protibedon


কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:


ক্রুশবিদ্ধ মানবপিতা। রক্তময় শরীর। শরীরের জ্বালা- যন্ত্রণা মুখে ছাপ ফেলতে পারেনি। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো চিরপরিচিত সেই স্মিত হাসি। শান্ত চোখ। ক্ষমাসুন্দর সেই ছবি দেখেই কবিগুরু ডাক দিয়েছিলেন,
'আজি শুভদিনে পিতার ভবনে অমৃতসদনে চললো যাই !'
- তা পিতার সেই ভবনটি কোথায়?
ক্লাসসুদ্ধ সবাই ফার্স্ট বেঞ্চে বসা সুবোধ বালকের মতো চেঁচিয়ে উঠবে- বেথলেহেম।
- পিতার সমাধি কোথায় ?
এবার জবাব আসবে- জেরুজালেম।
কিন্তু একদল চুপ। তাঁরা সহমত নন। তাঁদের মত অন্য। পিতার অন্তিম শয়ান কাশ্মীরে। এই মতের প্রবক্তারা মুসলিম সম্প্রদায়েরই এক গোষ্ঠী। তাঁদের বিশ্বাস, যিশু খ্রিস্ট দেহ রেখেছিলেন এই কাশ্মীরের বুকে।
যিশুর হিমালয়যাত্রার কথা বলা আছে হিন্দুর ভবিষ্য পুরাণেও। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল শক সম্রাট শালিবাহনের।

'সব ঝুটা হ্যায়। আদৌ ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি যীশুকে। মৃত্যু তাঁকে বরণ করে নিয়েছিল প্রকৃতির নিয়ম মেনেই। একদম স্বাভাবিকভাবেই।' এমনটাই বিশ্বাস আহমেদিয়া গোষ্ঠির।
প্রভু যিশুর সমাধিও দেখিয়ে দেবেন তাঁরা একবাক্যে। শ্রীনগরের এক ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা, খন্যার। সেখানেই শান্তির দূত যিশুর সমাধিস্থল, রোজাবাল। সবুজ চাদরে মোড়া সমাধি। শান্তির দূত যিশুর পুণ্যভূমি হয়ে গেছিল কাশ্মীরের এক উপদ্রুত অঞ্চল। এতদিন পর্যন্ত ওই এলাকায় পা রাখলেই দেখা যেত, সুরক্ষা বাহিনীর অতন্দ্র চোখ চষে ফেলছে গোটা এলাকা। কী জানি কখন পাথরবাজদের দৌরাত্ম শুরু হয়!

খাতাকলমে অবশ্য রোজাবালের পরিচয় য়ুজা আসিফের সমাধি। কিন্তু এই য়ুজা আসিফ কে?
তিনি মধ্যযুগের এক মুসলিম ধর্ম প্রচারক। মোল্লা নাজিরের 'তারিক-এ-কাশ্মীর' বইয়ে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। আসিফ সুদূর প্যালেস্টাইন থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় এসেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, ঈশ্বরের দূত হয়েই তিনি এসেছেন। অনেকেই বলেন, সম্রাট আকবরের এক সভা কবি আবুল ফজল ফৈজি, যিশুকে য়ুজা বলে সম্বোধন করেছিলেন। তাহলে কি য়ুজাই যিশু? সঙ্গত প্রশ্ন। একই মানুষের দুই নাম।
তবে ওই যে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু ! ওসব তর্কাতর্কির মধ্যে না গিয়ে  অনেকেরই বিশ্বাস, ওই সমাধি 'জেসাস অফ নাজারেথ' ওরফে যিশুর।

তবে এই তত্ত্ব কিন্তু  সুপ্রাচীন নয়। এই তত্ত্বের প্রথম দাবিদার মির্জা গুলাম আহমেদ কাঁদিয়ান  (1835-1908)। ভারতে আহমেদিয়া গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। 1899 সালে উর্দুতে লেখা তাঁর 'মসিহা হিন্দুস্তান  মে' বই প্রকাশিত হওয়ার পরেই বিতর্কের ঝড় তোলে। যিশুর মৃত্যু নিয়ে বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত ধ্যানধারাকে তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেন।
গুরুর ওই তত্ত্বের ব্যাখ্যা করে পরবর্তীতে বই লিখে ফেলেন মুফতি সাদিক, খোয়াজা নাজির আহমেদ, লন্ডন মসজিদের প্রাক্তন ইমাম মৌলানা জালালুদ্দিন শামসের মতো শিষ্যরা। তবে গোটা ব্যাপারটাই দাঁড়িয়েছিল বিশ্বাসের ওপরে। কাশ্মীরে যীশুর মৃত্যু বা সমাধিস্থলের কোনটাই, কোনও দিন সন্দেহের উর্ধ্বে ছিল না। এর মূল কারণ ছিল তথ্যপ্রমাণ, ঐতিহাসিক সাক্ষ্যসাবুদের অভাব। বিদেশী ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বী কিছু মানুষও অবশ্য বিশ্বাস করেন, যিশু কাশ্মীরে গেছিলেন। কিন্তু সেখানেই মারা যাওয়ার ঘটনায় তাঁদের বিশ্বাস নেই।

আহমেদিয়াদের বিশ্বাসটা ঠিক কিরকম?
তাঁদের দাবি, পুনর্জন্ম হয় যিশুর। পরবর্তী জন্মে তিনি আবির্ভূত হন ধর্মগুরু মির্জা কাঁদিয়ান রূপে। আঠারো শতাব্দীতে অমৃতসরের সামনে কাঁদিয়ানে জন্ম বলেই ওই নাম। তিনি প্রয়াত হন এই উপ মহাদেশেই। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক, মহম্মদ শেষ পয়গম্বর ছিলেন বলে মানতে রাজি না কাঁদিয়ানের অনুগামীরা। তবে আহমেদিয়াদের মত যাই হোক না কেন, সুন্নি মুসলমানরা ওই তত্ত্ব বিশ্বাস করে না। এমনকি এই ধর্মবিশ্বাসের জন্য, পাকিস্তান আহমেদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করেছে।

তবুও তাঁদের মতে অনড় আহমেদিয়া সম্প্রদায়। তবে এলাকার মানুষরা রোজাবালকে য়ুজ আসাফের
সমাধি বলেই চেনে। এরই মধ্যে কিছু মানুষ আবার অন্য কথা বলেন। তাঁদের মত, হতে পারে যিশু তাঁর মাতৃভূমি বেথলেহেম থেকে যাত্রা শুরুর পর নাম বদলে য়ুজা আসাফ হন। তার কারণটাও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তখন ইহুদিরা খেপে উঠেছিল যিশুর ওপরে। ধরা পড়লেই হয়ত খুন হয়ে যেতেন তিনি। তাই য়ুজা নামে পরিচিত হয়ে, যিশু নিজের আসল পরিচয় গোপন করতে চেয়েছিলেন।
সারাদিন পথ চলা। ক্লান্ত হয়ে পড়লে পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয়। এরপর একদিন তিনি পৌঁছে গেছিলেন বেথলেহেম থেকে তিন হাজার আটশো আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরের কাশ্মীরে। আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই ছবির মতো সুন্দর উপত্যকায়।

গসপেলেও যিশুর জীবনের এক হারিয়ে যাওয়া অংশের কথা বলা হয়েছে। যিশু তখন সবে বারো বছরের এক কিশোর। হঠাত করেই তিনি উধাও হয়ে যান। এরপর যখন তাঁর খোঁজ মেলে, তখন তিনি পূর্ণ যুবক। বয়স তিরিশ। জীবনের ওই সময়টা যিশু কাশ্মীরে কাটিয়ে থাকতে পারেন বলে অনেকের অনুমান। প্রবাদ আছে শুধু যিশু না, ইজরায়েলের প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া দশটি উপজাতির মানুষও কাশ্মীরেই ঘর বেঁধেছিলেন। যিশু তাদের ভালবাসা, শান্তি, সৌহার্দের বার্তা দেন।
যিশুর কাশ্মীরে আসার ইঙ্গিত ওল্ড টেস্টামেন্টেও দেওয়া আছে বলে দাবি করা হয়। কাশ্মীরের নদী ঝেলমকে পার্সিরা বলেন বেথ। ওল্ড টেস্টামেন্টে বেথপিওর নামের যে জায়গার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা সম্ভবত ঝেলম বা বেথ নদীর পাড়ের কোনও এক জায়গা।

এবার আসি হিন্দু শাস্ত্রের কথায়। ভবিষ্য মহাপুরাণ। একশো পনেরো খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংস্কৃত ভাষার এই প্রাচীন গ্রন্থের রচয়িতা বেদব্যাস।। তাতে আটাত্তর খ্রিস্টপূর্বের এক রাজার গল্প আছে। নাম রাজা শালিবাহন। তিনি একবার হুনা প্রদেশের হিমাতুঙ্গায় যান। জায়গাটা মানসরোবরের কাছাকাছি। সেখানে আচমকাই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এক সৌম্যকান্তি পুরুষের। স্বর্নবর্ণ শরীর। ধবধবে সাদা পোশাক পরা।
- 'আপনি কে?' জানতে চান রাজা।
- 'আমাকে ইশাপুত্র নামে ডাকতে পারেন,' বলেন সেই আগন্তুক। 'কুমারী মায়ের গর্ভে আমার জন্ম। আমি অবিরত সন্ধান করে চলেছি সত্যের।'
রাজা সেই সুদর্শন মানুষটি কোন ধর্মে বিশ্বাসী জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, যেখানে সত্যের হত্যা হয়, সেখানেই তাঁর আবির্ভাব। তিনি অপরাধীদের কষ্টের কারণ হন। আবার তিনি নিজেও রেহাই পান না। তিনি  নিজেও যন্ত্রণা ভোগ করেন অপরাধীদের হাতে।
তাঁর ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আগন্তুক বলেন, 'যে হৃদয় নির্মল, অপাপবিদ্ধ তাতেই আমার বিশ্বাস। আমার বিশ্বাস প্রেমে, হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা ভালবাসায়।'
সবশেষে তিনি বলেন, 'মানুষ আমায় ইশা- মসিহা বলে চেনে।'

তবে বাস্তবেই রোজাবালের সমাধিতে যিশু সমাধিস্থ আছেন কিনা, তা নিয়ে বারেবারে প্রশ্ন উঠেছে। আধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় বৈকি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস মানেই রক্ষণশীলতা। গোটাটাই আবেগ। সেখানে যুক্তিতর্কের খবরদারি চলে না। যুক্তিতর্কের কষ্টিপাথরে মানুষের আবেগ বিচার করতে গেলে মুশকিল। শেষ পর্যন্ত অবস্থা দাঁড়াবে, হাতে রইলো পেনসিল।
ঈশ্বরপুত্রের অন্তিম শয়ান কাশ্মীর উপত্যকায়। থাকুন না আহমেদিয়ারা মনের মধ্যে এই সুন্দর স্বপ্ন সাজিয়ে। জেরুজালেম না কাশ্মীর, থাকুক এই তর্কবিতর্ক। অশান্তি করে শান্তির দূতের ঘুম ভাঙানোর দরকারটা কী? জম্মুর চার্চ কিন্তু এব্যাপারে সহিষ্ণু।
বরং, একবার স্বচক্ষেই দেখে আসুন না শ্রীনগরের রোজাবাল। হতেও তো পারে, মানুষের আবেগে জেরুজালেম, কাশ্মীর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours