fiture
স্বরূপ গুপ্ত, লেখক, কোচবিহার: 


"You Prime Minister. Thank you very much. I was waiting to see this day in my lifetime."

সন্ধ্যে ৭টা ২৩ মিনিটে টুইটারে প্রধানমন্ত্রীকে এই শেষতম ধন্যবাদটুকু দিয়ে দিব্যি না ফেরার দেশে চলে গেলেন ভারতের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। যে ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিলেন, তার ফল কী হবে তা এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। কিন্তু নিশ্চিত করে একটা কথা বলা যায় যে, মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোথাও না কোথাও সুষমা স্বরাজের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। কেননা মোদি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে বিদেশমন্ত্রী হিসেবে সুষমা স্বরাজের কার্যক্রম নিঃসন্দেহে ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অন্য জায়গা দিয়েছে।  

অবশ্য মনে রাখবার মতো কাজ তিনি আগেও করেছেন। দ্বাদশ লোকসভায় বাজপেয়ী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হিসেবে 'ফিল্ম প্রোডাকশন`কে 'ইন্ডাস্ট্রি`র মর্যাদা দিয়ে ব্যাঙ্ক ঋণের যোগ্য করে তোলার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ কেউ ভোলে নি। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী হিসেবে ভূপাল, ভুবনেশ্বর, যোধপুর, পাটনা, রায়পুর ও ঋষিকেশে AIIMS গড়ে তোলার কৃতিত্ব তাঁরই। পঞ্চদশ লোকসভায় বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্য শুনতে সরকার পক্ষের সাংসদরাও অপেক্ষা করতেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার এতটাই ঋদ্ধ ছিল যে, প্রথম মোদি সরকারের বিদেশ মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে নিয়ে আপত্তি তুলবার কোনো প্রশ্নই ছিল না। পাঁচ বছর ধরে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজের মন্ত্রক সামলেছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীর পর দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে এই মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা সুষমা স্বরাজ তাঁর কার্যক্রম নিয়ে বিরোধীদেরকে সেভাবে প্রশ্ন তুলবার সুযোগ তিনি দেন নি, যদিও ললিত মোদির ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁর নোট নিয়ে বিরোধীরা তাঁকে আক্রমণ করেছিল। 

১৯৫২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি বর্তমান হরিয়ানার আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে সুষমা স্বরাজ জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তিনি সংস্কৃত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনের স্নাতক হয়েছিলেন। তাঁর বাবা হরদেব শর্মা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে তাঁদের বাড়িতে জনসেবার ধারা চালু ছিল। তাই ১৯৭৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে জীবন শুরু করলেও অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সক্রিয় সদস্য সুষমা স্বরাজ ১৯৭৫ থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। জর্জ ফার্নান্ডেজ, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে একসময় তাঁকে দেখা গেলেও জরুরি অবস্থার পর তিনি ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে জিতে দেবীলাল মন্ত্রীসভাতে ভারতের কোনো রাজ্যের সবচেয়ে কমবয়সি মন্ত্রী  হিসেবে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদ পান। এর পর তাঁকে আর কোনোদিন পেছনে ফায়ার তাকাতে হয় নি। মোদি সরকারের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠনের আগে পর্যন্ত বিজেপির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দিল্লি সামলেছেন। প্রথম মহিলা সাধারণ সম্পাদক, প্রথম মহিলা মুখপাত্র, প্রথম মহিলা বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে কখনও আবার দল সামলেছেন। প্রথম ও একমাত্র মহিলা হিসেবে পেয়েছেন Outstanding Parliamentarian Award, হাৰিয়ানার হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের সভানেত্রী হিসেবেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্পেন সরকার নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভারতের  সাহায্যের কথা মনে রেখে তাঁকে দিয়েছেন Grand Cross of Order of Civil Merit সম্মান। 

হরিয়ানা বিধানসভার দুইবারের সদস্য ও দুইবারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী, রাজ্যসভা ও লোকসভার সদস্য ও বিভিন্ন সময়ে মোট পাঁচবার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী সুষমা স্বরাজ সুপ্রিম কোর্টে তাঁর একদা সহকর্মী স্বরাজ কৌশলকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। তাঁদের একমাত্র কন্যাসন্তানটিও আইনজীবী। স্বরাজ কৌশল নিজেও মিজোরামের রাজ্যপাল হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি পার্লামেন্টের সদস্যও হন। সুষমা স্বরাজের শরীর খারাপ হতে শুরু করে ২০১৪-১৫ থেকেই। ২০১৬ সালে তাঁর একটি কিডনি প্রতিস্থাপিতও হয়। কিন্তু কিডনির রোগে নয়, গতকাল সন্ধ্যায় তিনি হার্ট এটাকে তিনি চলে গেলেন। আর তাঁর সঙ্গে চলে গেল, ভারতের সংসদীয় ইতিহাসের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। 
সুষমা স্বরাজকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বোধহয় ভুল করা হবে। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন তিনি। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, হাঁটাচলা, কথা বলা, আচরণ সমস্ত কিছুর মধ্যে এক অসম্ভব আভিজাত্য ফুটে উঠতে। কিন্তু মজা হলো এটাই যে, সেই আভিজাত্যকে সরিয়ে আর একটি ব্যাপার যা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত তা ছিল তাঁর মাতৃরূপ। তাই হয়তো সাধারণ দেশবাসী অনেক সময়েই তাঁকে টুইট করেছে আপন ভেবে। সবচেয়ে বড় কথা যে, তিনি তার জবাব দিয়েছেন, দরকারে সাহায্য করেছেন আবার অন্যায় আবদারে টুইটকর্তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। ক্ষমতার মসনদে থেকেও তিনি ছিলেন সাধারণের কাছাকাছি। আর সেজন্যই বোধহয় তাঁর জনপ্রিয়তায় কখনোই ভাঁটা পড়েনি। পাশাপাশি তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার নানা প্রমাণ আমরা বিভিন্নভাবে অনেকবার পেয়েছি। বিদেশমন্ত্রী হিসেবে তাঁর গৃহীত নীতি ও বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎকার এতটা কার্যকরী হবে সেটা বোধহয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও কল্পনা করেন নি। কিন্তু সেসব বাস্তবায়িত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়েছে তা সে সার্জিকাল স্ট্রাইক হ`ক কিংবা অন্য দেশ থেকে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রেই হক। একথা কখনোই অস্বীকার করা যায় না যে, ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অনেকটা জুড়ে থাকে পাকিস্তান। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মঞ্চেই হ`ক কিংবা কোনো শীর্ষ বৈঠকেই হ`ক, ভারত যদি বলিষ্ঠভাবে তার বক্তব্য রাখতে না পারে তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতকেই অসুবিধায় পড়তে হবে। সুষমা স্বরাজের বাগ্মিতা, যুক্তির প্রয়োগবাণ এবং সর্বোপরি দৃঢ় উচ্চারণ বারবার প্রমাণ করেছে যে একজন স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে একজন মানুষকে বুঝতে হলে তার দৈহিক উচ্চতা বা ওজনে নয়, মাপতে হবে তাঁর কথার ও কাজের ওজন ও ভার। সুষমা স্বরাজ এমনই একজন ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজের ধার ও ভার বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে, নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসনে পাওয়ার প্রচেষ্টায় ভারত যে সম্ভ্রম আদায় করতে পেরেছে তাতে ছোটোখাটো চেহারার এই মহিলার বিরাট ছায়া কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই দেখা যাবে। 

যে কোনো মৃত্যুই বেদনার। বিশেষ করে সুষমা স্বরাজের মতো ব্যক্তিত্বের মৃত্যু খুব স্বাভাবিকভাবেই সকলকে মর্মাহত করে তুলেছে। রাজনীতি থেকে সদ্যই দূরে সরে এসেছিলেন। দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে যে রাজনীতি তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল সেখান থেকে সরে নিজের মতো বাকি জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। পরিবারকে আরও সময় দিতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁর জীবনসঙ্গী স্বরাজ কৌশল ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে, পরিবারের প্রতি একইরকমভাবে কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন তাঁর সদ্য প্রয়াত পত্নী। হয়তো সেই কর্তব্যনিষ্ঠা আরও একটু বাড়ত। কিন্তু এসব কথা এখন অনুমান মাত্র। ভারতের সংসদীয় রাজনীতির একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিনে তাঁর এই প্রয়াণ মানতে কষ্ট হলেও স্বান্ত্বনা একটাই যে, শেষ টুইটে তিনি বলে গেছেন তাঁর জীবনের অন্যতম চাওয়া, যার জন্য আজীবন তিনি অপেক্ষা করেছেন, তা সফল হয়েছে। 

সারাজীবন কর্তব্যে অবিচল, মাতৃকল্পের প্রতিমূর্তি, বিদুষী সুষমা স্বরাজ তাঁর জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেলেন যে, মানুষের জীবনে কর্তব্য আসল, ফল নয়। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours