রণজিৎ গুহ, প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
আমাদের
স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ।
কেন জানিনা এই সুপণ্ডিত বিদগ্ধ মানুষটি গান্ধী নেহরু প্যাটেল সুভাসবোস এর
আড়ালে থেকে যান একেবারেই অনালোচিত হয়ে।
তাঁর প্রকৃত
নাম ছিল ফিরোজ বখত।বাবা ছিলেন বাঙালি। মা আরবিয়।জন্ম মক্কায়।মাত্র দু'বছর
বয়সে মা-বাবার সাথে চলে আসেন কলকাতায়।যৌবনে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন
মুহিউদ্দিন আহমেদ নামে। পরবর্তীতে তিনি ছদ্মনাম ধারণ করেন আবুল কালাম আজাদ।
এবং সেটিই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠে।
প্রাতিষ্ঠানিক
আধুনিক শিক্ষা লাভ না করলেও ব্যক্তিগতভাবে অধ্যয়ন ও ব্যাপক পাঠাভ্যাসের
মাধ্যমে তিনি নিজ চেষ্টায় শিক্ষিত হওয়ার পথ অনুসরণ করেন এবং বিশ্ব ইতিহাস
ও রাজনীতি সম্পর্কে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হন।মুসলমানদের আচরিত ও লালিত
বিশ্বাসগুলির নতুন ব্যাখ্যা করে তিনি অনেক লেখা প্রকাশ করেন।
তাঁর
পান্ডিত্যই ‘তাজদিদ’ বা নতুন প্রথা প্রবর্তন গ্রহণের পথে তাঁকে পরিচালিত
করে। তিনি আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাঠামোর
মধ্যে ভারতের সকল ধর্ম ও গোত্রের জনগণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ও কৃষ্টির
সুসমন্বয় ঘটাতে পারে যদি রাষ্ট্রব্যাবস্থা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার
ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন রাষ্ট্র ভারতের জন্য
ধর্মনিরপেক্ষতা ভিত্তিক গণতন্ত্রের ধারণাকে ভারতের যেসব রাজনৈতিক চিন্তাবিদ
সর্বাগ্রে সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করেছেন আজাদ নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে
অগ্রপথিক।
খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতির ব্যাপারে
আগ্রহ প্রকাশ করেন। যে পারিবারিক পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন এবং যে ধরনের
শিক্ষা লাভ করেছেন, তাতে তাঁর ধর্মীয় নেতা হওয়ারই কথা।প্যান ইসলামী
চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি আফগানিস্তান, ইরাক, মিশর, সিরিয়া ও তুরস্ক
সফর করেন। কিন্তু জীবন ও রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন এক উপলব্ধি নিয়ে
তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ইরানে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য
সংগ্রামরত নির্বাসিত বিপ্লবীদের সঙ্গে তিনি ইরাকে সাক্ষাৎ করেন। মিশরে শেখ
মুহম্মদ আব্দুহ্ ও সাঈদ পাশা এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লবী কর্মীদের
সঙ্গে দেখা করেন। কনস্টান্টিনোপলের তরুণ তুর্কীদের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি
সম্পর্কে অবহিত হন। এসব সংস্পর্শ তাঁকে একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীতে পরিণত
করে। ধর্ম ও জীবনের সংকীর্ণ ধারণার শৃঙ্খলমুক্তির স্মারকস্বরূপ তিনি লেখক
হিসেবে ‘আজাদ’ নাম গ্রহণ করেন।
বিদেশ থেকে ফিরে এসে
আজাদ পূর্ব ভারতের দুজন নেতৃস্থানীয় বিপ্লবী শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ ও
শ্রীশ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ব্রিটিশ শাসন বিরোধী
বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন। প্রকৃতপক্ষে একদিকে তিনি ছিলেন একজন গোপন
বিপ্লবী এবং অন্য দিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রকাশ্য কর্মী।
তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হবে
হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য, আর সে ঐক্যের ভিত্তিমূল হবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র
ব্যবস্থার সেক্যুলার ধারণা। কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে তিনি তুরস্কের খিলাফত
আন্দোলন সমর্থন করেন, পুরানো শাসকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে নয় বরং
নবীন তুর্কিদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য। তাঁর মতে, নবীন তুর্কিরাই
ছিলেন খিলাফতের মূল বিধানের সত্যিকার প্রতিনিধি।
১৯১২
সালে প্রতিষ্ঠিত আজাদের উর্দু সাপ্তাহিক সংবাদপত্র আল-হেলাল ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী লেখা প্রকাশ করতে থাকে। এ পত্রিকা কংগ্রেস ও
জাতীয়তাবাদী মতামত প্রকাশে একটি শক্তিশালী বিপ্লবী মুখপত্রে পরিণত হয়।
সম্প্রদায় ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে দুসম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্ট
শত্রুতার পর হিন্দু-মুসলমান ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আল-হেলাল
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বৃটিশ সরকার আল-হেলাল সাপ্তাহিকীকে ১৯১৪
সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত করেন । আজাদ তখন নাম বদল করে আল-বালাগ নামে অপর একটি
সাপ্তাহিকী প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাতেও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ভিত্তিতে
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা প্রচারিত হতে থাকে । ১৯১৬ সালে
সরকার এ পত্রিকাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং আজাদকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে
রাঁচিতে অন্তরীণ করে রাখে। সেখান থেকে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০
সালে মুক্তি পান।
মওলানা
আবুল কালাম আজাদ তখন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসে মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন
দাস জওহরলাল নেহরুর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অন্যতম সদস্য এবং
গান্ধীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ঘনিষ্ঠ সহচরদের একজন হিসেবে স্বীকৃত। ১৯২৩ সালে
আজাদ মাত্র ৩৫ বছর বয়সে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।এখনও
পর্যন্ত এত কম বয়সে আর কেউ কংগ্রেস সভাপতি হননি।এরপর তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬
সাল পর্যন্ত কংগ্রেস দলের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।সে সময় তিনি কংগ্রেস
দলের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা
নিয়ে আলোচনায় অন্যতম প্রধান ভূমিকায় অংশ নিয়েছেন। বিশ শতকের ত্রিশ ও
চল্লিশের দশকে ভারতীয় রাজনীতির উত্তাল দিনগুলিতে আজাদ মহাত্মা গান্ধীর
সবচেয়ে অন্তরঙ্গ উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হতেন । ক্রিপস মিশন (১৯৪২) থেকে
শুরু করে কেবিনেট মিশন (১৯৪৬) পর্যন্ত সকল আলোচনায়, বিশেষত ভারতের
সাংবিধানিক বিষয়ে ও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, আজাদের সঙ্গে গান্ধী
ঘনিষ্ঠভাবে পরামর্শ করেছেন। ক্রিপস মিশন (১৯৪২) এবং কেবিনেট মিশন (১৯৪৬) এ
উভয় সময়েই সমঝোতা-পূর্ব আলোচনা বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচকদের মধ্যে আজাদ
ছিলেন অন্যতম ।তিনি শেষপর্যন্ত স্বাধীন অবিভক্ত ভারতের জন্য আলোচনা চালিয়ে
গেছেন।কিন্তু জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক উচ্চাশা, মাউন্টব্যাটেনের কূটকৌশল এবং
তিতবিরক্ত প্যাটেলএর হিন্দু মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে নেওয়ার ফলে
দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পরে। এই পরিস্থিতিতে মাউন্টব্যাটেনের প্রভাবে কৃষ্ণ
মেননের সহায়তায় নেহরুও দেশভাগ মেনে নেন।গান্ধীজির বিকল্প প্রস্তাব কংগ্রেস
বাতিল করে। তদোপরি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটার ফলে এবং পাকিস্তান
আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ায় এবং আজাদের প্রভাব অনেক কমে যায়।নেহরু আজাদ এই
সন্ধিক্ষণে পরস্পর বিরোধী মত প্রকাশ করলেও দুজনেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট
রাখেন।নেহরু মন্ত্রীসভায় আবুল কালাম আজাদ শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে যথাযথ
দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই দেশবিভাগ বিরোধী আন্তরিক ভাবে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী মানুষটিকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours