fiture
শুভদীপ গুপ্ত, লেখক, কলকাতা:


ভদ্রমহিলার নাম ব্রুনি ওয়্যার, অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। পেশায় একজন নার্স। সম্ভবত আপনি তাঁকে চেনেন না। হ্যাঁ আমিও তাঁর নামটাও জানতাম না কদিন আগেও। তিনি জীবনের আট বছর কাজ করেছিলেন একদম মৃত্যুপথযাত্রী রুগীদের ইউনিটে। এই রুগীরা হচ্ছেন সেই পর্যায় পৌছে যাওয়া মানুষ যাঁদের আর বাঁচবার কোন আশা নেই। তো ওনার কাজটা ছিল সেই সমস্ত রুগীদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে  যন্ত্রণা উপশমের চেষ্টা করা। জীবনের শেষ সপ্তাহগুলো কাটানো রোগীদেরকে যথাসম্ভব সেবা-শুশ্রূষা করার চেষ্টা করতেন তিনি। মানবিকতার অনুভূতি আর পাঁচজনের থেকে তাঁর একটু বেশিই ছিল। তাই খুব কাছ থেকে দেখতেন শুনতেন ধনী, দরিদ্র, জ্ঞানী, অজ্ঞানী নির্বিশেষে সে সমস্ত মানুষগুলোর শেষ সময়কার আবেগ, অনুভূতি এবং আক্ষেপ। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্রুনি 'ইন্সপারেশন অ্যান্ড চাই' নামের একটি ব্লগে লেখা শুরু করেন। তুমুল জনপ্রিয় হয় সেই লেখা। এবার সাহস আর একটু বেড়ে গেল। লিখে ফেললেন আস্ত একটা বই যার নাম 'দ্য টপ ফাইভ রিগ্রেটস অফ ডাইং' অর্থাৎ মৃত্যুর আগে যে ৫টি বিষয়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি আক্ষেপ থেকে যায়। এখন কথা হল কি আছে সেই বইয়ে? কি সেই আক্ষেপ যা গরীব, বড়লোক, নামী, অনামী নির্বিশেষে শেষ সময়টায় তাড়া করে ফেরে? আসুন দেখা যাক। 

১) “অন্যদের সন্তুষ্ট করার পেছনে না ছুটে নিজের ভালবাসা কিংবা পছন্দের প্রতি সৎ থেকে জীবনটা কাটানোর সাহস যদি থাকতো আমার !”

ব্রুনির মতে, যেকোনো মানুষের সবচেয়ে বেশি আফসোস থেকে যায় এই ব্যাপারটি নিয়েই। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসেই মানুষ টের পায়, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার কতগুলো স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেছে। কেবলই সবার মন জুগিয়ে কাজ করতে করতে নিজের জন্য কোনো সময়ই রাখা হয়নি। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি আর। অনেকে মনে করেন, ভবিষ্যতে নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণ করবেন। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ হয়তো আর আসে না। কারো হয়তো শখ ছিল টুকটাক লেখালেখি করবেন কিংবা গিটার বাজানো শিখবেন। কিন্তু জীবনের আসল কাজগুলোর ভিড়ে সেই ইচ্ছাগুলো হারিয়ে গেছে। আবার কারো হয়তো শখ ছিল, বনের সবুজের মাঝে অ্যাডভেঞ্চারে হারিয়ে যাবেন কিছুদিনের জন্য। কিন্তু কখনো শিক্ষাজীবন আর কখনো চাকরিজীবন সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবার চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে নিজের চাওয়াগুলো পিছিয়ে গেছে বারবার। অবশেষে যখন একটু অবসর মিললো, তখন আর সেই উদ্যম, শক্তি কিংবা সামর্থ্য নেই। স্বপ্নটা অধরাই রয়ে গেলো।

২) “শুধু কাজ নিয়েই জীবনভর ব্যস্ত থেকে গেলাম !”

জীবনে ক্যারিয়ার, চাকরির পেছনে ছুটে অনেকেই নিজেদের মূল্যবান বহু জিনিস হারিয়ে ফেলেন। সন্তানের প্রথম হাঁটা, মুখে প্রথম বুলি ফোটা কিংবা অসুস্থ মায়ের পাশে থাকার মতো মুহূর্তগুলো পরে চাইলেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সন্তান বড় হয়ে যায়, আস্তে আস্তে সৃষ্টি হয় দূরত্ব। যে সন্তানটি সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করতো, সে এখন কথা বলতে না পারলেই খুশি হয়। দূরত্ব কাটিয়ে মনের কথাটা আর প্রকাশ করা হয়ে ওঠে না। ঠিক তেমনি ব্যস্ততার কারণে অনেকসময় মা-বাবার সাথে ঠিকমতো যোগাযোগটাও রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। একসময় মা-বাবা ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন। পরে যখন নিজের মতো করে একটু সময় পাওয়া যায়, তখন প্রিয়জনদের সাথে আন্তরিক সম্পর্কগুলো গেছে হারিয়ে। জীবনের ফেলে আসা সেই মুহূর্তগুলোর জন্য বুকে বারবার হাহাকার জাগে। 

৩) “প্রিয় বন্ধুগুলোর সাথে যদি আরো কিছু সময় কাটাতাম !”

মান্না দে'র ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’ গানটি স্মৃতিরোমন্থন করতে পারেনি, এমন কোনো মানুষ খুব কম। নিজের জীবনের এই স্বর্ণালী সময়ের মধুর সম্পর্কগুলোয় বিভিন্ন কারণে ভাটা পড়ে যায়। শিক্ষাজীবনে কিংবা ক্যারিয়ার গড়ার পথে রেষারেষিতে কিংবা ব্যস্ততায় অনেকের সাথে হৃদ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। আগে যার সাথে কথা না বলে থাকা যেত না, পরে তাকেই রাস্তায় দেখে না দেখার ভান করতে হয়। নিজের জীবন গড়ার পথে নানা ব্যস্ততায় অনেক অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু জীবনে সবকিছু পেয়ে যাবার পরে হঠাৎ করে সেই লাগামছাড়া সময়টার কথাই মনে পড়তে থাকে।

৪) “নিজের অনুভূতিগুলো যদি ঠিক মতন প্রকাশ করতে পারতাম"

অনেক মানুষই বিভিন্ন স্বার্থে ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে যান। ফলে সৃষ্টি হয় একটি তিক্ত সম্পর্কের। যেসব মানুষের সাথে সামনে এক কিন্তু পেছনে আরেকরকম কথা বলতে হয়, তাদের সাথে চলা নিজের ওপরেই পীড়াদায়ক। সোজাসাপ্টা কথা বলার সাহস থাকলে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতি হলেও নিজের মনের ভেতরে গুমরে মরতে হতো না।
দুঃখ, হাসি, কান্নাসহ যেকোনো আবেগ-অনুভূতি চেপে রাখাই স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে মনের ভাবটা প্রকাশ না করে ফেলা তাই পরে হয়ে ওঠে আক্ষেপের কারণ।

৫) “জীবনটা যদি আরো বেশি হাসি-আনন্দে কাটাতাম !”

আশ্চর্য হলেও সত্য, এই আক্ষেপটি মৃত্যুর আগে প্রায় সবাইকেই করতে দেখা যায়। অনেকেই অন্যের ওপর নির্ভর করে নিজেকে সুখী দেখতে চায়, অথচ সুখী হওয়াটা কেবল নিজেরই ওপর। অন্যকে তুষ্ট করার পেছনে যতটুকু সময় দেয়া হচ্ছে, তার থেকে কিছুটা সময় নিজেকে বিনোদিত করার পেছনে দিলেও সত্ত্বার খোরাক জোটে। পুরনো অভ্যাস, পরিচিত পরিবেশ ফেলে আসতে চান না অনেকেই। পরিবর্তনের শঙ্কায় অনেকেই নিজেকে বোঝান যে, তারা সুখী আছেন। অথচ ভেতরে ভেতরে তাদের মন গুমরে মরছে একটু হাসি-ঠাট্টা, একটু নির্ভাবনার আশায়। আবার অনেকে সঞ্চয়ের নামে নিম্নমানের জীবনযাপন করেন, জোর করে নিজেকে খুশি করতে চান। অথচ ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে বর্তমানকে উপভোগ করলেই শেষ বয়সে পরিতৃপ্তি মিলতো।

আমরা যারা এখনো সুস্থভাবে সবলভাবে বেঁচে আছি অথচ চারপাশে সুখী হওয়ার অপার ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও সেগুলোকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছি তারা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কখনো কি ভেবে দেখেছি? ব্যস্ততায় নিত্যদিন পার করে শেষ বয়সে এসে আমাকে আপনাকেও আফসোসের অবসাদ গ্রাস করবে না তো ?
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours