুল স্রোতে আনতে পারে নি, সেকথা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। এর কারন হল, সাংবিধানিক সুবিধের অপব্যবহার।
সমস্ত রাজ্য মিলিয়ে মুসলমানরাই সংখ্যাগুরু হলেও জম্মুতে হিন্দুরা ও লাদাখে বৌদ্ধরা সংখ্যাগুরু। অভিযোগঃ ৩৭০ ধারার রক্ষাকবচ ব্যবহার করে, রাজ্যের রাজনীতি সবার কন্ঠরোধ করেছে। এক লক্ষ কাশ্মীরি পণ্ডিতকে ঘরছাড়া করাও তার মধ্যে আছে। পিডিপি দলের নেতা ও ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি তো ঠারেঠোরে বলেই দিয়েছেন, কাশ্মির মুসলমানের।
সব মুসলমান কাশ্মীরি যে এর সপক্ষে তা নয়। কিন্তু রাজনীতির খেলায় তারা বোড়ে। আর পাকিস্তানি উস্কানি তো আছেই। বাংলাদেশের জন্মের পর কাশ্মিরে অশান্তি বেড়ে যাওয়া তো সেকথাই প্রমান করে।
আজকের সিদ্ধান্তের পরও কাশ্মিরে মুসলমানরাই সংখ্যাগুরু থাকবেন। কিন্তু কাশ্মিরকে ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী চলতে হবে। বাইরের লোক জমি কিনতে পারবে। কাশ্মিরি মহিলারা নিশ্চিন্তে কলকাতা কি দিল্লিতে বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হতে পারবেন, ফলে রাজনীতি বদলাতে বাধ্য।
দেশের প্রতিরক্ষার জন্যে লাদাখের ভাগ হওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মিরের অশান্তির আঁচ পোয়াতে হত নির্বিবাদী লাদাখীদের। মুশকিলের কথা হল, লাদাখের অবস্থান চিনের পাশেই। ভারতীয় সরকার বহুদিন ধরেই লাদাখকে আলাদা করতে চেয়েছিল। কিন্তু দুটি কারনে তা হয় নি। প্রথমঃ যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। দ্বিতীয়ঃ রাজনৈতিক সাহস।
লাদাখ মুল যাওয়ার রাস্তা ছিল কাশ্মিরের ভেতর দিয়ে। বছরে ছ-মাস সে রাস্তা বরফে ঢেকে যায়। বাজপায়ী সরকারের আমল থেকে হরিয়ানা ত্থেকে টানেলের মাধ্যমে লাদাখের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগের পরিকল্পনা হয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে মোদী সে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করেন। এখন সারা বছর সরাসরি লাদাখ যাওয়া যায়।
অর্থাৎ আজকের সিদ্ধান্তের পর কাশ্মিরের রাজনীতি ভারতকে আর ততটা বেগ দিতে পারবে না। উল্টে কাশ্মীর এখন একঘরে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তন
একটা কথা অনেকেই বলছেন, এমন হুড়োহুড়ি করে সিদ্ধান্ত কেন? এর একটা সহজ উওর হল, ৩৭০ ধারা রদ বিজিপির পুরনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। স্বাধীনতা দিবসের আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেটা করে দেখাতে চেয়েছিলেন। আমার কিন্তু আরেকটা কথা মনে হয়।
অনেকের মনে থাকতে পারে হপ্তা খানেক আগেই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মির বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের ভেতর মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলেন। অনেকেই সেটকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কেউবা মোদীকে দোষী ঠাউড়েছিলেন। এমন হতে পারে কি, যে আন্তর্জাতিক কোন চাপ আসতে পারে, আন্দাজ করে মোদী আগেই তার কাজ সেরে ফেললেন?
এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত কোনদিনই জানা যাবে না, কিন্তু হলফ করে বলা যায় আজকের সিদ্ধান্তের প্রভাব আঞ্চলিক রাজনীতির ওপর পড়বে। 
এতদিন মনে করা হত চিনের তুলনায় ভারত নরম প্রকৃতির। নিজের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত। ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ২০০ কিলোমিটার ভেতরে বালাকোটে গিয়ে বিমান হানা থেকে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ ও লাদাখকে আলাদা করার পর ভারতকে আর এলেবেলে ভাবা যাবে না। অন্তত চিন ভাববে না। পাকিস্তানের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
শেষ করার আগে ভারতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব কি বলা দরকার। গত সত্তর বছরের বেশি ভারতের সংখ্যাগুরু মানুষ এক দেশে দুই নিয়মের বিরুধে ছিলেন। কাশ্মিরে গোলমাল যত বেড়েছে, ৩৭০ ধারা রদ করার দাবীও তত বেড়েছে। কিন্তু রাজনীতির যাঁতাকলে সে দাবী সুবিধে করতে পারে নি।
জনমত যে ৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে ছিল তার প্রমান আজকে সংসদে পাওয়া গেছে। যারা বিরোধিতা করেছেন, যেমন কংগ্রেস বা বাম দলগুলি, তারা বোধহয় নিজের পায়ে কুড়ুল মারলেন। কদিন আগে তিন-তালাক রদের বিলেও কংগ্রেস ও বাম বিরোধিতা করেছিল। ২০২৪-এ বোঝা যাবে লোকে এদের কিভাবে নিয়েছে।
তবে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, যে ভারতের নির্বাচনে আগামী দিনে একটা ইস্যু আর রইল না। কাশ্মির এখন ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের মতই। আলাদা না। আশা করা যাক কাশ্মিরের মানুষ এর সুফল পাবেন। সময় বলে দেবে তারা কোন দিকে যান, তবে হিংসার রাজনীতি বোধহয় আর সুবিধে করতে পারবে না। কাশ্মীরের মাটিতে শুরু হল এক মাটি এক দেশ এক পতাকার এক নতুন ভোর। এক অখণ্ড ভারতের প্রবল ভারতীয়ানার বাস্তব ভূস্বর্গ পেল "মেরা ভারত মহান"।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours