fiture
দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:


 অন্বেষা! বিনোদিনী পুরস্কারপ্রাপ্ত  নাট্যকর্মী অন্বেষা ঘোষের বিয়ে। বিয়ে দিচ্ছে নাট্য সংগঠনের ছেলেরা তাদেরই সংস্কৃতি ভবনে।যেখানে চলে নাটকের মহড়া! সেখানেই বিয়ে!  আর যে- সে বিয়ে নয়! রীতিমত নাটকীয়! রূপকের মত শোনালেও, এ যেন নাটকের মধ্যে রসদের অন্বেষণ!  

অন্বেষার স্বামী অমিতবাবু স্বাস্থ্য দপ্তরে কাজ করেন। ভালো দোতরা বাজান তিনি। সে অর্থে রাজযোটক।  বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী নাট্যদলের সাথে অন্বেষার জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই বিয়ের আয়োজনের পরতে পরতে সেই নাটকের ছাপ!  এহেন বিয়ের আদ্যপান্ত দেখে তাজ্জব হয়ে অনেকেই বলছেন, অভূতপূর্ব!

অন্বেষার নাট্যবোধের  ভাবনাতেই বহুবার উচ্চারিত- যদেতত হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। সে অর্থে তাঁর কাছে বিয়ে শুধুমাত্র লোকাচার বা শাস্ত্রমতে  আচার অনুষ্ঠান নয়।  ফেলে আসা জীবনের কুড়িটি গৌরবময় নাটকীয় অধ্যায়ের এক অনবদ্য কোলাজ! কোলাজই তো বটে! নাটকের প্রপস দিয়ে তৈরি হয়েছে মেয়ে বসার জায়গা। আর দেওয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে রাজ্যসরকারের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসাবে পুরস্কার নেওয়ার ছবি, রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখোপাধ্যায় হাত থেকে নেওয়া পুরস্কার, দেওয়ালে পাত্রীর (অন্বেষার) দীর্ঘ নাট্যজীবনের বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি। রিহার্সাল রুমে কুলো চালুনিতে লোকশিল্পের ছোঁয়ায় সেজেছে কন্যাসন।  বিয়ে তো একদিন অনেকেই করে। কনকাঞ্জলী দিয়ে সব মেয়েই তো শ্বশুর বাড়ি যায়! কিন্তু এ যাওয়া যেন নাটকের দৃশ্যান্তর ! প্রকৃত অর্থে জীবনের সাথে রঙ্গমঞ্চে নিজেকে মেলে ধরা! জনান্তিকে আমাদের সাথে কিছু কথা বলা! সেখানে যেমন চরিত্র, সংলাপ, পরিণতি ও দর্শক!  জীবনের কুড়িটি বসন্ত কাটিয়েছে সংস্কৃতিবাহিনীর  নাটকের মঞ্চে এই মেয়ে!  তাই তার বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল আপাদমস্তক প্রাণবন্ত, নাটকীয়।

সমর কেতন ঘোষ ও তার স্ত্রী অঞ্জলি ঘোষ বলেন," উজ্জ্বল আমাদের বললো, অন্বেষা বাড়ি থেকে বেশি সংস্কৃতি ভবনে সময় কাটিয়েছে। তাই আপনারা অনুমতি দিন আমরা আমাদের মেয়ের জন্য এই ভবনে বিয়ের আয়োজন করব। আমরা তো হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ওরাই সব করেছে। যা আমি পারতাম না। কি আর বলবো, এভাবে বিয়ে অন্বেষার কাছে তাঁর নাট্যজীবনের সেরা প্রাপ্তি”।  পাত্রী অন্বেষার কথায়," স্বপ্নের অতীত। নাট্য জীবনের সেরা প্রাপ্তি। নাট্য দলের দাদা ভাইরাই সব করেছে নিজে হাতে। আর বাবা শুধু কন্যা সম্প্রদান করলেন। একটা নাটকের দলের কাছ থেকে এর থেকে আর কী  পাওয়ার বাকি থাকল।"  

 

এবার আসি বিয়ে বাড়ির কথায়। নাটকের গেটের আদলে বিয়ে বাড়ির গেট। মঞ্চের তোরণ দেখলে মনে হবে, কুশীলবদের মঞ্চে প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের পথ। নাট্য কর্মীর বিয়ের আসর বসেছে নাট্য সংগঠনের নিজস্ব ভবনে। বরাসন ও কন্যাসন তৈরী নাটকের উপাদান দিয়ে। দেওয়ালে পাত্রীর নাট্যজীবনের বিভিন্ন সম্মান, পুরস্কার এর ছবি দিয়ে তৈরি  কন্যাসন।ছাতনাতলায় মাটির কলসিতে আঁকা জলসচেতনতার বিভিন্ন বার্তা। কুলো চালনিতে লোকশিল্পের ছোঁয়ায় সেজেছে বিয়ের আসর । নাটকের রসটাম (চৌকি) দিয়ে।ছাতনা তলায় থাকা বিয়ের মাঙ্গলিক চারটে কলস। তাও সংস্কৃতি বাহিনীর ছেলেরা নিজেরাই রঙ করেছে। অভ্যাগত অতিথিদের বেশীরভাগ নাটকের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত। কেউ কেউ প্রশাসনের সাথে যুক্ত। সবাই আড্ডা দিচ্ছেন। জেলার বিয়ের ইতিহাস নিয়ে আড্ডা হয়েছে। আলোক সজ্জা আছে। কিন্তু শব্দ দৈত্য নেই। কেউ বাজাচ্ছেন মাউথ অরগ্যান। বরযাত্রীদের অভ্যর্থণার ভাবনা অনন্য। সবার হাতে দেওয়া হল বকুল চারা। সে কোন অনাগত দিনের জন্য, ভাবনার ধারায়…ঝরিছে বকুল /আঁচল আকাশে হতেছে আকুল। বিয়ে উপলক্ষে পদ্য কবেই উঠে গেছে! ফিরে এল সেটাই, তবে নতুন আঙ্গিকে!   সকলের হাতে ছন্দোবদ্ধ বিভিন্ন নাটকে অন্বেষার নামভূমিকার তালিকা। সেটা একবার দেখাই যাকঃ

মর্জিনা বসে আছে হোসেনের জন্য

 সন্ধ্যা হরিকে পেয়ে কবে হবে ধন্য?

 পিঙ্গলা চেয়ে থাকে, নাগু আগমনে –

ফুলমনি রহমত মিলবে কেমনে?

কানোড়ার অবশেষে লাউসেন জয় -

অঙ্কু -অমিতে  মিলে শুভ পরিণয়।।

প্রাথমিকভাবে ধাঁধার মত হলেও, এটাই অন্বেষার নাট্যজীবনের কিছু অংশ মাত্র। যেমন ধরুন, আলিবাবা নাটকে অন্বেষা ‘মর্জিনা’র চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর নায়ক হোসেন। আবার বোগলো বায়েন নাটকে সন্ধ্যার ভূমিকায় আর তাঁর বিপরীতে হরি। একইভাবে,  নাগিনী কন্যা নাটকে পিঙ্গলা চরিত্রে অভিনয় করেন অন্বেষা। সেখানে বিপরীত চরিত্রে নায়ক নাগু ঠাকুর। তেমনি ‘নজর’ নাটকে ফুলমনির ভূমিকায় তিনি। তার বিপরীতে রহমত। ধর্ম মঙ্গলে দুই প্রধান চরিত্র কানোড়া ও লাউসেন। ধর্ম মঙ্গলে আছে,  লাউসেন কানোড়াকে বিয়ে করবে না। অন্যদিকে, কানোড়া প্রতিজ্ঞা করে সে লাউসেনকে যুদ্ধে পরাজিত করবে। সেক্ষেত্রে লাউসেন তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে। যুদ্ধে লাউসেন কানোড়ার কাছে পরাজিত হয় এবং কানোড়াকে বিয়ে করে।  শেষ লাইনে- অঙ্কু, অন্বেষার ডাক নাম। তার সাথে অমিত সাধুর পরিণয়।

মেনু কার্ডের বিষয়েও নাটকের ছাপ। নাটকের নাম দেওয়া হয়েছে-‘ চেটে- চুষে- কামড়ে- গিলে’। নির্দেশনা- সমর কেতন ঘোষ, পরিবেশনা- বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী। মুখ্য ভূমিকায়- অমিত ও অন্বেষা। প্রথম দৃশ্য- কাঁসার থালা, জল, স্যাল্যাড। দ্বিতীয় দৃশ্যে – শস, পনির স্যাটে। তৃতীয় দৃশ্যে- বেবি নান, চিলি চিকেন/ চিলি পনির। চতূর্থ দৃশ্যে- ফ্রাইয়েড রাইস, কাশ্মিরি আলুর দম, খাসির মাংস/ মাছ/ পনির মশলা, আনারসের চাটনি, পাঁপড়। বিরতি- পঞ্চম দৃশ্যে- রসগোল্লা, হীরামণি। ষষ্ঠ দৃশ্যে- আইস্ক্রিম, পান।  গোটা অনুষ্ঠানের ভিডিও রেকর্ডিং হয়েছে। তবে তা কোনভাবেই গড়পড়তা ভিডিও রেকর্ডিং নয়। নাটক ও প্রশাসনের যুক্ত অতিথিদের নিয়ে নাটক ও অন্বেষার জীবন নিয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সেখানে আছে অন্বেষার নাটকের ছবি তার প্রসঙ্গ। সম্পূর্ন ভিন্ন স্বাদের তথ্য চিত্র।        

দেরিয়াপুর অঞ্চল উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ড.উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়। তিনিই বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী নাট্যদলের কর্ণধার। তিনি  বলেন,  “২০০৩ সালের সূচনা লগ্ন থেকে অন্বেষা নাটক করে। তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।  হালখাতা নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু।  তৃতীয় শ্রেণী থেকে অন্বেষা ও রুপা নামে একটি মেয়ে অবশ্য এই নাট্যদলের সাথে যুক্ত। নাটকের সাথে হারিয়ে যাওয়ায়  হিউম্যান পাপেট নিয়ে অর্থাৎ নাটকের আদলে পুতুলনাচ বহুবার মঞ্চস্থ করেছেন তাঁরা। ধর্ম মঙ্গল নাটকের এক দৃশ্যে রাইবেশের নৃত্যের সাথে অনেকগুলো লোকশিল্পকে নাটককে এনেছেন তাঁরা। আর এইসব ভাবনা থেকেই বোঝা যায় নাটকই গড়েছে তাঁদের জীবনবোধ। তিনি বলেন, অন্বেষা নাটকের মেয়ে। আমার ছাত্রী। কুড়িটি বছর নাটকের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাই তার বিয়েটাও নাটকের মত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। আর সেটাই হয়েছে। কনে বিদায় অনুষ্ঠানটি হয়েছে সংস্কৃতিভবন থেকেই। বিদায় লগ্নে নব দম্পতিকে দিয়ে মঞ্চের পাশে একটি বকুল চারা লাগানো হয়েছে”।

একদিন বকুল মঞ্জরিত হবে। এই নাটকীয় দিনকে স্মরণে রেখে সেও হয়ত বলবে- বকুল  ফুল এসেছে- তুমি যে গিয়েছ বকুল বিছান পথে।
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours