fiture
অঙ্কুর চক্রবর্তী, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

কাশ্মীরের বর্তমানের সাথে বাংলার সম্পর্ক কি?  ভাবছেন নিশ্চয়ই? সম্পর্ক যেমন আপাতদৃষ্টিতে নেই ঠিকই, তেমনই আছে অবশ্যই।
কেমন?
একটু বিশদে বলি।
কাশ্মীর ইস্যু টিঁকে ছিল, এবং আছে ১৯৪৮ সাল থেকেই। এবং টিকিয়ে রাখা হয়েছে এত বছর যাবৎ। কিন্তু কেন? কারন, সেটা দরকার ছিল পাকিস্তান জুজু দেখিয়ে ভারতীয়দের বোকা বানিয়ে রাখার জন্য।
এবং ভোটার যেহেতু আজীবনই অচেতন, তাই এই জুজু খুব সুন্দর ভাবে ভোট পাইয়ে দিতে সুবিধা করেছে যে যখনই দিল্লির মসনদে বসেছে, তাকে।
কিন্তু এতদিনের পাকিস্তানের চরিত্রে বদল এসেছে। তার ওপর পুলওয়ামা কাণ্ডের পরে জনতার মধ্যে একটা যুদ্ধ জিগির তুলে ভোটের বৈতরণী পার হয়ে গেলেও দিনের শেষে "হাউজ দ্য জোশ" কাজ করেনি। থিতিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রচারে। 
মিসাইল ঝেড়ে কাক মরে, মোদীজির কেরামতি বাড়ে....
তাছাড়া ইমরান আর মোদির ভিতরের সুসম্পর্ক নষ্ট করার মত প্রয়োজনও এর ছিল না। মগজ বন্ধক রাখা জনগন জানতেও পারে না যে এই প্রক্রিয়া কবে থেকে শুরু হয়ে গেছে। সেই প্রক্রিয়ারই অংশ পাক সেনার নির্দেশে নওয়াজ শরিফের অপসারণ এবং সেই জায়গায় ইমরান খানকে বসানো। আশা করি এটা সবাইই একবাক্যে স্বীকার করবে যে পাকিস্তানে নির্বাচন বলে যা হয় সেটা সম্পূর্ন সেনা নিয়ন্ত্রিত একটা প্রহসন। 
তারপরে পুলওয়ামা কান্ড। যুদ্ধ যুদ্ধ জিগির জিইয়ে রাখা। অভিনন্দন বর্তমানের গ্রেপ্তারি এবং ছাড়া পাওয়া। পাবলিককে সেটা মোদির সাফল্য হিসেবেই খাওয়ানো হল। যা স্বাভাবিক অবস্থায় একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। ঠিক যেভাবে বিমুদ্রাকরণ নামক অর্থনৈতিক ব্যর্থতাকেও "মাস্টারস্ট্রোক" বলে চালানো হয়েছে।
নির্বাচনের ফলে মোদির ক্লিন-স্যুইপ এবং ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা ডানদিকে হেলে ফ্যাসিজমকে জায়গা ছেড়ে দিতে শুরু করলো। কিন্তু ভারত ওয়াকিবহাল যে এই মূহুর্তে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়ানোর মত রসদ তার কাছে নেই। অতএব?....
অতএব কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি। 
যারা জীবনে সংবিধানের নামও শোনেনি, একদিনে তারা ৩৭০ এবং ৩৫(ক) ধারা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলো। ছেয়ে গেল আপনার ফেসবুক সময়রেখা এবং আপনি ভাবলেন এটাও মোদির সাফল্য। এদিকে চাপা পড়ে গেল উন্নাও ধর্ষণ ও খুনের ইস্যু।
কাশ্মীরকে কব্জা করার জন্য আগে থাকতেই অমরনাথ যাত্রা সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার অজুহাতে বন্ধ করে এলাকা ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছিল কিছু আগেই। মোতায়েন করা হল সেনা। এবং কাশ্মীরের সাথে কথাবার্তা না বলেই বাতিল করে দেওয়া হল ঐ বিতর্কিত ও বহুচর্চিত ধারা। কাশ্মীরের নেতারা হলেন গৃহবন্দী।
এরপর কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যেমন ধরুন, কাশ্মীরের নারীরা হয়ে যাবে গনিমতের মাল। ইতিমধ্যেই ফেসবুকে নানা পোস্টে কাশ্মীরি মহিলা বাছাইয়ের গল্প শুরু হয়ে গেছে। কাশ্মীরের অর্থনীতির রাশ চলে যাবে হিন্দিভাষী এবং গুজরাটনিবাসীদের হাতে। এবং ধীরে ধীরে কাশ্মীর সব অর্থেই হয়ে উঠবে "হিন্দুস্তান"-এর অংশ।
ভাবছেন, কাশ্মীরি পন্ডিতরা সুবিচার পাবে? সে গুড়ে বালি। ওটা রামমন্দির গোত্রের খুড়োর কল।
যেভাবে ইন্দিরা গান্ধী বিছিন্নতাবাদী তকমা লাগিয়ে পাঞ্জাবের খালিস্তানী আন্দোলন দমন করেছিলেন, এবং তার ফলে পাঞ্জাব হয়ে উঠেছিল ভারতের "অবিচ্ছেদ্য" অঙ্গ, মোদিও সেভাবেই কাশ্মীরকে ভারতের "অবিচ্ছেদ্য" অঙ্গ বানানোর শুভ সূচনা করলেন। আশা করা যেতেই পারে যে এখন থেকে আর উনিশ মাসের কাশ্মীরি শিশুর চোখে পেলেট গান চালানোর মত অথবা লিটুল বড়ুয়ারা সাধারণ কাশ্মিরীদের জিপের সামনে বেঁধে ভ্রমণ করার মত "বিশেষ সুবিধা" আর কাশ্মীরিরা পাবে না। এবং পরবর্তী কাশ্মীরি প্রজন্ম কেন্দ্রশাসিত হওয়ার সুবাদে সহজেই, অল্প দামে মদ পাবে (যে কারনে দমন-দিউতে পর্যটক যায় আরকি) অথবা খালিস্তানী আন্দোলন পরবর্তী পাঞ্জাবের বর্তমান প্রজন্মের মত নিজের ভাষার হরফ ভুলে মেতে উঠবে ড্রাগের নেশায়!
এবার আসি এর সাথে বাংলার কি সম্পর্ক, সে বিষয়ে। ইতিমধ্যেই বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত....না না পার্শ্ববর্তী আসামের এনারসি পীড়িত বাঙালির ক্রন্দনধ্বনিতে নয়। বাংলায় মোদি যুগ শুরু হওয়ার এবং এনারসির মাধ্যমে "বাংলাদেশী" তাড়ানোর উৎসবে সূচনার আনন্দধ্বনিতে।
কিন্তু, কেউ, এমনকি বাংলার সরকারও সম্ভবত দেখতে পাচ্ছে না যে যেভাবে কাশ্মিরকে ভাঙা হল, দখল করা হল, এর ফলে একইভাবে বাংলা ভেঙে গোর্খাল্যান্ড বের করার তোড়জোড় শুরু হবে। তাতে কি? আমরা কি এখন পরাধীন যে "বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন" করতে হবে? তার চেয়ে বরং বাংলাকে আরও কয়েকটা ভাগে ভেঙে দেওয়া যাক। যেমন ধরুন হিন্দিভাষী জনসংখ্যা লাগামহীনভাবে বেড়ে চলা পশ্চিম বর্ধমান জেলা, ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়া জেলাকে জুড়ে দেওয়া হোক ঝাড়খণ্ডের সাথে। এই হুগলি শিল্পঞ্চলকে বিশেষ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের "মর্যাদা" দেওয়া হোক। কারন, কেন্দ্র চালায় যে জনগোষ্ঠী, তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীরাই তো ওই অঞ্চলে এখন সংখ্যাগুরু।
এ তো গেল ভবিষ্যতের কল্পনাবিলাস। আসল গল্পের শিকড় আরও গভীরে। 
ভারত রাষ্ট্রের দুটো যুদ্ধ জয় হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সীমান্তে থাকা খালিস্তান থুড়ি পাঞ্জাব। এবং কাশ্মীর। তাই যুদ্ধ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, অস্ত্রের কেনাবেচার নানা নতুন চুক্তি বহাল রাখতে হলে যুদ্ধ চাই যে। অন্তত যুদ্ধ জিগির হলেও চলবে। পশ্চিমের সীমান্ত এখন সিকিওর্ড। পূর্বের সীমান্তে আছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই ক্রিকেট আর মন্দির ভাঙা, হিন্দু নিধন, প্রিয়া সাহা, নোবেলের রবিঠাকুরের গানের বিরোধিতা, সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ বিদ্বেষের মালমসলা রেডি। রান্না করে ফেলতে হলে দরকার এনারসি। আপ্যার চারপাশে হিন্দুস্তানী বেড়ে গেলেও আপনাকে বুঝতে হবে আসলে বেড়েছে বাংলাদেশি। আপনার কাজের সব সুযোগ সুবিধা খেয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ। 
কিন্তু হিসেব বলছে উল্টো কথা, বাংলাদেশের অর্থনীতি উর্ধ্বগামী আর ভারতের রেখা উল্টোদিকে যাচ্ছে। তাই জনবিন্যাস বদলের গল্পটাও উল্টোভাবেই বোঝানো দরকার। আর সেজন্যই এনারসি।
ইতিমধ্যেই গত এক দশকের কিছু বেশি সময় বাঙালির এক বিরাট জনসংখ্যাকে "বাংলায় কাজ নেই", "আপনি আগে ভারতীয়, পরে বাঙালি" বলে হয় হিন্দিতে সরগর করে নেওয়া হয়েছে (পরের প্রজন্মের জন্য আছে হিন্দিভাষী কার্টুন। যার বাজার বাংলাদেশেও বিরাট হিট) আর নয়তো মূল থেকে উপড়ে গুরগাঁও, নয়ডা বা ব্যাঙ্গালোরে স্বেচ্ছা নির্বাসনে
পাঠিয়ে দিয়ে বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে করে দেওয়া হয়েছে "ইন্ডিয়ান"। তার মধ্যে ভরপুর বাংলাদেশি ঘৃণা। নিজে গুরগাঁওতে থেকে বাবা-মা'কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালেও, তার ঠাকুরদা মুসলমানের কাছে মার খেয়ে এপারে পালিয়ে এসেছিল বলে তার ভিতরের মুসলমান-ঘৃণা এবং বাংলা-দ্বেষ একদম উপচে পড়ছে। ব্যস, আর কি অস্ত্র চাই?
এনারসি করে বাঙালিকে লুপ্ত করা হলেই সীমান্ত পরিষ্কার। না, হয়তো অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, তবে ভাষা-যুদ্ধে নিশ্চিতভাবে দখল করা হবে বাংলাদেশ। মিশন ২০৩০। আরএসএস-বিজেপির সুপ্ত এজেন্ডা এটাই।
আপনি নাচবেন। আপনার জমি,জায়গা সব গেল। তো কি এলো গেল? মোদীজি কথা দিয়েছিলেন, "অখন্ড ভারত বানাবো"। উনি এক কথার মানুষ। বেলুচিস্তান নিয়ে নিজেই জর্জরিত পাকিস্তান টু রোহিঙ্গা ইস্যু-পীড়িত মায়ানমার অব্দি হিন্দুস্তান বাড় রাহা হ্যায়।
এমন সময় স্বার্থপর হয়ে আপনি কেন কেবল বাংলার কথা ভাববেন?
দেশের কথা ভাবুন।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours