মুজতবা
আল মামুন, সাংবাদিক, কলকাতা : তালাক নিষিদ্ধ হয় নি। নিষিদ্ধ হয়েছে এক
লপ্তের তিন তালাক । প্রথমে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করেছিল। এবার সংসদের উভয়
কক্ষে তা পাশ হয়ে যাওয়ায়, আইনে পরিণত হলো। রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষরও
করেছেন। এই আইন লঙ্ঘন করলে তালাককর্তার তিন বছর জেল এবং জরিমানার বিধান
আছে । ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে তা গণ্য হবে।
বিষয়টা
নিয়ে অযথা জল ঘোলা করা হচ্ছে। মূলত তালাক একরকমেরই। তা তিন মাসে তিনবার
বলার কথা। এর মধ্যে এক খলিফার আমলে, বিশেষ পরিস্থিতিতে, সাময়িকভাবে
একলপ্তে তিন তালাক চালু হয়েছিল। পরে তা রদ হয়। সমস্যার হলো, এক লপ্তে তিল
তালাক চালুর দলিল আছে, রদের দলিল পাওয়া যায় না। সেই অজুহাত সামনে রেখে
মুসলিম সমাজের সামান্য একটা অংশ একলপ্তে তিন তালাক জারি রাখে। মুসলিম
মাত্রেই, তথা সমাজের বৃহৎ অংশ একলপ্তে তিন তালাকের বিপক্ষে। কোরাণেও
একলপ্তে তিন তালাকের কথা নেই।
কিন্তু
বিষয়টাকে এমন ভাবে সামনে আনা হচ্ছে , যেন মোদি সরকার সমাজসংস্কারক রাজা
রামমোহন রায় হয়ে মুসলিম সমাজের বিরাট এক কুসংস্কার দূর করে দিলেন, যা
মুসলিমরা পারছিল না। বরং এটাই সত্য যে, সামান্য অংশ বাদে, মুসলিম সমাজ ওই
প্রথাকে অনেক আগেই বর্জন করেছে। মরা বাঘ পুনরায় মেরে মোদি সরকার বুকের
ছাতি চওড়া করছে। আর অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাতে বাহবা দিয়ে মোদিকে ফারিস্তার
আসনে বসাতে চাইছে। ব্যাপারটা পুরোটাই সাজানো ও চোখে ধুলো দেওয়ার। বরং এর
পিছনে যে ভয়ংকর রাজনীতি বা ষড়যন্ত্র লুক্কায়িত রয়েছে, তা আমরা এই মুহূর্তে
ধরতে পারছি না। আজ দু বাহু তুলে নাচছে, আর কিছুদিন পর তারাই বলবে, পিছনে
এই ষড়যন্ত্র ছিল, তা তো বুঝি নি! দুঃখের, এরা যখন বুঝবে, তখন অনেক দেরি
হয়ে যাবে। কারণ, যে দল একটা জনজাতিকে শেষ করে দিতে চায় , তাদের কাছে
মুসলিম নারীর প্রতি দরদ.... বেখাপ্পা লাগে না কি ? তারা পিটিয়ে
পুরুষ-হত্যা করে যে সমাজের মহিলাদের বিধবা করছে, আবার সেই সমাজের মহিলাদের
দরদে অশ্রু বিসর্জন করছে... খটকা লাগে না কি ? মুসলিম সমাজের বক্তব্য,
মুসলিম পুরুষদের জেলে পচানো বা হেনস্থার অস্ত্র এটা। এছাড়া অনেক প্রশ্নের
জবাব নেই আইনে। যেমন, অপরাধী মুরুষ একমাত্র উপার্জনকারী হলে, সেই সংসারকে
কি সরকার মাসোহারা দেবে ?
তালাকের
( বিবাহবিচ্ছেদ ) নিয়ম হল, স্বামী-স্ত্রী যদি মনে করে,আর কোনও ভাবেই
তাদের একত্রিত তাকা সম্ভব নয়, তবে প্রথমে এক তালাক উচ্চারণ এবং এক মাস
অপেক্ষা। রাগের মাথায় বা কোনও অসন্তুষ্টির কারণে এক তালাক বলার পর ওই এক
মাসের মধ্যে তা মিটে গেলে তালাক বাতিল। যদি না মেটে, দ্বিতীয় মাসে দ্বিতীয়
তালাক। আবার এক মাস অপেক্ষা, যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয় হলে তালাক বাতিল।
নাতলে তৃতীয় মাসে তৃতীয়বার তালাক উচ্চারণে গ্রহণীয় হবে তালাক। এই দীর্ঘ সময়
ধরে প্রক্রিয়া চলে, যদি উভয় পক্ষ নমনীয় হয়, এই লক্ষে।
কিন্তু
কিছু মানুষ একবারে তিন তালাক দিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছিল। কেউ ফোনে, কেউ
ই-মেলে তালাক দিচ্ছিল। এরা সমাজের ক্ষুদ্রতম অংশ। হলেও খলিফার ধারা মেনে
স্বেচ্ছাচার চালাচ্ছিল। সেটা বন্ধ হলো। ভাল পদক্ষেপ। বিড়ালের গলায় কে ঘন্টা
বাঁধবে, তা নিয়ে ঠেলাঠেলির মাঝে মোদি সরকার ঝোপ বুঝে ঘন্টা বেঁধে দিয়েছে।
সরকারের কাজ বলতে এটুকু।
পরিসংখ্যান বলছে, মুসলিম
সমাজের মোট অংশের মাত্র এক শতাংশ হয়তো এইসব করতো। মাত্র এক শতাংশের জন্যে
আইন করে বিরাট অ্যাচিভমেন্ট দাবি করে মোদি সরকার বুক ফোলাচ্ছে।
২০১১-র
জনগণনা বলছে হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের তালাক কম। মুসলিম-২৩.৩ শতাংশ,
হিন্দু-৬৮ শতাংশ। এই সমীক্ষাটুকুই বলে দিচ্ছে তালাক ইস্যুতে অভিন্ন
দেওয়ানি বিধি চাওয়ার মধ্যে যত না সদিচ্ছা আছে, তার থেকেও বেশি রয়েছে
সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ কেউ বলছেন, ভারতে ৮০ শতাংশ হিন্দুর ৬৮
শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদ ও ১৮ শতাংশ মুসলিমের ২৩ শতাংশ বিচ্ছেদ নিজ নিজ সমাজের
বিপক্ষে যাচ্ছে। তাঁরা এটা দেখছেন না যে, ৮০ শতাংশ হিন্দুর এই হিসাব
প্রায় ১১ কোটি আদিবাসী ও প্রায় ২২ শতাংশ তপশিলীকে ধরে করা হয়েছে যারা
কোনমতেই বর্ণহিন্দুদের স্বার্থ রক্ষাকারী হিন্দু কোড বিলের সঙ্গে একাত্মতা
বোধ করে না। তাদের সমাজে অন্যায় বিচ্ছেদ প্রায় নেই। তাহলে ব্যাপারটা কী
দাঁড়ালো ?
অভিজ্ঞ
বিশ্লেষকদের মতে, আসল কথা হল, নরেন্দ্র মোদি (বকলমে আর এস এস) চান
মুসলিমদের একতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে । এমনিতেই গুজরাটের বোহরা শিয়াদের
ভোটকে নিজের কুক্ষিগত করেছেন, তার উপর শিয়া প্রভাবিত সুফিদের হাত করার
চেষ্টা চলছে। এরপর সুন্নিদের একটি গোষ্ঠীকে তোল্লা দিয়ে নিজের ভোটব্যাঙ্ক
করতে যেমন চাইছেন, তেমনি মুসলিম সমাজের বিভাজনটাকে পোক্ত করতেও চাইছেন।
সেই 'ডিভাইডেড অ্যান্ড রুল' পলিশি। ফাউ হিসেবে থাকছে, মুসলিম সম্পর্কে একটা
নেতিবাচক ধারণা জন্মানোর ব্যবস্থা করা।
আগেই
বলেছি, ভারতের মুসলিম সমাজে একবারে তিন তালাক উচ্চারণ করে বিবাহ
বিচ্ছেদের ঘটনা বাস্তবে একেবারেই নামমাত্র, ১ শতাংশেরও কম। সমীক্ষা করেছিল
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডিবেটস ইন ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিআরডিডিপি)।
১৬,৮৬০ জন মুসলিম পুরুষ এবং ৩৮১১ জন নারীর ওপর। নেতৃত্বে ছিলেন অর্থনীতিবিদ
ড: আবু সালেহ শরিফ, যিনি ২০০৬ সালে ভারতীয় মুসলিমদের অনগ্রসরতা এবং
বঞ্চনা নিয়ে গঠিত 'সাচার কমিটি'র অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন। সমীক্ষায়
৩৩১টি মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এগুলোর
এক-চতুর্থাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (যেমন কাজি) জড়িত ছিল।
তবে
সমীক্ষায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফলাফল হচ্ছে, ৩৩১টি ঘটনার মধ্যে কোনো
সাক্ষীর উপস্থিতি ছাড়াই মুখে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে বিবাহ বিচ্ছেদের
ঘটনা ছিল মাত্র একটা অর্থাৎ ০.৩ শতাংশ। ফলে কেন্দ্র সরকার যে কৃতিত্বের
দাবি করছে, তা অমূলক। এটা স্রেফ ধোঁকাবাজি। বৃহত্তর মুসলিম সমাজ এতে জড়িত
ছিল না। এতে তাদের তেমন কোনও লাভ বা ক্ষতি হয়নি।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours