fiture
অনুপ চক্রবর্তী, নাট্যকার, কলকাতা: শৈশবের অবচেতনার গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে গ্রামের যাত্রা পালার বর্ণময় স্মৃতি। শিশুর বুকের খাঁচায় হৃদপিণ্ডের অলিন্দে নিলয়ে তুফান তুলত সেইসব যাত্রাপালা। অর্ধশতকের বেশি পার হয়ে গেছে। ঝাপসা হয়ে গেছে সেসব দিন। ছোট্ট মফস্বল শহর। উলুবেড়িয়া। তারই অনতিদূরে গঙ্গার তীরে কালীনগর গ্রাম। সেই দূর অতীতে হরগৌরী নাট্যসমাজ নামে একটা যাত্রাদল ছিল। ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর তিনটে দিন ফুলেশ্বরে আমাদের বাড়ির উঠোনে তাদের যেসব যাত্রা দেখতাম সেসবের কিছুটা স্পষ্ট বা অস্পষ্ট স্মৃতিতে এখনও একই সঙ্গে রোমাঞ্চিত ও ভারাক্রান্ত হই। যাত্রায় দেখার সঙ্গে শোনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেই সব যাত্রা দেখে ও শুনে তখন প্রচণ্ড আবেগতাড়িত হতাম, যেরকম প্রতিক্রিয়া এখন বাস্তব কারণেই হবে না। কিন্তু শৈশবের সেই ভালোলাগা আজও অম্লান হয়ে আছে। সেই যাত্রাদলের পরিচালক ও প্রধান অভিনেতা গদাধর ত্রিবেদীর কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। ভরাট ও মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী সুদর্শন,শ্যামবর্ণ মধ্যযৌবনের সেই ঈষৎ খর্বাকার অভিনেতার অভিনয় তখন আচ্ছন্ন করে দিত। অভিযান পালায় মহম্মদ বিন তুঘলকের ভূমিকায়, বর্গী এলো দেশে পালায় দিবাকরের ভূমিকায়, রক্তের টান পালায় গিয়াসুদ্দিন বলবনের ভূমিকায় ------এরকম অনেক ভূমিকায় তাঁর ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিনয়, হাঁটাচলা, অভিব্যক্তি, স্বরক্ষেপণ ভীষণ ভালোলাগত। এসবই যদিও শৈশবের ভালোলাগা , তবুও আজও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। সমাজ এঁদের কথা কতটুকু মনে রেখেছে। দেহ পট সনে নট সকলি হারায়। ফেলুবাবু,হরিপদবাবু,সতীশবাবু,গোবিন্দ মেটে ----এঁদের কথাও মনে পড়ে। মনে পড়ে দুলিয়ে দেওয়া কনসার্টের কথাও। গ্রাম বাংলার অতীতের যাত্রাদলগুলোর কনসার্ট বাজনা,সংশ্লিষ্ট বাজনদার,শিল্পী,তাঁদের বাজনার যাবতীয় যন্ত্রাদি,বাজনশৈলী,নাটকীয়তা ইত্যাদির ইতিহাস রচনা ও গবেষণা অত্যন্ত জরুরী। কেননা এসব এখন হয় লুপ্ত বা দ্রুত বিলুপ্তির পথে। উলুবেড়িয়ার কালীনগর অঞ্চলের পঞ্চাশ বছর আগের হরগৌরী নাট্যসমাজ যাত্রাপার্টির কনসার্ট বাজনার ঝাপসা স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ে বিভিন্ন বাজনার জিনিস নিয়ে শিল্পী বাজনদারদের যাত্রার আসরের তিনদিক ঘিরে বসা ও যাত্রা শুরুর আগে অন্ততঃ পনের মিনিট কনসার্ট বাজানো। পাগল করা, আক্ষরিক অর্থেই বুকের রক্তে দোলা লাগানো সেই বাজনা শুনে গ্রামের অবশিষ্ট মানুষেরা, যারা তখনও আসেনি, তারা দলে দলে চলে আসত। অবশ্য সন্ধে থেকেই আশপাশের ও দূরের গ্রামগুলো থেকে আসা অসংখ্য মানুষ যাত্রা দেখতে ভীড় করত। যাত্রা শুরু হোত রাত দশটা নাগাদ। প্রথমে এক বা একাধিক সখীর নাচ। তারপর শুরু হোত যাত্রা। সারারাত ধরে যাত্রা হোত। আসরের তিনদিকে গ্যালারীর মতো উঠে যাওয়া সিঁড়িগুলোতে দর্শক বসত। পুজোর দালানের দিকের সিঁড়িগুলোতে বসত গ্রামের মহিলারা। 
নীচু বেড়া দিয়ে ঘেরা আসরের চারকোণে বাঁশের খুঁটিতে বাঁকানো লোহায় ঝুলিয়ে দেওয়া হোত বিশাল বিশাল ডেলাইট, যেসব এখন বিদ্যুতের যুগে সম্পূর্ণ লুপ্ত। অ্যান্টিক জিনিস হিসেবে এসব সংরক্ষণ করা দরকার ছিল।উথ্থানকাকা কাজ করত।গোটা বাড়ি চুনকাম করত। আসর সাজাত।চাটাই পেতে খইয়ে পাতলা গুড় ছড়িয়ে অগাধ মুড়কি তৈরি করত।প্রচণ্ড কাজের ছিল।যাত্রার আসর প্রস্তুত হোত চটের ওপর সাদা চাদর পেতে। যাত্রায় প্রবল উত্তেজনার মুহূর্ত তৈরি হোত তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধের সময়। বাজনার তালে তালে যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর আগে দুপক্ষের প্রবল পারস্পরিক আস্ফালন ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে ক্ল্যাইম্যাক্সের দিকে। একই সঙ্গে যুদ্ধের বাজনা শুরু হচ্ছে। শিশুমন উত্তেজনায় কাঁপছে। এই যুদ্ধ শুরু হল বলে। তারপর বাগযুদ্ধ বন্ধ করে লেগে গেল তরোয়ালের লড়াই।কী রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি! কূটের অভিনয় করত গোবিন্দদা। গোবিন্দ মেটে। কূটের শয়তানি দেখে গোবিন্দদার ওপর খুব রাগ হোত। এখন পরিণত মন ও দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে এইসব মেলোড্রামার শৈল্পিকতা বিচার করার প্রয়োজন নেই। গ্রামের সরল মানুষদের,শিশু মনগুলোকে তখন এইসব প্রবল আনন্দ দিত। এটাই বড় কথা। কত বিচিত্র সব পালা। বর্গী এলো দেশে পালায় বর্গীরাজার শান্তিপ্রিয় ভাই দিবাকর ভালবেসে ফেলেছে শত্রুপক্ষের রাজকন্যাকে। কিন্তু কর্তব্যের তাগিদে বাধ্য হয়ে প্রেমিকার বাবার বিরুদ্ধে উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। অন্তর্দ্বন্দ্বে ও দুঃখে তার হৃদয় চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কিংবা রাজা দেবীদাস পালায় দেবীদাসের ছেলেরা একে একে মারা যাচ্ছে। প্রিয়পক্ষের এইসব ট্র্যাজেডী,সর্বনাশ ও মৃত্যু দেখে ফ্লুটের করুণ সুরে দর্শক স্তব্ধ হয়ে যেত। বেদনার ঐসব মুহূর্তে দর্শকের কি একধরনের ক্যাথারসিস হোত না? মুগ্ধ হয়ে যেতাম হরিপদবাবুর সিরাজ বা বিষ্ণুর পোশাক,মেকআপ,অ্যাপিয়ারেন্স ও অভিনয়ে। পাষাণের মেয়ে পালায় সতীশবাবুর ত্রিশূল হাতে সতীর দেহ কাঁধে ক্রুদ্ধ শিবের দুরন্ত অভিনয় বা সর্বাঙ্গ কালো পোশাকে ঢাকা তারকাসুরের মাথা নামিয়ে সামনে ডান হাত বাড়িয়ে নাটকীয়ভাবে দৌড়ে ঢোকা রোমাঞ্চিত করত অপরিণত মনকে। সতী সাজত আমার বোনেরা। রক্তের টান পালায় অন্ধকার কারাকক্ষে শৃঙ্খলিত বন্দী সুলতানের যন্ত্রণার অভিনয়ে শিহরণ হোত। আলোকিত আসর। অথচ অন্ধকার কারাকক্ষ। এমনই অভিনয় গদাধরবাবুর যে আসরকে অন্ধকার মনে হোত। দুর্গেশনন্দিনী পালায় গজপতির ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে বিশাল বপুর অধিকারী ফেলুবাবু অভিনয়ের অঙ্গ হিসেবে সত্যি সত্যিই বড়ো থালা ভর্তি প্রচুর ভিজে চিঁড়ে খেতেন। সঙ্গে এক টুকরো লেবু ও চিনি দিতে হোত ওনাকে। সে এক মজার দৃশ্য। সুরেনদা বলে একজনকে মনে আছে। স্ত্রীচরিত্রে পার্ট করতেন। আরো অনেক পুরুষ অভিনেতাও ফিমেল রোল করত। নারী চরিত্রে অভিনয় করতে প্রথম যে অভিনেত্রী এলেন তাঁর নাম মীরা বোস। শুনেছি তিনি পরে সাহানা বোস নাম নিয়ে কলকাতার বড়ো যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। সতীর ঘাট পালায় তাঁর এক নাটকীয় এন্ট্রির কথা মনে পড়ে। বাড়ির দোতলায় পশ্চিমের দালানের প্রান্তের ঘরে তিনি মেকআপ নিতেন ও পোশাক পরতেন। ওটাই ছিল তাঁর গ্রীনরুম। যাত্রা চলছে। আসর থেকে তাঁর চরিত্রের নাম ধরে অন্য কোন চরিত্র চিৎকার করে তাঁকে ডাকছে। দোতলার দালান দিয়ে ‘যাই’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে আসছেন মীরা। তাঁর আঁচল কাঁধ থেকে ঝুলে মাটিতে লুটোচ্ছে। কী প্রচণ্ড মেলোড্রামা! সব দর্শক নীচের উঠোন থেকে দোতলার দিকে তাকিয়ে পুলকিত হয়ে এই প্রথম দেখছে এক অভিনেত্রীর প্রবল নাটকীয় অ্যাপিয়ারেন্স। আরতি নামের একটা মেয়ে শিশুশিল্পীর অভিনয় করত। ওর বাবা হারমোনিয়াম বাজাত। মনে পড়ে মাউথ অর্গানে একজন এফেক্ট মিউজিক হিসেবে বাজিয়েছিল রবীন্দ্র সুর ------সংকোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান। আর একজন অভিনেত্রী আবেগ কম্পিত স্বরে লতার আধুনিক গান গেয়েছিল। ঐতিহাসিক পালার সঙ্গে কি অদ্ভুত কম্বিনেশন। যাত্রায় বিবেকের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। গ্রীক নাটকের কোরাসের সঙ্গে বিবেকের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাধারণত কালো পোশাক পরা বিবেকের ভূমিকাভিনেতা নেতিবাচক নাট্য মুহূর্তে প্রবেশ করে উদাত্ত সুরে ও স্বরে গলা খুলে গান ধরত। খল চরিত্র ও অন্য চরিত্র তাদের চরিত্র hold করে দাঁড়িয়ে থাকত বা অতি সামান্য movement করত। বিবেকের গলার জোর এমন হোত যে পাশের গ্রাম থেকে শোনা যেত। মুগ্দ্ধতার সঙ্গে অনেকে বিবেককে গ্রহণ করত। ব্যাজার দর্শক কেউ কেউ অবশ্য বোর হয়ে এইসময় বাথরুম করতে যেত। আমাদের কাছারী ঘরটা সাজঘর হোত। সপ্তমীর বিকেলে যাত্রাদলের বড়ো বড়ো কালো ট্রাংকগুলো আসতে থাকলেই উত্তেজনা শুরু হোত। তারপর অভিনেতারাও এসে পড়ত। আমরা ছোটরা খুশিতে ডগমগ। বিকেল শেষ হতেই পুরুষ ড্যান্সার নিজেই নর্তকীর মেকআপ নিতে শুরু করত। তার মেকআপ চলত বেশ কয়েকঘন্টা ধরে। সব শিল্পীরই চড়া মেকআপ। ঝলমলে ড্রেস।
পরম ধৈর্যের সঙ্গে সব মেকআপ নেওয়া দেখতাম। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। গ্রামের এক বয়স্ক মানুষ প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁর মাথায় একটু গন্ডগোল ছিল। তিনি ছিলেন স্বঘোষিত আসর ম্যানেজার। একবার যাত্রাচলাকালীন হঠাৎ বাড়ির ভেলো নামের পোষা কুকুরটা আসরের প্রবেশপথ দিয়ে সোজা আসরের মধ্যে ঢুকেপড়ল। কি ভয়ানক অবস্থা। সেনাপতির পায়ে কুকুর জড়িয়ে যাচ্ছে। দর্শকরা হৈ হৈ করে উঠে আসরের পাশে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ ভদ্রলোককে চিৎকার করে বলছে ‘’দাদা, কুকুরটা তাড়িয়ে দিন’’। ভদ্রলোকের নির্লিপ্ত উত্তর: ‘’মালিকের কুকুর। আমি কি কিছু বলতে পারি?’’।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours