মণিজিঞ্জির সান্যাল, লেখিকা, শিলিগুড়িঃ
এখানে
যে আমি কতোবার গেছি আর কেন-ই বা যাই এক-ই জায়গায় বারেবারে আমি জানি না ।
আসলে যতোবার যাই অনুভূতির রংটা অদ্ভুত ভাবে পালটে যায়। ভীষণ এক শান্তি
অনুভব করি শরীরে আর মনে .....
স্বপ্ন
যে এই ভাবে সত্যি হতে পারে তা ভাবিনি কখনও। আসলে আমাদের জীবনে কিছু স্বপ্ন
স্বপ্নই থেকে যায়, কিছু স্বপ্ন আবার সত্যি হয়ে ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরকে যেন ঠিক সেই ভাবেই অনুভব করলাম যা আমি স্বপ্নে দেখতাম প্রতিনিয়ত।
বৈশাখ মাসে আমারও জন্মদিন, ২৯ শে বৈশাখ , ইং -১৩ই মে । এবারের জন্মদিনে
সেই দিনটি কাটালাম রবীন্দ্র বাসভবনে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি অদ্ভুত ভাবে এসে ধরা
দিল বৈশাখের সেই সকালে। আমরা পরিবারের সবাই মিলে রওনা দিলাম দার্জিলিং
জেলায় অবস্থিত এই ছোট্ট সুন্দর শহর মংপুর উদ্দেশ্যে, শিলিগুড়ি থেকে যা ৫২
কিমি দূরে অবস্থিত। অন্যদিকে দার্জিলিং থেকে মংপুর দূরত্ব মাত্র ৩৩কিমি ।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তার গা বেয়ে আমরা ঠিক যেখানে গিয়ে পৌঁছলাম তার একদিকে কুইনাইন ফ্যাক্টরী আর ঠিক তার উলটোদিকে রবীন্দ্র বাসভবন।
১৮৬২
ব্রিটিশরা প্রথম সিঙ্কোনা চাষের জন্যে ডুয়ার্সের দুটো অঞ্চল মংপু আর
লাটপাঞ্চরকে বেছে নিয়েছিল।সিঙ্কোনা গাছের ছাল বা বাকল জাহাজে করে পাঠানো
হতো ব্রিটেনে কুইনাইন প্রস্তুতির জন্যে।
আমাদের সকলের
প্রিয় সাহিত্যিক " ন হন্যতে খ্যাত " মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী মনমোহন সেন
কাজের সূত্রে এই মংপুতে থাকতেন। সিঙ্কোনা প্রজেক্টের বাংলোতেই ছিল তাদের
বাস। পরোবর্তীতে মৈত্রেয়ী দেবীর আন্তরিক আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই
বাংলোতেই থাকতে শুরু করলেন এবং কবিগুরু নিজের মতো করে তার ঘরগুলোকে সাজিয়ে
তুললেন যা কিনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এই বাংলোটিই তারপর দীক্ষিত হল নতুন
রূপে, যার নাম দেওয়া হল " রবীন্দ্রভবন " । ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর বেশ কয়েকবার এই বাস ভবনে এসে থেকেছেন।
মংপু
থেকে ৪কিমি ওপরে " সুরেল কুঠিতে " কবিগুরু রচনা করেছিলেন তাঁর
"ক্যামেলিয়া " কবিতাটি। এরপর বহুবার তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন এই ছোট্ট পাহাড়ী
শহর টিতে।১৯৮৬ সালে যদিও সুরেল কুঠি ধংস হয়ে যায়।
আজকের
এই রবীন্দ্র ভবনও ভূমিকম্পের ফলে বেশ অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত । কিন্তু কিছু
অনুভূতিপরায়ণ নেপালি মানুষের ভালোবাসায় আজও তার টুকরো কিছু অবশিষ্ট।
বাসভবনটিতে
আমি যখন প্রবেশ করলাম তখন ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ
সারা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাংলোটিকে দু'চোখ ভরে দেখছিলাম। লম্বা লম্বা
সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে যখন হাঁটছিলাম আমি , তখন প্রতি মুহূর্তে আমি শিহরিত
হচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কবি গুরু যেন প্রতিটি জায়গা জুড়ে অবস্থান করছেন
।সামনের বাগানটিতে শুধু গন্ধরাজ ফুলের সমারহ , পেছনে ক্যামিলিয়া। আহা !
ওই দূরে সবুজ পাইন গাছ, চারদিকে সবুজ পাহাড়।সবুজে সবুজে মনটা যেন এক অদ্ভুত
আবেগে দোলা দিয়ে উঠল । একজন নেপালি ভদ্রলোক ছুটে এসে তালা খুলে মিষ্টি
হেসে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। চটি জুতো খুলে সিঁড়িতে প্রণাম করে কাঁচের
দরজাটা খুলতেই প্রশস্ত বারান্দা, আর সামনের চেয়ারেই কবির ছবি, যেন অতিথিদের
সাদরে আহ্বান করছেন অন্দরে প্রবেশের জন্যে। আমার সারা শরীরে কাঁটা
দিচ্ছিল।কবির চোখ দুটো এতো জ্বলজ্বলে যেন মনে হচ্ছে আমার মনের সব কথা তিনি
বুঝে যাচ্ছেন কতো সহজেই। সামনে সুন্দর আলপনা আর ছবির চারপাশে গন্ধরাজ ফুল
যেন আরো বেশি জীবন্ত করে তুলেছে ওই দুটো চোখকে। আমার চোখে কেন জানি তখন জল
টলটল করছে।আমি ভাবতে পারছি না এই বারান্দায় কবি হাঁটতেন, বসতেন।আমি অভিভূত।
এরপর ক্রমান্বয়ে আমরা কবির বসার ঘর , শোবার ঘর, স্নানের ঘর, লেখার ঘর ,
ছবি আঁকার ঘরকে প্রত্যক্ষ করলাম। আমি যেন বহুবছর আগের সেই দিনগুলোতে পৌঁছে
গেছি যেখানে কবি ছবি আঁকছেন, কখনও লিখছেন একের পর এক চিত্রকথা, তাঁর
শব্দমালায় ভরে যাচ্ছে সুন্দর পাতাগুলি। কখনো বা কবি হেলান দিয়ে বসে ওই দূর
পাহাড়ের দিকে চেয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন একের পর এক চরিত্র। কাঁচের জানালা
খুলতেই কবির পড়ার ঘরে প্রবেশ করল একরাশ সূর্যরশ্মি, গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ,
চোখের সামনে এসে ভিড় করল ওই উড়ে যাওয়া মেঘ গুলো, সবুজ পাহাড়, ক্যামেলিয়া
ফুল, পাহাড়ী নদী।
স্নান ঘরে গিয়ে দেখলাম বাথটাব ,
শিহরিত হলাম তাঁর শৌখিনতা দেখে । শোবার ঘরে বক্স খাট , ভাবা যায় সেই সময়
বক্স খাট ! তাঁর হাতে আঁকা ছবি চারদিকে সাজানো।অন্য একটি ঘরে রং তুলি ঠিক
আগের মতোই সাজানো । নীল ,কমলা , সবুজ রং গুলো ছোট্ট ছোট্ট শিশিতে স্তরে
স্তরে সাজানো । অন্য একটি ঘরে একটি সেলফে ছোট্ট ছোট্ট শিশিতে আবার
হোমিওপ্যাথি ওষুধ, এখনো ওষুধের কিছু অংশ পড়ে আছে।আমি স্পর্শ করলাম শিশিগুলো
, যেখানে কবিগুরুর স্পর্শ আমি যেন পরিষ্কার উপলব্ধি করলাম।
পড়ার
ঘরে লেখার টেবিলে প্রবেশ করে আমি আমার চোখের জলকে কিছুতেই ধরে রাখতে
পারলাম না। কবি এই চেয়ারে বসে লিখতেন,ভাবতেই আমি যেন আবার অন্য জগতে চলে
গেলাম । চোখে আবার জল চলে এলো। টেবিলে কাঁচের তলায় ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা
যা কবি নিয়মিত পড়তেন। আমার হৃদয়ের অন্তঃপুরে কে যেন বলছে " এই তো আমি আছি
প্রতি মুহূর্তে তোমাদেরই কাছে। " ফেরার সময় গন্ধরাজ ফুলের গন্ধকে সারা
শরীরে মেখে সামান্য স্পর্শ করলাম কবির প্রিয় ফুলকে, যেন মনে হলো কবি গুরুর
চরণ স্পর্শ করলাম।হঠাৎ কে যেন আমায় বলল " হ্যাপি বার্থ ডে ম্যাম "। আমি
চমকে উঠলাম , দেখলাম আমাদের সারাক্ষণের নেপালি বন্ধুটি কখন যেন জেনে গিয়েছে
আমার আজ জন্মদিন। আমি জলভরা চোখে হাসলাম। বন্ধুটি আমার একটি কাব্যগ্রন্থ
ওখানকার গ্রন্থাগারে রেখেদিলেন আর বললেন " যতদিন পারব আমরা এই বাসভবনটিকে
বাঁচিয়ে রাখব সরকারি সাহায্য পাই বা না পাই। " আমি শুধু মনে
মনে বললাম " ঈশ্বর ভূমিকম্পের হাত থেকে একমাত্র তুমিই পারো একে বাঁচাতে ।"
মনে বললাম " ঈশ্বর ভূমিকম্পের হাত থেকে একমাত্র তুমিই পারো একে বাঁচাতে ।"
আমাদের গাড়ি নামছে পাহাড়ের গা বেয়ে । আমি যেন পরিষ্কার শুনতে পেলাম কবি গাইছেন " মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে ................."
Post A Comment:
0 comments so far,add yours