প্রতিম বসু, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
১৯৭১
সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার
পরে সরকারের সিদ্ধান্ত ঘিরে এমন জনসমর্থনের ঢেউ ভারত আর কোনদিন দেখেনি।
বালাকোটে বিমান হানা এর কাছে নস্যি।
অগস্টের পাঁচ
তারিখে নরেন্দ্র মোদী সরকার সংসদের রাজ্যসভায় কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা রদ করে,
ভারতীয় সংবিধানকে মান্যতা দেবার প্রস্তাব পেশ করে। সঙ্গেই আসে
জম্মু-কাশ্মির থেকে লাদাখকে আলাদা করা ও দুই অঞ্চলকেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল
হিসেবে ঘোষণা করার বিল।
জম্মু তে বিজেপি-পিডিপি
সরকার পড়ে যাওয়ার পর থেকে বিধানসভা অচল। সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে।
রাষ্ট্রপতির হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালাচ্ছেন রাজ্যপাল। তিনি প্রস্তাব
দিয়েছিলেন কাশ্মিরে সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে, ভারতীয় সংবিধান চালু করার
জন্যে। রাষ্ট্রপতি সেই প্রস্তাবে সই করে সংসদের অনুমতির জন্যে পাঠান। সরকার
সে প্রস্তাব প্রথম পেশ করে রাজ্যসভা বা উপরের কক্ষে, যেখানে বিজেপি
বিরোধীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ভোট শেষ হবার পর দেখা গেল,
প্রস্তাবের পক্ষে ১২৫ জন, বিপক্ষে মাত্র ৬১। বিপক্ষে ছিল কংগ্রেস (৪৬), বাম
(৬), লালু যাদবের আরজেডি (৫), কাশ্মিরের পিডিপি (২) ইত্যাদি। প্রস্তাবের
বিরোধিতা করে কংগ্রেস নেতা ও কাশ্মিরের পূর্ব মুখ্যমন্ত্রী গরম গরম কথা
বললেন। দিনের অধিবেশন শেষ হবার আগেই জানা গেল, রাজ্যসভায় কংগ্রেসের
মুখ্যসচেতক ভুবনেশ্বর কলিতা পদত্যাগ করেছেন।
আর
তারপর থেকে কংগ্রেস ঘরের বিক্ষোভ সামলাতেই ব্যাস্ত। জ্যোতিরাদিত্য
সিন্ধিয়া, মিলিন্দ দেওরা, জনার্দন দ্বিবেদী, অনিল শাস্ত্রী, দীপেন্দ্র
হুডার মত গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ কংগ্রেসের তাবড় তাবড় নেতারা, জনসমক্ষে,
দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে মোদী সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন।
একই
অবস্থা অন্যান্য বিরোধীদের। তৃনমূল কংগ্রেস অনেক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে
বক্তব্য পেশ করেও ভোট দেয় নি। মমতা এখন ইনিয়ে বিনিয়ে বলছেন উনি কাশ্মিরে
৩৭০ ধারা তুলে দেবার বিপক্ষে নন। সিপিএম তো কবেই পায়ে কুড়ুল মেরেছিল। এবার
কুড়ুলে লাথি মেরে মোটামুটি নিজের কবরে নিজেই ফুলমালা দিয়ে বসে আছে।
রাজ্যসভার
পর প্রস্তাব গতকাল লোকসভায় পাস হয়েছে। কাশ্মির এখন ভারতের অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গ। ৩৭০ ধারার সুযোগ নিয়ে তার আলাদা সংবিধান, জাতীয় পতাকা নেই। কাশ্মির
আর দেশের মধ্যে আরেকটা দেশ নয়।
কাশ্মিরের মানুষ
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের থেকে বেশি সরকারি অনুদান পেতেন। তা তো বহাল আছেই
সম্ভবত আরও বাড়বে কারন সরকার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে কোমর বেঁধে লেগেছেন,
অক্টোবরে শিল্প সম্মেলনও হচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতি, বিধানসভা সব থাকবে।
নির্বাচিত সরকার ইচ্ছে করলে মমতা ব্যানারজির মত সকাল বিকেল কেন্দ্রের
সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু যাই করুন না কেন উঠতে বসতে পাকিস্তানের জুজু
দেখানো রাজনীতি চলবে না। সেকারনেই ৩৭০ ধারা রদ হল।
এবং,
সবথেকে আশ্চর্য যে এতকিছু হওয়া সত্বেও ভারতে কোথাও একটা ঢিল পড়ার ঘটনাও
শোনা যাচ্ছে না। কাশ্মিরের অবস্থা কোনদিনই স্বাভাবিক ছিল না, এখনও না। গত
সাত দশকে কাশ্মির নিয়ে ভারতের অনেক নাক কাটা গেছে। আর কোন হিংসার ঘটনা যাতে
না হয় সে কারনে সরকার আগেই সেনা মোতায়েন করেছে। নেতাদের বাড়িতে বা গেস্ট
হাউসে আটকে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক কারনেই ফোন ও ইন্টারনেট বন্ধ।
জম্মু-কাশ্মিরের
পূর্ব মুখমন্ত্রি ফারুক আবদুল্লা গণতন্ত্র ভুলুন্ঠিত হল বলে কাগজ, টিভিতে
বক্তব্য রাখছেন। যদি হয়ে থাকে, তাহলে তার দায় ওনাদেরও নিতে হবে বৈকি। ১৯৪৮
সালে পাকিস্তানি হানা থেকে বাঁচতে কাশ্মিরের রাজা ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত
নেন। ভারতভুক্তির নিয়ম হিসেবে সব করদ রাজ্যের নিজস্ব নিয়ম কানুনের কিছু
স্বাধীনতা ছিল। সে জন্যে আজও মহারাষ্ট্র ও গুজারাটের মত কিছু রাজ্যে
সংবিধানের ৩৭১ ধারার মাধ্যমে ছোটখাট কিছু আলাদা নিয়ম বলবত আছে। পরবর্তীতে
৩৭১ ধারায় ‘এ’ থেকে ‘জে’ পর্যন্ত সংশোধিত অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নাগাল্যান্ড,
আসাম, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, করনাতক, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল
ইত্যাদি রাজ্যে নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়। সিকিমের ভারতভুক্তিও ৩৭১ ধারার
সংশোধনীর মাধ্যমে হয়।
কাশ্মিরে তখন বিধানসভা ও
সংবিধান ছিল। ঠিক হয় অন্তর্বর্তীকালীন বিধানসভা (কন্সটিট্যুয়েন্ট
অ্যাসেম্বলী) সবদিক খতিয়ে দেখে নতুন (ভারতীয়) সংবিধান বলবৎ করার জন্যে
ভারতের রাষ্ট্রপতিকে সুপারিশ জানাবে। এই মর্মে ভারত সরকার সংবিধানে ৩৭০
ধারা আনে যাতে কাশ্মিরে নতুন সংবিধান জারি হবার প্রক্রিয়া চলাকালীন দিল্লি,
প্রতিরক্ষা ও বিদেশনীতির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে মন দিতে পারে।
ভারতভুক্তি সম্পন্ন হলে স্বাভাবিক নিয়মে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ
ভারতের সংবিধানে কাশ্মিরের জন্যে বিশেষ কিছু ছাড় থাকবে। কিন্তু কাশ্মিরের
আলাদা সংবিধান থাকবে না।
ওপরের আলোচনাতেই পরিষ্কার
যে ভারত সরকার কাশ্মিরের ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে যথেষ্ট নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি
নিয়েছিলেন। গণ্ডগোল হল ভারতভুক্তিতে শেখ আবদুল্লার সায় ছিল না। এদিকে ৩৭০
ধারায় পরিষ্কার করে বলা ছিল না, যে সুপারিশ নতুন সংবিধানের সুপারিশ না করলে
কি হবে। আবদুল্লা এই সুযোগটাই নেন। তার নেতৃত্বে চলা কাশ্মিরের
কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলী নতুন সংবিধান চালু করার সুপারিশ নিয়ে গড়িমসি
করতে থাকে। এ নিয়ে তখন জহরলাল নেহরু সরকারের সঙ্গে যথেষ্ট বিবাদ হয়।
শেষমেশ
কোন সুপারিশ ছাড়াই কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলীর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে
কাশ্মির ভারতের ভেতর আলাদা দেশ হয়ে থেকে গেল। সরকার চলত ভারতের জনগনের
ট্যাক্সের টাকায়, কিন্তু ভারত সরকারের খরচ নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার নেই।
খতিয়ে
দেখলে সেনা ছাড়া আর কিছু নিয়েই ভারতের কিছু করার অধিকার ছিল না। আর তার
পুরো ফায়দা তুলেছে কাশ্মিরের নেতা, মন্ত্রী, অফিসারেরা – ভারত জুড়ে তাদের
সম্পত্তির বহর দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। এই রাজনীতির স্বার্থেই কাশ্মিরের এক
পা পাকিস্তানে। একদিকে দিল্লির টাকা নয়ছয় হয়েছে। অন্যদিকে লোককে দিল্লির
বিরুদ্ধেই ক্ষেপানো হয়েছে।
নিজের চোখে যা দেখেছি,
তাতে মনে হয় না, সমস্ত সাধারন কাশ্মীরি মুসলমান এই রাজনীতির সমর্থক ছিলেন।
মোটে পাঁচটা জেলাতেই প্রায় সব গণ্ডগোল হত। কান পাতলে শোনা যেত হুরিয়তের
বিরুদ্ধে অভিযোগ যথেষ্ট। কিন্তু সব জায়গার মতই এখানেও বেশিরভাগ লোক চলতি
ধারাকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন। তার ওপর কাশ্মিরকে ঘিরে ধর্মীয়
রাজনীতি তো আছেই। ভারতভুক্তি তো আরও অনেক হয়েছে। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি
অনুরাগও তো নতুন নয়। উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে রাজনীতি তাদের ভাষা ও
সংস্কৃতি ঘিরেই চলে। অন্য ধর্মের মানুষ সংখ্যায় বেশি। তবুও উত্তরপূর্বে
শান্তি এসেছে, কাশ্মিরে আসে নি। এর পেছনে ধর্মীয় রাজনীতির কি কোন ভুমিকা
নেই?
কিন্তু এসব সত্বেও বরফে ঢাকা গুরেজ ভ্যালি
কিংবা লাদাখ গেলেই বোঝা যাবে, সবাই এই রাজনীতিতে খুশি ছিলেন না। ২০১৯ সালে
লোকসভা নির্বাচনের আগে, লাদাখে সব দল ও ধর্মের (বৌদ্ধ ও মুসলমান) নেতারা
একযোগে কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানায় উন্নয়নের স্বার্থে লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত
অঞ্চল করা হোক। কারন টাকা এখন সব কাশ্মিরেই পকেটে পকেটে ঢুকে যায়। একথা
জানাজানি হবার পর কাশ্মীরি দলগুলো লাদাখের নেতাদের নির্বাসনে পাঠায়।
মোদী
সরকার এখানেই ঘা দিয়েছে। শেখ আবদুল্লার দেখানো পথেই, ৩৭০ ধারার অনুচ্ছেদ
ব্যবহার করে রাজ্যপাল ভারতের সংবিধান জারি করার সুপারিশ করেছেন আর তাতে
সারা দেশ খুশি। সত্তর বছর ধরে, নির্বাচনে ঘুরে ফিরে আসা একটা ইস্যু দুদিনে
শেষ।
একথা ঠিক যে গোটা ব্যাপারটা সবার সঙ্গে আলোচনা
করে করলে আরও ভালো হত। কিন্তু বাস্তবে তার রাস্তা ছিল কী? একবার বললেই ঢিল
ছুড়িয়েরা রাস্তায় নেমে পড়ত, যাতে সেনা গুলি চালায়। আর মৃত্যু হলেই নিন্দার
ঢলে আর কিছু করা যেত না। সে জন্যেই কোন সরকারই ৩৭০ ধারা রদ করার সাহস পায়
নি। যদিও কোন সরকারই এটাকে মানতেও পারে নি। নেহেরু ও শেখ আবদুল্লার বিবাদ
এবং আবদুল্লার জেল বাসের কথা তো সবার জানা।
কেউ
প্রশ্ন করতে পারেন ৩৭০ ধারা রদ ও লাদাখকে আলাদা করার সঙ্গে কাশ্মির কে
রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হল কেন? কথা সঙ্গত। কারন এরকম ঘটনা
ভারতে প্রথম। মুশকিল হল, কাশ্মিরও তো আর পাঁচটা জায়গার মত না। কাশ্মিরের
অর্থনীতি মানে শুধুই পর্যটন। তাহলে ট্যুরিস্ট সিজনে হুরিয়ত বনধ ডাকে কেন?
এতদিন
ধরে পুলিশ, আমলা শুধু কাশ্মিরের রাজনীতিবিদদের কথা শুনত। সামনেই কাশ্মির
বিধানসভার ভোট সেখানে তো এই দলগুলোই লড়বে। রাজ্য হলে দুপক্ষ এক হবার সুযোগ
থেকেই যায়। আর সেটা হলে হলে, শান্তি আর উন্নয়ন দুটোই কাশ্মির থেকে দূরে
থাকত, পাকিস্তানের সুবিধে হত। খেয়াল করতে হবে শান্তি এলে কাশ্মিরের
জুজুপন্থী রাজনীতি হেরে যাবে, আর অনেকের স্বার্থে ঘা পড়বে। কেন্দ্রশাসিত
হলে রাজনীতির হাতে একটাই রাস্তা উন্নয়ন করা পুলিশ থাকবে কেন্দ্রের হাতে।
গোটা
ঘটনাটা শুধু কাশ্মিরের নেতাদের ওপর বোমের মত ফাটে নি। পাকিস্তান দিশাহারা
হয়ে উল্টোপাল্টা বলছে। চিন চমকে গেছে, গতকাল গ্লোবাল টাইমস লিখেছে। কিন্তু
কোন বড় দেশ “অভ্যান্তরিন বিষয়”-এ নাক গলায় নি। গলালে বালুচিস্তান থেকে
শিয়েনজাং (উইঘুর) বহু জায়গার নামই উঠে আসবে। এতেই স্পষ্ট সরকারের চাল কতটা
সঠিক। দেশ আর বিদেশ কোনদিকেই সমস্যা নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যার কোন
শেষ নেই তাই ও নিয়ে কথা বলারও মানে নেই।
কাশ্মিরে
গণ্ডগোল একদিনে কমবে না বা শেষও হবে না। যারা আজ হতচকিত তারা কাল আঘাত
হানবে। পাকিস্তান সেনা তো বলেছে সর্বতো ভাবে তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু
আমার বিশ্বাস গণ্ডগোল কমার প্রক্রিয়াও এবারেই শুরু হবে। ৩৭০ ধারা সঙ্গে
নিয়ে, সত্তর বছর ধরে তো শুধু অশান্তিই হল।
তবে এবার
কেন্দ্রের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। আগের মত শুধু বুরহান ওয়ানিদের মারলে কাজ
শেষ হবে না। সজাগ থাকতে হবে যেন যে কোন মুল্যে কাশ্মিরের নিরীহ মানুষের
রক্তপাত আটকানো যায়। কাশ্মিরের রাজনীতির মোড় ঘোরাতে চাইলে, দুরের দিকে
দৃষ্টি রেখে আপাতভাবে শক্ত হতেই হবে।
(সূত্র: প্রতিমবেঙ্গলি.ব্লগস্পট.কম)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours