কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
মুম্বইয়ের এক অনুষ্ঠান।
মঞ্চে
হাজির কিশোর কুমার। দুদিকে দুই সুরকারের জুটি- কল্যাণজি আনন্দজি। সেদিন
কিন্ত কিশোর কুমার তাঁর রংবাহারী সাজে ছিলেন না। একদম সোজাসাপটা
কোট-প্যান্ট। দুই সুরকারের সঙ্গে তাঁর সেই পরিচিত ঢংয়ে হাসিঠাট্টা। পেছনে
লাগা। খুনসুটি। কিশোর কুমার আচমকাই জিজ্ঞেস করলেন- "জীবনে এত নাচ গান
সিনেমা কেন?"
- "একেই বলে জীবনের সফর।" জবাব সুরকারের।
"ম্যায়
সমঝ গয়া," বললেন কিশোর কুমার। নিমেষেই ধরলেন, "জিন্দগি কা সফর/ হ্যায় ইয়ে
কেয়সি সফর।" নিমেষেই আপাদমস্তক বদলে গেলেন গায়ক। মুহূর্তেই তলিয়ে গেলেন এক
অতলান্ত আবেগে। ঝড় উঠলো উদাসী হাওয়ার। ভরাট গলার সুরে জীবনের আর্তি।
"কেয়সে জীবন দি হ্যায়
জো জিয়ে হি নহি!"
স্তব্ধ অডিটোরিয়াম। এক পলকে বদলে দিলেন গোটা পরিবেশ। কন্ঠের পৌরুষ কাকে বলে, তার নয়া সংজ্ঞা দিয়েছিলেন কিশোর কুমার।
সুরের
জাদুকর। সঙ্গীতশাস্ত্র- টাস্ত্রের কারবারী না। ছিলেন আবেগের ভান্ডারী।
রসের কারিগর। ভাবের ঘরে চুরি না বলে ডাকাতি বলাই ভালো। তাই মহম্মদ রফির মতো
ওস্তাদ গায়ককেও অনায়াসেই টপকে গেছিলেন কিশোর কুমার। "গানের স্পিরিটটা
ধরতে পেরেছিল কিশোর।" 'পড়োশন' সিনেমার সুপারহিট গান 'এক চতুর নার করকে
সিঙ্গার,' গানটা রেকর্ড করার পরেই মন্তব্য করেছিলেন সঙ্গীত জগতের আরেক
ওস্তাদ মান্না দে।
কিশোর
কুমারকে কিন্তু তেমনভাবে পায়নি বাংলা। বাংলা সিনেমায় একশো চুয়ান্নটার কিছু
বেশি গান গেয়েছেন। সেখানে হিন্দি ফিল্মিগানের সংখ্যা দু'হাজার ছশো
আটচল্লিশেরও বেশি। তবে বাংলার কিশোরভক্তরা চাতকের মতো অপেক্ষা করে থাকতো,
শিল্পীর পুজো সংখ্যার গানের জন্য। সেই বেসিক গানের সংখ্যাও সাতষট্টি
ছাড়িয়েছিল।
শুধু তো গায়কই না। অভিনয়টাও করতেন চুটিয়ে।
এখানেও সেই একই ছবি। মাত্র চারটে বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেই সরে
দাঁড়িয়েছিলেন কিশোর। সেখানে তাঁর অভিনীত হিন্দি ফিল্মের সংখ্যা উননব্বই।
তবে
বাংলার নবীন প্রজন্মের কাছে তিনি বরাবরই গুরু। কিন্তু যুক্তিহীন এক
রক্ষণশীলতায় ভুগতেন বাংলার প্রবীণ সঙ্গীত রসিকরা। কিশোর কুমারকে তাঁরা
সম্ভবত কোনদিনই মেনে নিতে পারেননি।
সেই
ষাটের যুগে একের পর আরেক বাংলা সিনেমায় গান গেয়েছিলেন তিনি। আজ ইউ টিউবের
দৌলতে সে সব গান অনেকেই শুনতে পান। কিন্তু সে যুগে রেডিও বা ঠিক কজনের
বাড়ির গ্রামাফোনে কিশোর কুমারের গান বাজতো সন্দেহ আছে। রফির নামের পাশে
যেহেতু শিক্ষিত গায়কের লেবেলটা ছিল, তাই তাঁর গান শোনাটা ঠিক অপরাধের মধ্যে
পড়তো না। সে যতোই 'ইয়াহু, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে' হোক না কেন। কিন্তু
কিশোর মানেই 'লারেলাপপা'। তাঁর ইয়ডলিং, উচ্ছল সুর কানে এলেই তেলেবেগুনে
জ্বলে উঠতেন বাবা কাকারা। তাতে সীলমোহর লাগতো 'পান দোকানের গান'।
দ্বিচারিতার চূড়ান্ত। পান চিবোবেন, কিন্তু পান দোকানের গান শুনবেন না। আর এ
সবকিছুই চলতো বাঙালির ঐতিহ্যের অজুহাতে। 'বম চিকা বম বম' ছাপটাই যেন
একমাত্র পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিশোর কুমারের।
প্রবাসী
বাঙালি। তাই হয়ত খানিক বেশিই ছিলো বাংলার ওপর নাড়ির টানটা। কিশোর কুমার
নিজেই প্রযোজনা করেছিলেন লুকোচুরি(1958)। নায়ক তিনি নিজেই। মজার সিনেমা।
হেমন্তের সুরে শোনা গেছিল, 'শিং নেই তবু নাম তার সিংহ'। বাঙালির শান্তশিষ্ট
পিলে চমকে উঠেছিলো ওই গান শুনে। এছাড়াও ছিলো, এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়।
সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুই গান। কিশোরের জাত চেনাবার জন্য যথেষ্ট।
প্রতিভা
চিনতে ভুল করেননি বাংলার ডাকসাইটে পরিচালক প্রয়াত সত্যজিত রায়। তিনি
স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন বাঙালির 'নাপসন্দ' কিশোরকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত
গাওয়ানোর। সাল 1964। চারুলতা সিনেমায় কিশোরের গলায় শোনা গেছিল, 'আমি চিনি
গো চিনি তোমারে'। ঠিক ওই রিদমে ওই গান, সে এক অনিন্দ্যসুন্দর অভিজ্ঞতা। বহু
বিতর্ক তৈরি হয়েছিল সেদিন ওই গায়কী নিয়ে।
সতেরো বছর
পরেও কিশোর কুমারের গায়কী নিয়ে বাংলা তার মানসিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে
পারেনি। 1981 সালে বাজারে এলো কিশোর কুমারের এক ডজন রবীন্দ্রসঙ্গীত।
তথাকথিত সঙ্গীতবোদ্ধাদের কাছে ওই সম্ভারও তেমন গ্রহনীয় মনে হয়নি।
আধুনিকতার
হাওয়া সযত্নে এড়িয়ে চলাই বাঙালির অভ্যাস। তাই রাহুল দেববর্মনের মতো আধুনিক
সুরকারের কম্পোজিশনে কিশোর কুমারের গানকেও ব্রাত্য করেছিল বাংলা। এমনকি
মহানায়কের লিপে গলা দিয়েও তিনি জাতে উঠতে পারেননি। সাল 1969। উত্তম কুমারের
জন্য প্রথমবার গোপেন মল্লিকের সুরে কিশোর কুমার গাইলেন- তাক ধিন তা, নেই
কোনও চিন্তা। সেই গানে কিশোর কুমারের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন ইলা বসু। শোনা
তো দূরের কথা, সেই গানের খবর ঠিক কজন বাঙালি রাখেন, তাতেও ঘোর সন্দেহ আছে।
এর
ঠিক এক বছর পরে এলো উত্তম তনুজার 'রাজকুমারী'। এবার রাহুল দেব বর্মনের
সুরে গাইলেন কিশোর। না, এবারেও বাঙালির মনে ধরলো না। তার দু বছর পর বাজারে
এলো হিন্দি 'অমর প্রেম'। রিলিজ হলো কটি পতঙ্গ, ইয়াদো কী বারাত, বঁধে হাত।
ওই সিনেমাগুলিতে শোনা গেল, রাজকুমারীর বাংলা গানগুলির হিন্দি ভার্সান। আর
প্রতিটা গানই হলো সুপার ডুপার হিট। তখন একেবারে হইহই ব্যাপার। বাঙালির ঘরে
ঘরেও বাজতে লাগলো সেই গান। কিশোর কুমারকে দিয়ে বাংলা সিনেমার গানে এক নতুন
স্বাদ আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রয়াত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। একটুকু ছোঁয়া
লাগে(1965), অনিন্দিতা(1972) সিনেমার গান শ্রোতারা শুনলেও, সেভাবে জনপ্রিয়
হলো না।
আর বাঙালিকেই বা দোষ দিই কিভাবে? কথায় আছে, যস্মিন দেশে যদাচার।
কলকাতা, বোমবের সব শিল্পীরাই তখন মঞ্চে গান গাইতেন বসে বা দাঁড়িয়ে। সামনে হারমোনিয়াম। ভাবগম্ভীর সঙ্গীত পরিবেশনা। মাপা কথা।
সেখানে
কিশোর কুমার কী করলেন? হাতে মাইক্রোফোন। অনেক সময়েই বিচিত্র সাজগোজ।
মঞ্চে এসেই হইচই। নেচেকুঁদে দর্শকদের মাতিয়ে দেওয়া। গানের ফাঁকে- ফাঁকেই
রঙ্গ রসিকতা। তাঁর এই হাবভাব মোটেই ভালো লাগেনি বাঙালির। রঙ্গ রসিকতার
সঙ্গে ফারাক করতে পারেনি বাচালতার। ফল ভোগ করতে হয়েছিল কিশোর কুমারকে।
বাংলার
শ্রোতা যখন কিশোর কুমারকে শুনতে রাজি হলেন , তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। 'কী
আশায় বাঁধি খেলাঘর!' সবাই চমকে উঠলেন শ্যামল মিত্রের সুরে, কিশোর কুমারের
দরদী কন্ঠে 'অমানুষ'(1975) সিনেমার গান শুনে। দারুণ হিট হলো 'আনন্দ
আশ্রম'(1977)- এর গান। 'লালকুঠি'(1978)- এর গানে মাতিয়ে দিলেন স্বপন জগমোহন
জুটি।
এরপর আশির দশকে অনুসন্ধান, ত্রয়ী, তিনমূর্তি,
গুরুদক্ষিণা। সময়ের অল্প পরিসরেই নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন শতাব্দীর সেরা
গায়ক। ওদিকে মহানায়কের জন্য কিশোর কুমার শেষবারের মতো গাইলেন 'ওগো বধূ
সুন্দরী'(1981) সিনেমায়। সবকটা গানই হিট।
সাল 1988।
বাংলা সিনেমার শেষ গানটা রেকর্ডিং করলেন কিশোর কুমার। 'ছন্নছাড়া' সিনেমার
জন্য শেষ প্লেব্যাকটা করেছিলেন প্রয়াত মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে। 'জীবন
অঙ্কটাকে মেলাতে গিয়ে কী পেলাম!'
তিনি
কী পেয়েছিলেন জানা নেই। তবে বাংলা তার অযৌক্তিক রক্ষণশীলতা কাটাতে পারলে
আরও অনেককিছুই পেতে পারতো। সহস্রাব্দে একটাই জন্মায় এমন বহুমুখী, বিরল
প্রতিভা।
জন্মেছিলেন নব্বই বছর আগে। আজ সেই বহুমুখী প্রতিভার জন্মতিথি। একথা হলপ করে বলা যায়, সময়ের অনেক আগেই জন্ম নিয়েছিলেন কিশোর কুমার।
(কিশোর কুমারের বর্ণময় জীবনের নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন সুজয় বাগচী)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours