দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
-- ক্রীং ক্রীং ক্রীং
-- হ্যালো, হ্যালো, কে বলছেন?
-- শান্তিনিকেতন থানা থেকে বলছি।
-- ও! কস্তুরী ম্যাডাম, বলছেন! বলুন!
--কি খবর? আপনাদের ওখানে?
--
আজকে, আপনাকে ফোন করবো। আগে আমরা ধরবো। তারপর আপনার হাতে তুলে দেব। এরপর
আপনাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে গাঁজা উদ্ধার করবো। খবর পেয়েছি, গ্রামের একজন
বেশ কিছু গাঁজা বাড়িতে রেখেছে।
-- ওকে। তাও, কটা নাগাদ ফোন করবেন?
--- এই ধরুন, বিকেল পাঁচটা।
--- ওকে, বাই! হোপ ফর দ্য বেস্ট!!
ফোনটা রেখেই আজমিরা বিবি তাঁর প্রমিলা বাহিনীর ২৩ জন সদস্যদের নিজের বাড়িতে মিটিংয়ের জন্য ডাকলেন।
মিটিং
হল। কিভাবে একশন হবে, তার ব্লু প্রিন্ট তৈরি হল। অপরাধীকে কোথায় পাওয়া
যাবে। কিভাবে তাকে আঁটকে রাখা হবে। আর কিভাবে বাকিরা গাঁজা মজুত কারীর
বাড়ির উপর নজরদারি করবে ইত্যাদি...
কে এই আজমিরা
বিবি? যিনি ভালো রাঁধেন আবার খুব সুন্দর পরিপাটি করে চুলও বাঁধেন। মোদ্দা
কথা, সুগৃহিনীর মত সংসার সামলে, সমাজের কথা ভাবেন তিনি। রান্না বান্না করা,
সকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেকে পৌঁছে দেওয়া। আবার দুপুরে মেয়েকে উচ্চ
বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া। তাদের পড়ানো, স্বামীর দিকে নজর দেওয়া। তার
মাঝে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো...
এই লক্ষ্যে
অবিচল আজমিরা বিবি! বোলপুরের কাছে রূপপুর পঞ্চায়েতের মোলডাঙার গৃহবধূ।
অবশ্য তাঁকে শুধু মাত্র নিপাট গৃহবধূর অভিধায় রাখা যাবে না। কারণ রিলে
নয়, রিয়েল লাইফের নায়িকা তিনি! তাঁর লক্ষ্য নেশামুক্ত গ্রাম গড়া! আর সেই
কাজে এগিয়ে এসেছে আজমিরা বিবির নেতৃত্বে তাঁর মত এলাকার গৃহবধূরা।
আলাপচারিতায় আজমিরা বিবি জানান, শুনতে খুব খারাপ লাগতো ড্রাগ পাচারের
গ্রাম হিসেবে নিজের গ্রাম মোলডাঙার পরিচিতি। কেউ ড্রাগপাচারকারী হিসেবে
ধরা পড়লে, উঠত সেই মোলডাঙার নাম। একদিন গ্রামের সেখ সোহারাব ড্রাগ বিক্রি
করা অবস্থায় ধরা পড়ে তাঁর হাতেই। আজ ড্রাগ বিরোধী আন্দোলনের মুখ সেই
আজমিরা বিবি। বাড়িতে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে ভরপুর সংসার। ছেলে দ্বিতীয়
শ্রেণীর ছাত্র। মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। তাঁর হাতেই এক বছর আগে গড়ে ওঠা
এই ড্রাগ বিরোধী প্রমিলা বাহিনীর কাজ বন্ধ হতে দেন নি তিনি। তাঁর মহিলাদের
শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে এলাকায় ঢুকতে পারে না কোন ড্রাগ পাচারকারী।
এই
কাজে ব্রতী হওয়ার ক্ষণ কম নাটকীয় ছিল না! ঠিক এক বছর আগে রূপপুর গ্রাম
পঞ্চায়েতে কোন এক রাজনৈতিক দলের সদস্যা তিনি। গ্রামবাসীদের অনুরোধ ছিল পায়ে
ধরে ক্ষমা চাইলে অভিযুক্তকে ছেড়ে দিতে। তিনি তা করেন নি, উল্টে পুলিশের
হাতে তুলে দেন। আর এভাবেই পথ চলা বছর খানেক আগে। সেদিনই রূপপুর পঞ্চায়েতের
২৩ জন মহিলা মিলে ড্রাগ বিরোধী আন্দোলনে সামিল আজমিরা বিবি। আজ আজমিরা বিবি
ড্রাগ বিরোধী আন্দোলনের মুখ। এব্যাপারে বর্তমান পঞ্চায়েতের সদস্য
নারেন্দ্র নাথ সরকার জানান, এই আন্দোলনে পঞ্চায়েত তাঁদের পাশে আছে। একইভাবে
শান্তিনিকেতন মহিলা থানা তাঁদের পাশে আছে বলে জানিয়েছে।
এবার আসি, শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘটনার দিন। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় সেখ সোহরাব ও
হাঁসু সেখ নামে দুজনকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয় তাঁরই নেতৃত্বে প্রমিলা
বাহিনী। জানা গেছে, একদিন গ্রামের সেখ সোহারাব ড্রাগ বিক্রি করা অবস্থায়
ধরা পড়ে তাঁর হাতেই। তখন রূপপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের সদস্যা তিনি।
এদিন ফের সোহরাব ধরা পড়ে তাঁর হাতেই। হাঁসু সেখ ও তাঁর এক ভাই ও বাবা এই
ড্রাগ পাচারের অভিযোগে ৬ মাস জেল খেটে গ্রামে ফিরেছে। ফের শুরু করেছিল এই
ব্যবসা। আজমিরা বিবি জানান, হাঁসু সেখ একজন নেশাখোর। বছর তিরিশের এই যুবক
পেশায় মজদুর। তার পরিবার আছে। গোটা দিন খেটে তার আয় তিনশো টাকা। নেশা করতে
ব্যয় পাঁচশো টাকা। আজমিরা বিবি বলেন, এই দুশো টাকার জন্য হাঁসুর মত
অনেককেই স্ত্রীর গহনা বা চুরির পথে নামতে হয়। আর মোলডাঙার মত গরীব গ্রামের
দুর্দশা দিন দিন বেড়েই চলছিল। আর একই সঙ্গে বাড়ছিল দুর্নাম। দুই সন্তানের
মা আজমিরি বিবি এলাকার অন্যান্য মহিলাদের বোঝাতে সমর্থ হন নিজেদের ছেলে
মেয়েদের ড্রাগের হাত থেকে বাঁচাতে একটা কমিটি তৈরী করতে হবে। বর্তমানে
তাঁদের সদস্যার সংখ্যা ২৩। তাঁরা মাসে একটা করে মিটিংয়ের জন্য একজায়গায়
মিলিত হন। কোন হুমকি পান এই প্রশ্ন করতেই, তিনি বলেন, হাঁসু সেখকে ধরেই,
গ্রামের আশরফ মিঞার বাড়ি থেকে আড়াই কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। তার পরিবার
কী আমাদের ছেড়ে দেবে ভেবেছেন? গালমন্দ করছেন। তবে হুমকিকে আমরা ভয় পায় না।
ভালো কাজ করলে, হুমকি পেতে হয় আমরা জানি।
জানা গেছে, একটা সময় ছিল যখন ওই গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ মানুষ নেশায়
বুঁদ হয়ে থাকত। বাইরে থেকে কিছু ড্রাগ পাচারকারী গ্রামে ব্রাউন সুগার, চরস,
গাঁজা সরবরাহ করত। গ্রামের কয়েকটি পরিবার সেই ড্রাগের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত
ছিল। গ্রামকে নেশামুক্ত করতে মহিলারা সঙ্গবদ্ধ হয়। এরপর আজমিরা বেগমের
নেতৃত্বে ২৩ জনের একটি কমিটি গঠন করে মাদক বিরোধী অভিযানে নামেন প্রমীলারা।
তারা পাশে পান পুলিশ প্রশাসন ও পঞ্চায়েতকে। পুলিশ জানিয়েছে, দুজনকে আটক
করা হয়েছে। তবে উদ্ধার হওয়া গাঁজার ক্ষেত্রে কোন অভিযোগ না থাকায় কাউকে আটক
করা হয়নি। আজমিরা বিবি বলেন, আমরা চাই, নতুন করে কেউ যেন গ্রামের
নেশাগ্রস্থ না হয়ে পড়ে। আমাদের লক্ষ্য নেশামুক্ত গ্রাম। মাদক চক্রের হাতে
তাঁর জীবনের ইতিও হতে পারে! তবে তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই তাঁর। নতুন ভোরের
অপেক্ষায় আজমিরা বিবি। তাঁর বিশ্বাস, ভোর হয়ে একদিন সকাল হবে। আর সেদিন
একমাত্র তিনিই বলতে পারেন, একমাত্র তিনিই বলার অধিকারিণী,
'তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি...'
Post A Comment:
0 comments so far,add yours