politics
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ষড়যন্ত্রের ছক কষা হয়েছিল আগেই। তৎকালীন জম্মু কাশ্মীর সরকারের সঙ্গে শলা পরামর্শ করেই ব্যূহ সাজিয়েছিলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু। 2004 সালে কথাপ্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি। লক্ষ্য, জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার ঘোর বিরোধী প্রয়াত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ফাঁদে ফেলা।

প্রথমে মনে করা হয়েছিল, জম্মু কাশ্মীরে ঢোকার সুযোগই পাবেন না শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তার আগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করবে পঞ্জাব সরকার। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনক ভাবেই, সেসব কিছু হলো না। পরে জানতে পারা যায়, সবটাই ছিল সুপরিকল্পিত। আসলে দক্ষ শিকারির মতো সেদিন ফাঁদে ফেলা হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদকে। জম্মু কাশ্মীরে শ্যামাপ্রসাদকে ঢুকতে বাধা দিলে, মানুষের মনে হাজারো প্রশ্ন উঠবে। তাই শ্যামাপ্রসাদকে বিনা বাধায় কাশ্মীরে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বেরোতে দেওয়া হয়নি। শ্যামাপ্রসাদকে ওই সফরে, তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছিলেন যুবক বাজপেয়ি। সেদিন বাজপেয়ির ভূমিকা ছিল সাংবাদিকের।
ফুল প্রুফ প্ল্যান আগে থেকেই করা ছিল নেহরু, শেখ আবদুল্লার। ছকমাফিক কাশ্মীরে পা রাখতেই, গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। 

সোমবার যখন কাশ্মীরের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লার নাতি ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি জম্মু কাশ্মীর পুলিশের হাতেই গ্রেপ্তার হলেন, তখন কি অলক্ষ্য থেকে হেসেছিলেন প্রয়াত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়? নাকি, এও এক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!

11মে, 1953 সাল। বাস্তবে 'মিশন কাশ্মীর' শুরু হয়েছিল সেদিনই। ভারতীয় জনসঙ্ঘ দলের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখনকার সরকারি  নিয়মের তোয়াক্কা না করে, বিনা পার্মিটেই ঢুকে পড়েছিলেন কাশ্মীর উপত্যকায়। সঙ্গে ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। যা হওয়ার তাই হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই শ্যামাপ্রসাদ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পুলিশের হাতে। প্রথমে শ্রীনগরের সেন্ট্রাল জেলে। পরে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শহরের বাইরে এক কটেজে। 
গোটা ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছিল এক নির্মম ষড়যন্ত্র। 2004 সালে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি। নেহরু জম্মু কাশ্মীর সরকারকে নিয়ে সেদিন এক ব্যূহ রচনা করেছিলেন। যে ব্যূহর মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ অনায়াসে ঢুকতে পারবেন, কিন্তু বেরোতে পারবেন না। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক নেহরু। আশঙ্কা করেছিলেন, ঢোকার সময় শ্যামাপ্রসাদকে বাধা দিলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও জম্মু কাশ্মীর নিয়ে হাজার প্রশ্ন উঠতে পারতো। তাই তিনি সযত্নে সে রাস্তা এড়িয়ে গেছিলেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন শ্যামাপ্রসাদ। শরীরে যন্ত্রণা তার সঙ্গে ধূমজ্বর। তারিখটা  ছিল 19-20 জুন। চিকিৎসক আলি মহম্মদ সন্দেহ করলেন প্লুরেসি। তিনি ঠিক করলেন স্ট্রেপ্টোমায়সিন ইঞ্জেকশন আর পাউডার  দেবেন। শ্যামাপ্রসাদ তাঁকে নিষেধ করলেন। জানালেন, এর আগেও তিনি দুবার ওই রোগে ভুগেছেন। সে সময় তাঁর বাড়ির চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, ওই ওষুধ তাঁর সহ্য হয়  না। শ্যামাপ্রসাদের কথায় পাত্তাই দিলেন না ডক্টর আলি। ওই ওষুধেই তাঁর চিকিৎসক করলেন। স্বাভাবিকভাবেই, হলো হিতে বিপরীত। 22 জুন। বুকে অসহ্য ব্যথার কথা জানালেন শ্যামাপ্রসাদ। অবস্থার মারাত্মকরকম অবনতি হওয়ায়, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পরদিনই মারা গেলেন শ্যামাপ্রসাদ। 

গোটা ঘটনায় চিকিৎসার কোনও গাফিলতি দেখতে পেলেন না কেউ। সরকারি ভাবে বলা হয়েছিল, মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু কংগ্রেস বিরোধীরা সেকথা মানতে রাজি হননি। তাঁরা সরাসরি আঙুল তুলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল  নেহরুর দিকে। এমনকি মৃত শ্যামাপ্রসাদের মা যোগমায়া দেবী সরাসরি নেহরুকেও অনুরোধ জানান ঘটনার  তদন্ত করতে। সে কথা উপেক্ষা করে নেহরু জানিয়ে দেন, তদন্ত করার মতো কারণ নেই। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পেছনে সন্দেহজনক কোনও কারণ দেখা যায়নি। আর পাবেনই বা কী করে? জেগে ঘুমালে, সে ঘুম ভাঙানো দায়।

কিন্তু এর বেশ কিছুদিন পরের এক ঘটনায় সবাই নড়েচড়ে বসেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁর শুশ্রূষার দায়িত্বে ছিলেন রাজদুলারি টিংকু নামের এক নার্স। তিনি জানান, হাসপাতালে প্রচন্ড অসুস্থতায় ভেঙে পড়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। রাজদুলারি তখন জগন্নাথ জুতসই নামের এক ডাক্তারকে ডাকেন। রোগীর অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান ডাক্তার। এরপর তিনি ডাক্তার আলিকে ডাকেন। কিন্তু  ততক্ষণে সবকিছু  হাতের বাইরে চলে গেছে। অনেকে আবার বলেন, সিরিঞ্জে স্ট্রেপ্টোমায়সিন ভরে ডাক্তার আলি রাজদুলারিকেই বলেছিলেন ইঞ্জেকশন দিতে।
23 জুন, 1953। তখন রাত ভোরের দিকে গড়াচ্ছে। ঘড়িতে তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিট। মারা গেলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বয়স তখন মাত্র বাহান্ন। পরদিন দুপুর বারোটা পঞ্চাশ নাগাদ ওই খবর প্রচার করে আকাশবাণী। 

ওই ঘটনার একান্ন বছর পরেও বাজপেয়ি বলেন, শ্যামাপ্রসাদকে খুন করার মূল ছক সাজিয়েছিলেন খোদ নেহরু।

কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুতে নেহরুর ভূমিকায় এত বিতর্ক তৈরি হয়েছিল কেন? শ্যামাপ্রসাদ নিজেই তো নেহরু মন্ত্রিসভার ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সাপ্লাই দপ্তরের মন্ত্রী  ছিলেন। এমনিতেও নানা ব্যাপার নিয়ে নেহরুর সঙ্গে মতে মিলত না শ্যামাপ্রসাদের। ছিল রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ফারাকও। তবে নেহরুর  সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের সম্পর্ক পুরোপুরি বিগড়ে যায় তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে, 'দিল্লি প্যাক্ট' করার পরেই। ওই প্যাকেটের কড়া বিরোধ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। 1950 সালের 8 এপ্রিল। নেহরু মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

চুপ করে বসে থাকার মানুষ ছিলেন না শ্যামাপ্রসাদ। দিল্লিতে বসেই তৈরি করে ফেললেন নিজের দল, ভারতীয় জনসঙ্ঘ। তারিখটা ছিল 21 অক্টোবর, 1951 । পরের বছরেই লোকসভা নির্বাচনে পেলেন তিনটি আসন। কিন্তু কিছু করতে গেলে দলভারী করা ছাড়া গতি নেই। চললো সংসদের সতীর্থদের বোঝানোর কাজ। সঙ্গে পেয়ে গেলেন লোকসভার বত্রিশজন, রাজ্যসভার দশজন সদস্যকে। তৈরি হলো ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি। কিন্তু ওই পার্টিকে বিরোধীপক্ষের মর্যাদা দিলেন না স্পিকার। চললো লড়াই সংসদের ভেতরে, বাইরেও। কপালের ভাঁজ গভীর হলো নেহরুর। বুঝতে পারলেন, সময় থাকতে থাকতেই এঁকে রোখা দরকার। নইলে অনর্থ ঘটতে কতক্ষণ!

ওদিকে আরএসএস- এর অনুপ্রেরণায় তৈরি জম্মু প্রজা পরিষদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে, জম্মু কাশ্মীরের 'বিশেষ মর্যাদা'র প্রতিবাদে আরও এক লড়াই জোরদার করলো জনসঙ্ঘ। ওই লড়াইয়ের অঙ্গ হিসেবেই জম্মু কাশ্মীর সরকারের বিশেষ অনুমতি ছাড়াই, কাশ্মীরে ঢোকার পরিকল্পনা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। ঢুকেছিলেন, বেরোতে পারেননি। গ্রেপ্তার হওয়ার পর চুয়াল্লিশ দিনের মাথায় মারা গেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। 

মৃত শ্যামাপ্রসাদের ওপরেও ঠিক কতটা অসৌজন্য দেখিয়েছিলেন শেখ আবদুল্লা? শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে যখন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃতদেহ বিমানে তোলা হয়, বিমানভাড়ার সাত হাজার পাঁচশো আটচল্লিশ টাকা দিতে সাফ অস্বীকার করে।

5 অগাস্ট, 2019। স্বপ্নপূরণ হলো জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতার। জম্মু কাশ্মীরের সেই 'বিশেষ মর্যাদা' ফিরিয়ে নিলেন অমিত শাহ। এবার থেকে কাশ্মীরের শুধু একটাই বিশেষ মর্যাদা- ভারতের ভূস্বর্গ।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours