শৌভিক রায়, লেখক, কোচবিহার:
'জল-জংলার দেশ, দেখবার আছে কী?'
অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্তের এই লাইনটি উত্তরবঙ্গের, বিশেষ করে ডুয়ার্সের, ক্ষেত্রেও যেন
প্রযোজ্য ছিল! যদিও 'উদ্বাস্তু` কবিতায় কবি কিন্তু ওপার বাংলাকেই
বুঝিয়েছিলেন।
কিন্তু আসলে কি সত্যিই তাই? না। এরকম
ভাবা ভীষণ ভুল হবে। উত্তরবঙ্গে দেখবার এতো কিছু আছে যে, এক জন্মে তা বোধহয়
দেখা শেষ হবে না। তবে সে দেখা দেখতে গেলে অবশ্যই থাকতে হবে এমন একটা চোখ
যা ঘরের পাশের শিশিরবিন্দু দেখেও যেমন মুগ্ধ হবে, তেমনি বহু ব্যয় করে বহু
দূরের জায়গা দেখেও উদ্বেলিত হবে।
একথা
ঠিক যে, অসামান্য প্রাকৃতিক পরিবেশ উত্তরবঙ্গের মূল আকর্ষণ। উত্তরে
উত্তুঙ্গ হিমালয়, কাঞ্চনজঙ্ঘার ধবল সৌন্দর্য, সবুজ অরণ্যের মোহময়ী হাতছানি,
হিংস্র প্রাণীদের ছমছমে সাক্ষাৎ, দিগন্তবিস্তৃত গালিচা সদৃশ চা-বাগিচা,
বেগবতী নদী আর সহজ-সরল জীবনযাত্রার মানুষজন...উত্তরবঙ্গকে ভাল না বেসে থাকা
যাবেই না! কিন্তু মানুষের সৃষ্টি কি কিছুই নেই? সবটাই কি প্রকৃতিনির্ভর?
আছে।
আর যা আছে তা অবশ্যই বিস্ময়। কোচবিহার রাজপ্রাসাদের কথাই ধরা যাক। যারা
দেখেছেন তারা জানেন বিশালত্ব, বৈভব ও সৌন্দর্যের এক অসামান্য মিশ্রণ এই
রাজপ্রাসাদ। গোসানিমারির ইতিহাস তো আজও অনেকাংশেই অজানা। দার্জিলিঙে
হেরিটেজ মর্যাদা পাওয়া টয়ট্রেনও তো মনুষ্যসৃষ্ট। তালিকা দীর্ঘ করা যায়
অনেকটাই। তবে আজ এক অন্য কথা। আজ এক সেতুর কথা।
উত্তরের অজস্র নদীর ওপর সুন্দর সেতুগুলির অন্যতম হল সেভকের করোনেশন ব্রীজ, যা লোকমুখে বাঘপুল নামে পরিচিত।
শিলিগুড়ি
শহর থেকে বাইশ কিমি দূরের সেভকে পৌঁছতে শালুগাড়া ও মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ
স্যাংচুয়ারি পার হতে হয়। পথের দু'ধারের ঝকঝকে সেনাছাউনি আর সবুজের সমারোহ
মুহূর্তেই ভাল লেগে যায়।
সেভক থেকেই শুরু হিমালয়।
পাহাড়ি পথ এঁকেবেঁকে তিস্তাবাজার হয়ে পৌঁছে দেয় কালিম্পং, গ্যাংটক।
তিস্তাবাজার থেকে বাঁ হাতের পথে দার্জিলিং যাওয়া যায়। এই পথে লামাহাটা
আজকের অন্যতম গন্তব্য। আবার তিস্তাবাজারের আগে রাম্ভি থেকে বাঁ হাতে মংপু
ছুঁয়েও পৌঁছানো যায় দার্জিলিঙে।
সেভকের
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নজরকাড়া। সিকিম থেকে দীর্ঘপথ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এসে
সদানীর বা দিস্তা বা ত্রিস্রোতা বা তিস্তা (এই নামকরণের পেছনের ইতিহাস বলা
যাবে আর একদিন) এখানেই সমতলকে স্পর্শ করছে। সেভক থেকে তিস্তার ওপারের মংপং
পর্যন্ত রেলসেতু আর পেছনের পাহাড় নিয়ে প্যানোরামা ছবিশিকারীর কাছে বিশেষ
লোভনীয়।
সেভকের সমতলভূমি থেকে
পাকদন্ডী পথে খানিকটা ওপরে করোনেশন ব্রীজের কাছে জাগ্রত সেভকেশ্বরী
কালীমন্দির পুণ্যার্থীদের বিশেষ গন্তব্য। ঠিক উল্টোদিকে দেবাদিদেবের
মন্দির। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেবদর্শনের সঙ্গে মেলে সেভকের বিস্তৃত ভিউ। কাছেই
কলিঝোড়ার অপার্থিব সৌন্দর্য কোনোদিন ভোলা যায় না।
সেভকে
তিস্তার দু'প্রান্তের সংযোগরক্ষাকারী করোনেশন ব্রীজ স্থাপত্য ও
নান্দনিকতার এক নিদারুণ নিদর্শন। ১৯৩৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও রানি
এলিজাবেথের করোনেশন উপলক্ষে শুরু করা এই ব্রীজটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৪১
সালে। ব্রীজের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন তদানীন্তন বাংলার গভর্ণর জন
অ্যান্ডারসন। ব্রীজের নকশা করেছিলেন দার্জিলিঙের পূর্ত বিভাগের শেষ ব্রিটিশ
এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জন চেম্বারস। আর নির্মাণকাজে ছিলেন মুম্বাইয়ের
মেসার্স জি সি গ্যামন। তিস্তার গভীরতা ও স্রোতের জন্য পিলার তৈরী করা সম্ভব
ছিল না বলে 'আর্চ' শেপ বা আকার দিয়ে রিইনফোর্স কনক্রিটে তৈরী হয়েছিল
ব্রীজটি।
ব্রীজ পার করে
কিমি তিনেক এগোলেই পাহাড়ের পাদদেশে, তিস্তার ধারে মংপং। ময়না, তিতির,
হরিয়ালের ডাকে মুখরিত মংপঙে যে কোনও সময় চলে আসে বন্য পশুরা। মংপংকে পেছনে
ফেলে সামনে এগোলে বাগরাকোট, লিস ও ঘিস নদী পার করে ওদলাবাড়ি হয়ে মালবাজার
অর্থাৎ ডুয়ার্সের খাসতালুক।
শিলিগুড়ি থেকে এলে সেভককে তাই ডুয়ার্সের পাশাপাশি দার্জিলিং-কালিম্পং-গ্যাংটকেরও প্রবেশদ্বার বলা যায়।
হিমালয়ের
নিজস্ব সৌন্দর্য, গাম্ভীর্য, উদারতার ছোঁওয়া যেমন মেলে সেভকে, তেমনি
রহস্যময় ডুয়ার্সের কথকতাও যেন তার সারা শরীরে.... (ছবি: লেখক)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours