জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা:
যারা
প্রাজ্ঞ এবং ইতিহাসের গতিকে আগে থেকেই চিহ্নিত করার যোজ্ঞতা অর্জন করেছেন,
তাদের এটা দায়, অনৈতিহাসিক কথনের মুখে সরাসরি সত্যটাকে
----
শুধু জানিয়ে দেওয়াতেই সিমীত না থেকে, এখনো যারা বিষয়কে দ্বান্দ্বিক নিয়মে
ব্যখ্যা করতে শিখেছেন তাদের দায়, দর্শনের অভিমুখে দাড়িয়ে যুক্তি তর্কের
আলোতে,সত্য কিংবা ইতিহাসের সমান্তরাল ভাবেই সত্যে পৌছুনোর পথটাকে
চিহ্নিত করে দেওয়া।
এ ভাবেই বুঝতে হবে,
'সাম্যহীনতার' নামে যে সব ধারনার আবর্জনা, ভাবাদর্ষের নামে চালানোর
চেষ্টা হচ্ছে, সেগুলি যে একটা আন্তর্জাতীক শ্রোত বেয়েই ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে
এবং করা হচ্ছে সামাজিক চিন্তাকে কলুষিত করার কারনেই
-----
সে সব কথা, এমনো হতে পারে যে সাধারনভাবে এগিয়ে থাকা মানুষো, বিশ্ব
পরিস্থিতির সাথে যোগাযোগ না থাকার কারনে বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আজকের
ভারতীয় অবস্থানকে যেভাবে ক্রমাগত ফ্যাসিস্ত পথে ঠেলা হচ্ছে, সেখানে
নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতীক স্বরযন্তের ধারাটি, নিজের ব্যাভিচারী চরিত্রটি
আড়াল করতে, পুর্বের লেখায় বর্নীত, ভারতীয় সমাজের অতীত থেকে চুইয়ে আসা
পঙ্কিল শ্রোতে মিশে গিয়ে প্রবঞ্চনার প্রাচীর তুলতে সুযোগ পেয়েছে।
সেখানে,
সাম্যের পরিচিতিতে যারা পরিচিত, সেই শ্রমিকদের বিষয়টাকে বোঝানোর
চেষ্টাটায় যে তীভ্রতা আনা দরকার, সেটা নেতাদের বোঝা উচিত ছিল আগে থেকেই ।
তেমনটি যদি হোত, আজকের ভারতীয় বিড়ম্বনার অনেক কিছুকেই আটকে দেওয়া যেতো। সে
ক্ষেত্রে বিপ্লবী গনপার্টীর সঙ্ঘাটাতেই যেখানে
-----
শ্রম, সাম্য এবং জ্ঞান সত্বার একাত্বতা সেটাই যেখানে বোঝানো গেলো না,
সেখান 'বিপ্লব' সব্দটার মধ্যে একধরনের 'বারুদের' গন্ধের ভাবাবুলতা আসতে
বাধ্য । ক্রমে সেই ভাবাবুলতা যখন ঠান্ডা হয়ে যায়, সেই উদ্যোগ ক্রমে
আত্মসমর্পনের পথেই ঢলে পরার কথা, তাই ঘটেছে তৃ্তীয় বিশ্বের দেশগুলিতে।
-----
ভিয়েতনাম এবং কোরিয়া যদি অন্যপথে গিয়ে থাকে সেটার প্রধান কারন, আমেরিকা
মিলিটারি তন্ত্রেরপক্ষে ভেতর থেকে অন্তর্ঘাতের সুযোগ সেখানে কমছিলো,
ইন্দোচিনের সাধারন অবস্তার কারনে। প্রকাশ্য সরাসরি আঘাত সেখানে,
ইন্দোচায়না জাতীয়তাবাদকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।
লাতিন আমেরিকার জাতীয়তাবাদও অনেকটা অনুরুপ পথে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এদিকে সুবিধাবাদের অনুপ্রবেশে একশ' বছরের শ্রমিক নেতৃ্ত্ব একথাটা কিঞ্চিত বুঝতে পেরেছে
----
সাম্যের বিনাশের অর্থ হোল ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটিয়ে চিরস্থায়ী দাসত্ব ঘোষনা।
অন্য পশ্চাদপদ অংশের কথা উল্লেখ করছি না, অন্ততঃ কয়লা, ইস্পাত কিংবা ভারী
শিল্প শ্রমিকরা বুঝতে চেয়েছিলো, কিন্তু পুজিতন্তের সাথে শ্রমের বিরোধটাই যে
আজকের কালের প্রধান দ্বন্দ্ব সেটাও কদাচিত বোঝানো হয়েছে।
-----
সাম্যের সাথে যে অনুভুতি মানুষকে যে কিভাবে রোমাঞ্চিত করতে পারে, সেটা
ধরিয়ে দিলেই যে শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠিত অংশ নিশ্চিতভাবে গ্রহন করতে সক্ষম,
তা এই লেখক জীবন অভিজ্ঞতার পাতায় পাতায় অনুভব করেছেন। সাম্যের অনুভুতি
কিভাবে মানুষে-মানুষে তো বটেই পারিবারিক এবং এমন কি স্বামী-স্ত্রী
সম্পর্ককেও প্রাকৃ্তিক সখ্যতায় বেধে রাখে। সেটাই দুর্গাপুরেই নয়, কয়লাতেও
দেখা গেছে। এমন কি সাম্প্রতিক কালের ধর্মঘটে। শ্রমিকরা সব সময় সত্যের
অনুসারী, যদি সত্যকে তার সঠিক রুপে নিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা নেতারা দেখাতে
পারেন। তারা ইউনিয়ন গড়েন, নেতা তুলে আনেন নিজেদের মধ্যে নিজেদের রক্ত দিয়ে
নেতাদের রক্ষা করেন। কমরেড এ কে রায় এবং হারাধন রায় তার উদাহারন। ইস্পাতে
তো সারা দেশেই তারা ইউনিয়ন নির্মান করেছেন এবং দেশে মজুরী ব্যবস্থার আমুল
পরিবর্তন করে দেন।
যারা পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির
গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তারা দেখেছেন, সেখানেও উৎপাদনের অর্থনীতির
সাথে যদি বন্ঠনের অর্থনীতির সন্তুলন না থাকে তবে, তো অর্থনৈ্তিক উৎপাদন
ব্যবস্থাটাই ভেংগে পরবে। এখানেও সেই সন্তুলনের বিষয়টি 'সাম্য' থেকেই
পুজিতন্ত্রে আমদানী।
সে কালে শুধু নয়, আজকালও বোঝানোর চেষ্টা হয়, যেন মার্ক্সবাদ নিজেই অচল। একটা গল্পে শুনেছিলাম, মার্ক্স নিজেই নাকি করেছিলেন।
------
মার্ক্সবাদ যদি অচল হয়ে যায়, তার অর্থ যদি এই হয় বিশ্বটারই ধ্বংস হয়ে
যাওয়া, তবে মার্ক্সবাদের অচলতা কিংবা সচলতার অর্থই থাকে না। সেই অর্থেই
তিনি বুঝিয়েছিলেন, আসলে 'সাম্য' শুধু তো 'মানুষে - মানুষের' সম্পর্কের
মানবিক সন্তুলন, কিংবা উৎপাদন কিংবা বন্ঠনের সন্তুলন কেবল নয়। বিশ্ব যদি
ঠিকই করে ফেলে,
---- সাম্যের অভিমুখ থেকে ফিরে আসবে, তবে পুজিতান্ত্রিক প্রতিযোগীতার ঠেলাতেই, প্রকৃ্তির উপরে মানুষের প্রভুত্ব বিস্তারের পথেই
মানুষের
অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বিশ্ব জগতটাকেই ধ্বংস করে দেবে।মার্ক্স যদি বলে
থাকেন 'সাম্য'ই প্রকৃ্তি এবং মানুষের শুধু নয়, উৎপাদনের এক অংশের সাথে অন্য
অংশের সন্তলন, সাম্যই নিশ্চিত করতে পারে। তিনি বুঝলেন এবং বোঝালেন এই সব
সন্তুলন ভেংগে গিয়ে যদি , মার্ক্সবাদ ব্যর্থ প্রমানিত হয়, তাতে 'অবোধে
গোবোধের আনন্দ' হতে পারে, তাতে বিশ্বজগতের অস্তিত্ব বিনাসে কোন হের-ফের
হবে না।
----- . বিশ্বজানে, ইতিমধ্যে সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ট ভৌতবাদী বৈজ্ঞানিক বলে গেছেন, আগামী ৫০০ বছরের মধ্যে পৃথিবী
মানুষ শুধু নয়, প্রাণিজগতের
বাসযোগ্য থাকবে না। কেউ কেউ আবার সম্প্রতি বলছেন আগামী ২০/২৫ বছরের মধ্যে সেই ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটবে।
------
অনেকে শিখিয়েছিলেন, দেশে-দেশে পুঁজি নির্মানে পাবলিক কোম্পানী আসার ফলে,
সামাজিক অন্তর্বিরোধকে আটকে দেওয়া যাবে। না হয় তা মেনে নেওয়া গেলো, কিন্তু
পুজিতান্ত্রিক হিংস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে প্রকৃ্তি কিংবা শেয়ার হোল্ডারদের
কি বাচানো যাচ্ছে? তাই যদি হবে, ভারতের অর্থনীতিতে যে ধ্বংসাত্মক
বিপর্য্যয় দেখা দিয়েছে, তা থেকে সব থরহরি কম্পন কিসের জন্য? সেই এক কথা
বেপোরোয়া প্রতিযোগীতা, কোটি কোটি মানুষের শেয়ারের বিনিয়োগ অতল তলে তলিয়ে
যাচ্ছে।
------- মাঝখানে তত্ব দাড় করানো হোল,
শিল্পায়নকে যান্ত্রিক অটোমেশন থেকে, প্রযুক্তিগত বিপ্লবে উঠিয়ে এনে,
বিপ্লবী শ্রেনী হিসেবে শ্রমিকদেরকেই লোপাট করে দিয়ে বিশ্ব দ্বন্দ্বকে
------- দাস এবং পুজির মালিকে বদলে দেওয়া হবে।
এই তত্বের সুত্র ধরেই, সোভিয়েত ভেংগে যাওয়ার পর, আমেরিকার তাবর তাবর অর্থনীতিবাদী দার্শনিকরা বিশ্বময় ঢোল বাজিয়ে জানিয়ে দিলেন
----
প্রযুক্তি বিপ্লব যখন স্বাধীন শ্রমিক সত্বাকেই বিনাশ করে দিয়েছে, তখন
স্বাভাবিক কারনেই শ্রেনী সংগ্রাম যখন স্তব্ধ তখন আবার ইতিহাস কিসের?
তারা জানিয়ে দিলেন,
-----
ইতিহাসহীন বিশ্বে এখন দাসত্ব এবং দাসত্বকে ঘিরে চিন্তনই চিরন্তন সত্য,
অন্য সব কিছুই নাকি মায়া। তা বেশ বেশ, তবে জিজ্ঞাসা করতে হয়, তবে বিশ্বময়
যুদ্ধের দামামা কিশের জন্য। কেন, আমেরিকান ফৌজকে কাশ্মীরকে ছুতো করে, চিনের
সিমান্তে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, কেনই বা, বংগোপোসাগরকে উন্মুক্ত করে,
সে পথে সপ্তম নৌবহরকে চিনের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য আমেরিকার
মিলিটারিতন্ত্র এতো মরিয়া? (ক্রমশ)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours