গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
বিষয়টা
আর ৩৭০ বা ৩৫-এ তে সীমাবদ্ধ নেই। এই ধারাটি এক লাফে সংবিধানের এবং দেশেরও
কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছে। বিজেপি সরকার বলছে, কাশ্মীর ভারতের
অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল, এবং কাশ্মীর সমস্যারও সমধান হয়ে গেল।
যদি
সত্যি কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তাহলে জয়শ্রী রামের নামে তোপধ্বনি
দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। তবে তা হচ্ছে বলে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে
মনে হচ্ছে না। কারণ কাশ্মীর সংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়ে কেন্দ্রের
সরকার এখন একাধিক কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সারা ভারতকে। সেই
প্রশ্নগুলি খুব কঠিন, এদং দেশকে আগে এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি।
প্রশ্নগুলির চেহারা একবার উল্টেপাল্টে দেখে নেওয়া যাক।
১)
৩৭০ তো হল, ৩৭১ নিয়ে একটু গৌরচন্দ্রিকা করে ফেলি। ৩৭১ এ, বি, সি , ডি ,ই,
এফ, জি এইচ, আই তো সংবিধানে রয়ে গেল। অর্থাৎ কাশ্মীরে নাহয় শাবল-খুরপি নিয়ে
গিয়ে ঘর-বাড়ি তোলা গেল, নাগাল্যান্ড, আসাম, মণিপুর, অন্ধ্র, সিকিম,
মিজোরাম, অরুণাচল বা গোয়াতে গিয়ে বসত বা বাণিজ্য করাতো স্বপ্নই রয়ে গেল!
কাশ্মীরের বেলায় এক নিয়ম, অন্য রাজ্যের বেলায় অন্য নিয়মই চালু থাকবে কি?
২)
যেভাবে ৩৭০ ধারা বা ৩৫-এ উপধারা বিলোপের পথে হাঁটতে গিয়ে কেন্দ্র কাশ্মীর
বিধানসভাকে নস্যাৎ করে সংসদে রাষ্ট্রপতি নির্দেশনামা জারি করে, নতুন আইন
প্রবর্তনের পথে হাঁটল, তাকে কি গণতান্ত্রিক বলা যেতে পারে?
৩)
যেভাবে সংসদ একতরফা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কাশ্মীর বিধানসভাকে ভেঙে দু’টি
কেন্দ্রশাসিত এলাকা করে দেওয়া হল, তা কি এরপরে অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে
(প্রয়োজন পড়লে) করা হবে না?
৩)
সারা দেশে বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যভাগের দাবি জানিয়ে আসছে একাধিক গোষ্ঠী।
এবার যদি কেন্দ্র সরকার সংসদে একইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেসব রাজ্য
ভেঙে দু’ভাগ করে দেয়, তাহলে কি কিছু বলার থাকবে?
৪)
যেভাবে অন্য সকলের, এমনকি কাশ্মীরের রাজ্যপালেরও অগোচরে এত বড় একটা
সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্র সরকার, সেখানে এই প্রশ্ন কি উঠবে না যে,
প্রধানমন্ত্রী সকলকে জানিয়ে দিতে চান, সরকারে প্রথম কথা এবং শেষ কথার বলার
অভিকার একমাত্র তাঁর এবং তাঁর প্রধান সহচর অমিত শাহের? মোদ্দা প্রশ্ন হল, এ
দেশে কি অবশেষে বকলমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে?
৫)
কিমাশ্চর্যতঃপরম! কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করে বিজেপি কার সমর্থন
পেল? বহুজন সমাজ পার্টি এবং খোদ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের।
বিএসপি যে সমর্থন দেবে তা জানতে কারোর বাকি ছিল না। তা বলে, যে কেজরিওয়াল
নিজে দু’বেলা কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে গলার শির ফুলিয়ে দিল্লির জন্য
রাজ্যের মর্যাদা দাবি করেন, তিনিও? তাঁর সাংসদেরা জানালেন, দেশের
নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁরা এই বিলে সমর্থন দিতে চান। কেজরিওয়ালতো জানেন,
দিল্লিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে রাখার পিছনেও একই নিরাপত্তাজনিত স্বার্থই
কাজ করে। এরপর তিনি আবার দিল্লির জন্য রাজ্যের মর্যাদা দাবি করবেন না তো?
সে প্রশ্নটা রয়ে গেল।
প্রশ্নের
সংখ্যা এরকম আরও অনেক, উত্তর নেই। এত সবের পরেও একটা কথা পরিষ্কার। যেভাবে
সংসদে তড়িঘড়ি বিল এনে কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত করে, রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে,
তাকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা করে তোলা হল, তাতে বোঝা গেল, বিজেপি সরকার
ক্ষমতায় বিশ্বাসী হলেও গণতন্ত্রের মৌলিকত্বে বিশ্বাসী নয়। আইন মানুষ তৈরি
করে, এবং তা তৈরি হয় মানুষের স্বার্থে। অটলবিহারী বাজপেয়ী যে ‘ইনসানিয়ত’ বা
‘কাশ্মীরিয়তের’ কথা বলেছিলেন সে বিষয়ে একটিও কথা খরচা না করে বিজেপি
নেতৃত্ব জানিয়ে দিলেন, কাশ্মীরের মানুষজনের কথা ভেবেই তাঁরা এত বড়
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অথচ যখন তাঁরা কাশ্মীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তখন
কাশ্মীরের মূলস্রোতের রাজনৈতিক নেতারা কোথায় আছেন, তা কেউ জানেন না।
কাশ্মীর কেমন আছে, তাও কারোর জানা নেই। একটু যদি পরম্পরা লক্ষ্য করা যায়
তাহলে বোঝা যাবে শুধু কাশ্মীর প্রসঙ্গে নয় বিভিন্ন প্রশ্নে ভারতের
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষের মানসিক বিভাজন বাড়ছে। এ
ব্যাপারটি সামনে এসেছে, যখন সংসদে বিলের বিরোধিতে করতে উঠে একটি কঠিন সত্য
শুনিয়ে দিয়েছেন ডি এম কে নেতা টি আর বালু।
বালু
হাসতে হাসতে শুনিয়েছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাহায্যে সংসদে বিলের পর বিল পাশ
করিয়ে যাচ্ছে বিজেপি, তবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি যতই বড়াই করুক,
যতই বিল পাস করাক, দক্ষিণ ভারতে বিজেপির ঠাঁই নেই। তাঁর বক্তব্যের
মর্মার্থ, বিজেপি যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোব্বা পরে দক্ষিণ ভারতে জনসভার
মঞ্চে না নামে। বুঝতে কারোর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, আপাত নিরীহ মন্তব্যের
মাঝে একটি মারাত্মক প্রশ্ন কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রয়েছে।
বিজেপি
সরকার কি ভারতকে এক সূত্রে বাঁধতে গিয়ে সারা দেশকে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর
দক্ষিণে ভাগ করে দিচ্ছে? নাহলে টিআরবালু দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে দক্ষিণ
ভারতকে পৃথকভাবে তুলে ধরলেন কেন? এর উত্তর বিজেপিকেই ভেবে বার করতে হবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours