fiture
পারমিতা মালী, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কোন্নগর:

খেলা এমনি এমনিই শুরু হয়, ক্যাজুয়ালি। মজা করতে করতে । কেউ জানেই না যে তারও ভেতরে কখন বাবুইপাখি বাসা বুনছে। আর এডভেঞ্চারের নেশাটাও বড় মারাত্মক হয় যে। তারপর সময় এগিয়ে চলে দ্রুত। খুচখাচ, খুটখাট, ফিসফাস করে কুটো জোগাড় করতে থাকে সেই বাবুইপাখি। কারোর খেয়ালই থাকে না, কখন সে দেওয়াল তুলে ফেলেছে নিঃশব্দে । খড়ের দেওয়াল ঠিকই, কিন্তু আলো তো আটকায়! চোখের সামনে একটা অস্বচ্ছ আবরণ তো পড়ে! তারপর শুরু হয় মন্থন। ওপর-নিচে তোলপাড় করা মন্থন। পাশে বসা লোকও জানতেই পারে না কখন ভূমিকম্প ঘটে যায় অস্তিত্বের মধ্যে। শরীরের ভেতরে ময়াল সাপের মতো কে যেন নড়েচড়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ! সত্তায় ভর করে আসে সর্বনাশ। আর সেই সর্বনাশে ভর করে আসে জাদুকার্পেট। তারপর এই পৃথিবী টিথিবী পেরিয়ে কোথায় উড়াল দেয় সেই জাদুকার্পেট। চৌকাঠ ভেঙে মহাশূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই মহাশূন্যের কিনারা করতে, কোনো এক ভোররাতে চুপিচুপি বারো তলার ছাদে ওঠে এক কিশোরী। তারপর দু হাত মেলে পাখির মত উড়ান দেয় স্বপ্নরাজ্যে। তারপর মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে তার নিথর দেহ রক্তেমাখামাখি হয়ে। সে কন্যে তখন স্বপ্নরাজ্যে পাড়ি দিয়েছে।


                      সে কি খুব দুঃখী ছিলো? খুব কি তার অভাব ছিলো? ক রাত না খেয়ে থেকেছে সে এর আগে ?  দুঃখ শব্দের অর্থ কি সে জানে? সে কি জানে, যে,শুধুমাত্র বেঁচে থাকার লোভে, রাতের পর মরতে হয় মানুষকে ? জীবনযুদ্ধ কাকে বলে, সে কি জেনেছে ? মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাড়ির এই ছেলেমেয়েগুলো কিসের অপ্রাপ্তিতে এমন মৃত্যুকে জড়ায়? কী তাদের চাহিদা? ভালো খাওয়াপরা, সাধ্যমতো অর্থ, উজ্জ্বল কেরিয়ার,  তারপরও তারা খুশি হয় না কেন? বাবা মার কোল খালি করে চলে যায় অবলীলায়! বছর খানেক আগে নীলতিমির বিভীষিকায় কাঁটা হয়েছিল মধ্যবয়সী বাবা মায়েরা। কে জানে বাবা, কখন তাদের বাচ্চার মাথা বিগড়ে যায়! কী দিয়ে যে খুশি করবে তাদের, তাই তো বুঝে ওঠা যায় না!


             কিন্তু মৃত্যু তো মৃত্যুই। তা সে যেমনই হোক না কেন! যত সহানুভূতিরই দেওয়া হোক না, জীবন তাকে ভুলিয়ে দেবেই। একমাত্র যারা মৃত্যুঞ্জয় হতে পারেন, তাদের কথা আলাদা। সে তো মহাপুরুষরা হন!  অন্যথায়... জীবন বড় বেয়াড়া, জীবন বড় উদাসীন। তোমায় ও পাত্তা  দেবে না অযাচিতভাবে। সে তোমার সামনে থালি সাজিয়ে দেবে। রূপ রস গন্ধে ভরিয়ে রাখবে তোমায়, যদি তুমি চাও। আর.... যদি না চাও? যদি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থাকো ?  বয়ে গেছে তাতে। তার ঔদাসীন্য মারাত্মক। তোমাকে ভুলতে তার দু মিনিটও লাগবে না। এই জ্বলন্ত সত্যটা কি মৃত্যুকামী ছেলেমেয়েগুলো কোনোদিন বুঝবে?


        জিডি বিড়লার ক্লাস নাইনের একটি মেধাবী মেয়েকে পাওয়া যায় তার স্কুলের বাথরুমে। ২২শে জুন, ২০১৯... বাঁ হাতের শিরা কাটা, মুখের ওপর প্লাস্টিক পরানো, রক্তে ভেসে যাওয়া অবস্থায়। নিজের মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে শুধু হাত কাটার ওপর ভরসা করেনি সে। মুখ ঢেকে নিয়েছে প্লাস্টিকের মোড়কে। কী তীব্র কষ্ট পেয়েছিল সে মৃত্যুর আগে! অতটুকু একটা মেয়ে, কী এমন ঘটলো জীবনে যে এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! কেন এমন ভুল? পড়াশোনায় ভালো, বাবা মায়ের আদরের মেয়ে ওইটুকু বয়সে কোন ভূত দেখলো সে? নাকি অনেক রাত না ঘুমিয়ে চিরতরে ঘুমোতে চলে গেলো মেয়েটা ?


                 মেডিকেল রিপোর্টে লেখা ছিলো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তার। শুধুমাত্র  শিরা কাটলে সে বেঁচে যেতেও পারত। মৃত্যুর জন্য বিন্দুমাত্র ফাঁক ছাড়েনি সে। তাই মুখ ঢেকেছিল দুর্ভেদ্য প্লাস্টিকে। তার নাকি তীব্র মেন্টাল প্রেশার ছিলো। অত চাপ সে আর নিতে পারছিলো না, তাই, এমন সিদ্ধান্ত। একটা ঝকঝকে সম্ভাবনাময় জীবন অবলীলায়  হারিয়ে গেলো!


            স্বেচ্ছামৃত্যু অপরাধ। ক্ষমাহীন অপরাধ। চোদ্দো বছরের একটা জীবন,  কতটুকু কষ্ট দেখেছে সে? কতটুকু চাপ সহ্য করেছে ?  সে জানে, কতটা খারাপ ভাবে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে ? সে কি জানে, যে তীব্র শারীরিক মানসিক নির্যাতন ঠিক কাকে বলে? সে কি জেনে গেছিল , যে বাইরের দুনিয়াটা ঠিক কতটা নিষ্ঠুর? বাবা মা র চাপ তো তার তুলনায় নস্যি! সেতো স্বর্গসুখ ! 


          আর কারোর বাপ মা ই তো দেবতা নয়!  লোভ হিংসে কামনা বাসনা মেশানো ছোট ছোট প্রাণী মাত্র! অফিস, কাছারি, পরিবার, পরিজন মিশিয়ে ধুসর এক একটা রঙের শেড! ভালোমন্দ মিশিয়ে।  জিনের স্বাভাবিক তাড়নায় সে তার অপত্যকে রক্ষা করে। তাকে বড় করে তোলে, যাতে সে দুনিয়ায় লড়ে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু....সেটা কতদিন? কাক চড়ুই এর থেকে রক্ষা পাবার পরই গাছ তরতর করে বেড়ে ওঠে। কিছু গাছ ঝড় জল বাদলে মরে, কিছু গাছ ঠিক টিকিয়ে নেয় নিজেকে। যেভাবে হোক বেঁচে থাকে। যারা মরে যায় তাদের প্রতি প্রকৃতি উদাসীন। 


            স্বেচ্ছামৃত্যুর মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। এই সহজ সত্যটুকু যত তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।  অভিমানকে পাত্তা দেয় না জীবন। শুধু বেঁচে থাকতে পারলেই হাজার পথ তোমার সামনে! লক্ষ লক্ষ গলি উপগলি... যে পথে ইচ্ছে হয় যেয়ো ! যদি ভুল করো, পথ পাল্টাও! আবার ভুল তো আবার পাল্টাও... বারবার বাজী রেখো নিজেকে!  হাজার ঝড় ঝাপটা দাঁতে দাঁত চিপে যদি সহ্য করে নিতে পারো, দেখবে জীবন তোমারই জন্য সাজিয়ে রেখেছে কোনো এক ম্যাজিক্যাল ভোর অথবা স্বপ্নিল রাত্রি।

          আর সেসব যদি নাও পাওয়া যায়, শুধু বেঁচে থাকাটাই তো কম থ্রিলিং নয়...!!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours